Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণে আইনের প্রয়োগ ও গণসচেতনতা জরুরি

মোহাম্মদ আবু তাহের | প্রকাশের সময় : ১৫ মার্চ, ২০১৯, ১২:০০ পিএম

ভোক্তা অধিকার আন্দোলনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। ভোক্তা আন্দোলনে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেন যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকবৃন্দ। ১৯৩০ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভোক্তাগণ ভোক্তা ইউনিয়ন নামে একটি সংগঠন গড়ে তোলেন। বাংলাদেশের ভোক্তা সাধারণের অধিকার নিশ্চিত করার দাবিও দীর্ঘদিনের। কনজুমার এসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) ও অন্যান্য সংগঠনের ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করার জন্য দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফলে সরকার ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ প্রণয়ন করে। সাধারণভাবে বলতে গেলে সকল মানুষই ভোক্তা। তবে ধনী বা স্বচ্ছল ভোক্তাদের প্রধান সমস্যা, পণ্যের গুণগতমান এবং গরিবদের প্রধান সমস্যা ভোগ্যপণ্যের মূল্য নিয়ে। ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষার জন্য যদি আইনের বাস্তবায়ন থাকে এবং ভোক্তারা যদি সচেতন থাকেন তাহলে সকল স্তরের ভোক্তাদের স্বার্থরক্ষার একটি সুযোগ থাকে। যে কোনো মানুষই কোনো না কোনো পণ্য ক্রয় করে থাকে। সে অর্থে সব মানুষই ভোক্তা। পণ্য কিনে কেউ যাতে প্রতারিত না হয়, সে জন্য বিদ্যমান আইনের বাস্তবায়ন জরুরি। যে কোনো আইনের যথাযথ প্রয়োগে রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে যেমন উদ্যোগ গ্রহণ জরুরি, তেমনি আইন ও অধিকার সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য সম্মিলিত সামাজিক উদ্যোগ গ্রহণ আরও বেশি জরুরি। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশংসনীয়। গণমাধ্যমের অসাধারণ ভূমিকার কারণে বাংলাদেশের ভোক্তাগণ ভেজাল সচেতন হচ্ছেন।
১৯৬২ সালের ১৫ মার্চ মার্কিন প্রেসিডেন্ট জন এফ কেনেডির উদ্যোগে মার্কিন কংগ্রেসে ক্রেতা-ভোক্তাদের চারটি অধিকার আইনী স্বীকৃতি লাভ করে, অধিকারগুলি এই: ১. নিরাপত্তার অধিকার, ২. তথ্য জ্ঞাত হবার অধিকার, ৩. ন্যায্যমূল্যে পণ্য বা সেবা পাওয়ার অধিকার এবং ৪. অভিযোগ করা ও প্রতিনিধিত্বের অধিকার। পরবর্তীতে ভোক্তা আন্দোলন সারা পৃথিবীতে ছড়িয়ে পড়লে জাতিসংঘ এ চারটি অধিকারের সঙ্গে আরও চারটি অধিকার যুক্ত করে। এ অধিকারগুলোই মূলত সারা বিশ্বে ভোক্তা আন্দোলনের ভিত্তি হিসেবে কাজ করছে। জাতিসংঘ কর্তৃক গৃহীত অন্য চারটি অধিকার হচ্ছে: ১. অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা ও বাসস্থানের মৌলিক চাহিদা পূরণের অধিকার, ২. কোনো পণ্য সেবা ব্যবহারে ক্ষতিগ্রস্থ হলে ক্ষতিপূরণ পাবার অধিকার, ৩. ক্রেতা ভোক্তা অধিকার সম্পর্কে শিক্ষা লাভের অধিকার এবং ৪. স্বাস্থ্যকর পরিবেশে বসবাস ও কাজ করার অধিকার। এ অধিকারগুলোর মধ্যে অনেকগুলো অধিকার বাংলাদেশের সংবিধানে মৌলিক অধিকার হিসাবে স্বীকৃত।
ভোক্তা কে? ১. যিনি, পুনঃ বিক্রয় ও বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য ব্যতীত সম্পূর্ণ মূল্য পরিশোধ করে বা সম্পূর্ণ বাকিতে পণ্য বা সেবা ক্রয় করেন। ২. আংশিক মূল্য পরিশোধ করে বা আংশিক বাকিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন। ৩. কিস্তিতে পণ্য অথবা সেবা ক্রয় করেন।
ভোক্তার দায়িত্ব: ১. ভোক্তার অধিকার ও দায়িত্ব সম্পর্কে জানা। ২. ভোক্তার অধিকার সংরক্ষণের সুফল সম্পর্কে জানা। ৩. ভোক্তার অধিকার বিরোধী কার্যের কুফল সম্পর্কে জানা। ৪. যাচাই-বাছাই করে সঠিক পণ্য বা সেবা সঠিক মূল্যে কেনা। ৫. ভোক্তার অধিকার বাস্তবায়নে সংগঠিত ও সোচ্চার হওয়া এবং অভিযোগ দায়ের করা। বিক্রেতা কে? কোনো পণ্যের উৎপাদকারী বা প্রস্তুতকারী, সরবরাহকারী, পাইকারী বিক্রেতা, খুচরা বিক্রেতা।
ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্য ও অপরাধ কী কী? ১. নির্ধারিত মূল্য অপেক্ষা অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা। ২. জেনে শুনে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা। ৩. স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকারক নিষিদ্ধ দ্রব্য কোনো খাদ্য পণ্যের সাথে মিশ্রণ ও বিক্রয় করা। ৪. মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা। ৫. প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা। ৬. ওজনে কারচুপি করা। ৭. বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি করা। ৮. পরিমাপে কারচুপি করা। ৯. দৈর্ঘ্য পরিমাপক ফিতা বা অন্য কিছুতে কারচুপি করা। ১০. কোনো নকল পণ্য বা ঔষধ প্রস্তুত বা উৎপাদন করা। ১১. মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা। ১২. নিষিদ্ধ ঘোষিত কোনো কার্য করা যাতে সেবাগ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্ন হতে পারে। ১৩. অবৈধ প্রক্রিয়ায় পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়াকরণ করা। ১৪. অবহেলা, দায়িত্বহীনতা দ্বারা সেবা গ্রহীতার অর্থ স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ইত্যাদি ঘটানো। ১৫. কোনো পণ্য মোড়কবদ্ধভাবে বিক্রয় করার এবং মোড়কের গায়ে পণ্যের উৎপাদনের তারিখ সর্বোচ্চ খুচরা বিক্রয়মূল্য, মেয়াদ উত্তীর্ণের তারিখ ইত্যাদি লিপিবদ্ধ করার বাধ্যবাধকতা লঙ্ঘন করা। ১৬. আইনানুগ বাধ্যবাধকতা অমান্য করে দোকান বা প্রতিষ্ঠানে সহজ দৃশ্যমান কোনো স্থানে পণ্যের মূল্য তালিকা লটকিয়ে প্রদর্শন না করা।
ভোক্তা অধিকার বিরোধী কার্য ও অপরাধ এবং দণ্ড:
ক. অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডযোগ্য অপরাধ: ১. পণ্যের মোড়ক ব্যবহার না করা বা মোড়কের গায়ে সর্বোচ্চ বিক্রয় মূল্য, মেয়াদ উর্ত্তীণের তারিখ, ইত্যাদি লেখা না থাকা। ২. পণ্য ও সেবার মূল্য তালিকা সংরক্ষণ ও লটকিয়ে প্রদর্শন না করা। ৩. নির্ধারিত মূল্যের অধিক মূল্যে কোনো পণ্য, ঔষধ বা সেবা বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা। ৪. প্রতিশ্রুত পণ্য বা সেবা যথাযথভাবে বিক্রয় বা সরবরাহ না করা। ৫. ওজনে, বাটখারা বা ওজন পরিমাপক যন্ত্রে কারচুপি করা। ৬. পরিমাপে, দৈর্ঘ্যে পরিমাপকে কারচুপি করা এবং মেয়াদ উত্তীর্ণ পণ্য বা ঔষধ বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা।
খ. অনধিক ১ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ২ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডযোগ্য অপরাধ: মিথ্যা বিজ্ঞাপন দ্বারা ক্রেতা সাধারণকে প্রতারিত করা।
গ. অনধিক ২ বছর কারাদণ্ড বা অনধিক ১ লক্ষ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডযোগ্য অপরাধ: অবৈধ প্রক্রিয়ার পণ্য উৎপাদন বা প্রক্রিয়া করণ করা।
ঘ. অনধিক ৩ বছর করাদণ্ড বা অনধিক ৫০ হাজার টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডযোগ্য অপরাধ: ভোক্তা কর্তৃক মিথ্যা বা হয়রানীমূলক মামলা দায়ের করা।
ঙ. অনধিক ৩ বছর কারদণ্ড বা অনধিক ২ লক্ষ টাকা অর্থ দণ্ড বা উভয় দণ্ডযোগ্য অপরাধ: ১. জেনে শুনে ভেজাল মিশ্রিত পণ্য বিক্রয় বা বিক্রয়ের প্রস্তাব করা। ২. খাদ্য পণ্যে ক্ষতিকর নিষিদ্ধ দ্রব্য মিশ্রণ বা বিক্রয় করা। ৩. পণ্যের নকল প্রস্তুত বা উৎপাদন করা। ৪. সেবা গ্রহীতার জীবন বা নিরাপত্তা বিপন্নকারী কার্য করা। ৫. অবহেলা, দায়িত্বহীনতা দ্বারা সেবাগ্রহীতার অর্থ, স্বাস্থ্য বা জীবনহানি ইত্যাদি ঘটানো।
ভোক্তা আইন সংশোধন করার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানা গেছে। এ উদ্যোগ নিঃসন্দেহে প্রশংসনীয়। সংশোধিত এ আইন মহান জাতীয় সংসদে পাস হলে আদালতে যেতে পারবেন ভোক্তারা। পণ্যে ভেজাল ও বিক্রিতে ক্রেতার সঙ্গে প্রতারণায় শুধু বিক্রেতাকেই শাস্তি দেয়া হতো। এখন উৎপাদনকারী ও আমদানিকারককে শাস্তির বিধান রেখে ভোক্তা অধিকার আইন ২০০৯ সংশোধন করে ২০১৮ খসরা তৈরি করা হয়েছে।
লেখক: ব্যাংকার, গবেষক ও কলামিস্ট



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভোক্তার অধিকার
আরও পড়ুন