পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বিশ্বের বহু দেশের সমগ্র কৃষিখাত আধুনিক হয়েছে। সেটা যেমন হয়েছে বীজ, সার, কীটনাশক ইত্যাদি ক্ষেত্রে; তেমনি হয়েছে চাষ, সেচ, বীজ রোপণ, কর্তন, মাড়াই ও প্যাকেট-জাত ইত্যাদি ক্ষেত্রেও। কৃষি ভিত্তিক শিল্পও গড়ে তোলা হয়েছে প্রয়োজন মোতাবেক। এসব ক্ষেত্রে আমাদের দেশের অবস্থা সুখকর নয়! দেশে ধান, পাটসহ অনেক ফসলের অধিক উৎপাদনশীল এবং খরা, বন্যা ও লবণাক্তসহিষ্ণু জাত আবিষ্কার হয়েছে। কিন্তু এসবের উৎপাদন হার ঘোষণা মোতাবেক না হওয়ায় তা কৃষক ব্যবহার করছে না। এ ব্যাপারে সম্প্রতি এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘গত ৪৫ বছরে দেশে ১৩৫টি উন্নত জাতের ধান উদ্ভাবন করা হয়েছে। কিন্তু এসবের উৎপাদন ঘোষণা মোতাবেক না হওয়ায় তার যৎসামান্যই তথা মাত্র ৫টি জাত কৃষক পর্যায়ে ব্যহৃত হচ্ছে।’ অবশ্য বিদেশের হাইব্রিডে দেশ সয়লাব হয়ে গেছে এবং তা কৃষকরা ব্যবহার করছে। ফলে বিভিন্ন ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে অনেক। অপরদিকে, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের কোনো ঘাটতি নেই দেশে। কিন্তু এসব মানুষের এবং জীব-বৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। তাই বিভিন্ন দেশ প্রাকৃতিক সার ও কীটনাশক দিয়ে ফসল উৎপাদানের দিকে ঝুঁকে পড়েছে। এ ক্ষেত্রেও আমাদের অগ্রগতি নেই বললেই চলে। যা’হোক, দেশে পাট থেকে কাগজের মন্ড, ব্যাগ, সুতাসহ বিভিন্ন পরিবেশবান্ধব পণ্য আবিষ্কার হয়েছে বহুদিন আগেই। তাই পাটের ঐতিহ্য ফিরে আসার স্বপ্নে সমগ্র জাতি বিভোর। অথচ এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন নেই একটি ক্ষেত্রেও। তাই একদিকে পরিবেশ যেমন ধ্বংস হচ্ছে মারাত্মকভাবে, অন্যদিকে পাটের চাহিদা বৃদ্ধি না পাওয়ায় তা এখনও কৃষকের গলার ফাঁস হয়েই আছে! তেমনি অবস্থা পাটকলেরও। কারণ, লোকসানের কারণে দেশের বেশিরভাগ পাটকল বন্ধ হয়ে আছে দীর্ঘদিন যাবত। তারপরও কয়েকটি পাট কল চালু করা হয় কয়েক বছর হলো। সেগুলোও লোকসানের কারণে শ্রমিকদের মজুরী পরিশোধ করতে না পারায় বিজিএমসি’র একটি যায়গা বিক্রি করে তা পরিশোধ করা হয়েছিল। এর পর আবার শ্রমিকের মজুরী পরিশোধ না হওয়ায় শ্রমিকরা আন্দোলন করছে। পাটের আবিষ্কারগুলো কাজে লাগানো গেলে এই করুণ অবস্থা সৃষ্টি হতো না। এমনকি পাটের পাতা থেকে যে চা উৎপাদন হয়, সেটা করা হলেও রফতানি আয় বাড়তো। জার্মানিতে পাট পাতার চা জনপ্রিয় পানীয়।
ফসল চাষের জন্য পানি অপরিহার্য, যা এ দেশে প্রধানত সেচের মাধ্যমেই হয়। কিন্তু সেচের পানি সরকারিভাবে সরবরাহ বন্ধ করে দেওয়ার কারণে দেশে এখন অসংখ্য ‘পানি দস্যু’ সৃষ্টি হয়েছে। তাদের খপ্পরে পড়ে কৃষকের লাভের ধন পিঁপড়ায় খেয়ে ফেলছে। পানির মূল্য নেওয়া হয় একর প্রতি ৭-৮ হাজার টাকা করে। তাও ঠিকমতো পানি দেওয়া হয় না। অথচ সব নদী ও খালবিল সংস্কার করে পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করে সেখান থেকে সরকারিভাবে অগভীর নলকূপ দিয়ে এবং মাঠে গভীর নলকূপ বসিয়ে স্বল্প মূল্যে পানি সরবরাহ করা সম্ভব। এটা হলে কৃষকরা রক্ষা পেত। আর সব সেচ মেশিন সৌর বিদ্যুতে চালানো হলে ব্যয় আরও হ্রাস পেত। তবুও এসব করা হচ্ছে না। তদ্রুপ অবস্থা কৃষি যন্ত্র ব্যবহারের ক্ষেত্রেও। এ ব্যাপারে সম্প্রতি এক দৈনিকে প্রকাশ, ‘বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা মতে, সারা বিশ্বেই ধানের চারা রোপণে উন্নত প্রযুক্তির ও যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। দেশেও জমি চাষে প্রায় ৯০% যান্ত্রিকীকরণ হলেও ট্রান্সপ্ল্যান্টিং (রোপণ)-০.১% ও হারভেস্টিং (কর্তন)-০.৮%। যন্ত্রের ব্যবহার না থাকায় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হচ্ছেন কৃষক। কৃষিতে শ্রমিক সংকট মেটানো ও কৃষকের অর্থের অপচয় কমিয়ে আনতে যান্ত্রিকীকরণের কোনো বিকল্প নেই।’ স্মরণীয়, দেশের সর্বত্রই কৃষি শ্রমিকের ঘাটতি ব্যাপক। কৃষি শ্রমিকরা কৃষি কাজ ছেড়ে শহরে গিয়ে রাস্তা-ঘাটে অবৈধ দোকান আর যানবাহন চালাচ্ছে। ফলে কৃষি শ্রমিকের মজুরী আকাশচুম্বী। ফলে দেশে উৎপাদিত ফসলের উৎপাদন খরচ বাড়ছে। তাই ভারতসহ বিভিন্ন দেশের স্বল্প মূল্যের কৃষিপণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। এভাবে চলতে থাকলে দেশের কৃষিখাত ধ্বংস হয়ে যাবে। অন্যদিকে, দেশে কৃষিভিত্তিক শিল্পের প্রয়োজনীয়তা ও চাহিদা ব্যাপক থাকা সত্তে¡ও তা গড়ে উঠছে না আগ্রহ ও অর্থায়নের অভাবে। তাতে কৃষির যেমন ক্ষতি হচ্ছে, তেমনি মানুষেরও ক্ষতি হচ্ছে। তাই দেশের কৃষি খাতকে রক্ষা করার জন্য অতি দ্রুত সবকিছুই আধুনিক ও কৃষিভিত্তিক শিল্প গড়ে তোলা আবশ্যক।
এখন দেখা যাক, দেশের পরিবেশের অবস্থা কী? কিছুদিন আগে প্রকাশিত জার্মানি ও সাইপ্রাসের গবেষকদের এক গবেষণা রিপোর্ট মতে, ‘২০১৫ সালে বায়ু দূষণের কারণে বিশ্বে বাড়তি ৮৮ লাখ মানুষ মারা গেছে।’ বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য অনুসারে, প্রতিবছর ধূমপানের কারণে বিশ্বে ৭০ লাখ মানুষ মারা যায়। তবে ধূমপান এড়ানো সম্ভব কিন্তু বায়ু দূষণ চাইলেই এড়ানো সম্ভব নয়। তাই জরুরি-ভিত্তিতে জীবাশ্ম জ্বালানি ব্যবহার বন্ধ করা দরকার। অপরদিকে, বেইজিংয়ের ফুয়াই হাসপাতালের এবং আমেরিকার এমোরি ইউনিভার্সিটির বিশেষজ্ঞরা ২০০৪-১৭ পর্যন্ত গবেষণা করে জানিয়েছেন, বায়ুতে দূষণ-সৃষ্টিকারী পিএম-২.৫ এর মাত্রা যত বাড়বে, ডায়াবেটিসের ঝুঁকিও সেই হারে বাড়বে। অর্থাৎ বায়ুদূষণ যেখানে যত বেশি, সেখানে ডায়াবেটিসে আক্রান্তের সংখ্যাও বেশি হবে। আর এক তথ্য মতে, তামাক ব্যবহারে যে লোক মারা যায়, তার চেয়ে বেশি মারা যায় বায়ু দূষণের কারণে। তবুও দেশের বায়ু দূষণের মাত্রা ভয়াবহ। এ ব্যাপারে স¤প্রতি জার্মান বাংলা বেতারে প্রকাশ, পরিবেশবাদী সংগঠন গ্রিনপিস ও যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক প্রতিষ্ঠান এয়ারভিজ্যুয়ালের ‘বিশ্ব বাতাসের মান প্রতিবেদন ২০১৮’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদন মতে, বিশ্বে বায়ুদূষণে বাংলাদেশের অবস্থান শীর্ষে। তবে রাজধানী হিসাব করলে ঢাকার অবস্থান দ্বিতীয়তে। আর শহরের হিসেবে ঢাকা আছে ১৭ নম্বরে। আর দেশের তালিকায় দ্বিতীয় ও তৃতীয় অবস্থানে আছে পাকিস্তান ও ভারত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা স্বাস্থ্য ঝুঁকি বিবেচনা করে বাতাসে ক্ষুদ্র কণিকার (পার্টিকুলেট ম্যাটার বা পিএম-২.৫) গড় মাত্রা প্রতি ঘনমিটারে সর্বোচ্চ ১০ মাইক্রোগ্রাম নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। কিন্তু ঢাকার বাতাসে এই কণিকার মাত্রা ২০১৮ সালে প্রতি ঘনমিটারে পাওয়া যায় ৯৭ দশমিক ১ মাইক্রোগ্রাম, যা নির্ধারিত মাত্রার চেয়ে প্রায় ১০ গুণ বেশি। তবে ২০১৭ সালে এই মাত্রা ছিল প্রতি ঘনমিটারে ৭৯ দশমিক ৭ মাইক্রোগ্রাম। যুক্তরাষ্ট্রের পরিবেশ বিষয়ক সংস্থা-ইপিআই’র রিপোর্ট-২০১৯ মতে, পরিবেশ সুরক্ষা (দূষণ রোধ) ১৮০টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১৭৯তম (২০১০-১০১৮ পর্যন্ত সময়ে ৪০ ধাপ পিছিয়েছে বাংলাদেশ)। এছাড়া, বিশ্বে বাংলাদেশ কৃষি জমি ও বনভূমি কমার হারে শীর্ষে, প্লাস্টিক দূষণে ১০ম ও ঢাকা পৃথিবীর দ্বিতীয় বায়ু দূষণের শহর। বিশ্বব্যাংকের ‘এনহ্যান্সিং অপরচুনিটিজ ফর ক্লিন অ্যান্ড রেসিডেন্ট গ্রোথ ইন আরবান বাংলাদেশ, কান্ট্রি এনভায়রনমেন্ট অ্যানালাইসিস ২০১৮’ শিরোনামের প্রতিবেদন মতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর পরিবেশ দূষণে মৃত্যুর হার ২৮%। আর এই হার বিভিন্ন দেশে ১৬%। শুধু পরিবেশ দূষণের কারণে বাংলাদেশে বছরে ৫২ হাজার কোটি টাকার ক্ষতি হয়, যা জিডিপির ৩% এর বেশি। বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলের চেয়ে শহরাঞ্চলে দূষণের মাত্রা বেশি।
বলা বাহুল্য, দেশে পরিবেশ সুরক্ষার অবস্থা খুবই বিপদজনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ ঘটানো অপরিহার্য। নতুবা উন্নতি যতই করা হোক না কেন, তা যদি পরিবেশ বান্ধব না হয়, তাহলে সে উন্নতি টেকসই হবে না। উন্নতির সব সুফল বিভিন্ন ব্যাধি খেয়ে ফেলবে। তাই নদী দখলের মতো পরিবেশ বিরোধী সব কর্মের বিরুদ্ধে অতি দ্রুত অভিযান পরিচালনা করা আবশ্যক সারাদেশেই। এছাড়া, প্রয়োজনীয় বনাঞ্চল গড়ে তোলা দরকার। জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহারের দিকে গুরুত্ব দেওয়া আবশ্যক। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ পরিবেশ সুরক্ষার দিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়েছে। তারা জীবাশ্ম জ্বালানির পরিবর্তে নবায়নযোগ্য জ্বালানি ব্যবহার শুরু করেছে। এমনকি জাতিসংঘ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থাও এ দিকে গুরুত্ব দিয়েছে। সাম্প্রতিক উদাহরণ হচ্ছে, কেনিয়ায় অনুষ্ঠিত জাতিসংঘ পরিবেশ সম্মেলনে ‘গ্লোবাল এনভায়রনমেন্ট আউটলুক’ নামে গবেষণা প্রতিবেদন প্রকাশ। গবেষণা প্রতিবেদনটি তৈরিতে ছয় বছর ধরে কাজ করেছেন ৭০টি দেশের ২৫০ জন গবেষক। প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিশ্বে প্রতি চার জনে একজন দূষণের কারণে মারা যাচ্ছে। এখনই এর বিরুদ্ধে রুখে না দাঁড়ালে সামনে ভয়াবহ বিপদ। কারণ, ‘বিশ্বে যত রোগ ও মৃত্যু তার প্রায় ২৫ ভাগের কারণ পরিবেশের দুরবস্থা’। এর মধ্যে সবচেয়ে ওপরে আছে বায়ুদূষণ। এর কারণে বছরে ৭০ লাখ মানুষের মৃত্যু হয়। এরপর পানি-দূষণ ও সুপেয় পানির অভাবে ডায়রিয়া ও অন্যান্য রোগে মারা যায় আরও ১৪ লাখ মানুষ। জরুরি পদক্ষেপ না নেয়া হলে ২০৫০ সালের মধ্যে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য ও আফ্রিকার আরও অসংখ্য মানুষ মারা যাবে। গরিব দেশগুলো বেশি ভুক্তভোগী হবে।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।