পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
‘যার যা প্রাপ্য’ বলে একটা কথা আছে। ৯ মার্চ হজরত মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর জন্ম দিবস উপলক্ষে বাক্যটির তাৎপর্য ব্যাখ্যা করা প্রয়োজন। কেননা, তাঁর যা পাওনা ছিল, নিঃসন্দেহে তিনি তা পেয়েছেন। কীভাবে পেয়েছেন তাই বিচার্য। বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আলহাজ হজরত মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) তাঁর কর্ম জীবনের সবটাই উৎসর্গ করে দিয়েছিলেন দেশের মাদরাসা শিক্ষা তথা ইসলামী শিক্ষার উন্নয়ন ও বিস্তারে। অবহেলিত, উপেক্ষিত এবং অধিকার বঞ্চিত মাদরাসা শিক্ষকদের জীবন-মান ও ভাগ্যোন্নয়ন এবং আলেম সমাজের মর্যাদা বৃদ্ধি ও জন কল্যাণে তিনি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতার বইরে ও ভেতরে থেকে আত্মনিয়োগ করেছিলেন এবং প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে বহুমাত্রিক যেসব অবিস্মরণীয় অবদান রেখে গেছেন সেগুলোর মধ্যে সবচেয়ে স্মরণীয় ও উল্লেখযোগ্য হচ্ছে, মুসলিম দুনিয়ার সর্ববৃহৎ মাদরাসা শিক্ষকদের একক ও অরাজনৈতিক ঐতিহ্যবাহী সংগঠন ‘বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীন’ এর পুনর্গঠন ও তাকে শক্তিশালী প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। তিনি এ ঐতিহাসিক সংগঠনের সুদক্ষ ও দূরদর্শী সভাপতি হিসেবে এক দিকে যেমন মাদরাসা শিক্ষার অস্তিত্বসংকট কাটিয়ে তার নিরাপত্তা নিশ্চিত করেছেন এবং বিশে^র দরবারে আদর্শিক প্রতিষ্ঠানে পরিণত করেছেন, তেমনি একাধারে তিন দশক ধরে তাগুতি শক্তির বিরুদ্ধে লড়াইও করেছেন। জমিয়াতকে সঙ্গে নিয়ে তিনি সকল অন্যায়, পাপাচারের বিরুদ্ধে ছিলেন সোচ্চার। তিনি ‘মসজিদে গাউসুল আজম’ প্রতিষ্ঠা করে তার খতিব হিসেবে সকল অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে ইসলামের বাণী প্রচার করে গেছেন এবং ‘দৈনিক ইনকিলাব’ প্রতিষ্ঠা করে তা এ দেশের আলেম সমাজ, দেশ ও জাতির খেদমতে রেখে গেছেন। এ সবই হল তাঁর প্রাপ্তির উৎস।
ইজ্জত-আব্রæ, মান-সম্মান সবই আল্লাহর দান। তিনি যাকে ইচ্ছা তাকে দান করেন। মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) ছিলেন এমনি এক ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব, যার পাওনা ছিল এ মর্যাদা-সম্মান এবং জীবনে তা তিনি পেয়েছেনও ব্যাপকভাবে। ওফাতের পরেও ‘ইসালে সাওয়াব’ আকারে দেশি-বিদেশি আলেম সমাজ এবং মুসলমানদের পক্ষ হতে ভক্তি, শ্রদ্ধা ও খতমে কোরআনের মাধ্যমে যা পেয়েছেন সে সবই তাঁর প্রাপ্য ছিল এবং পেয়েছেন। ‘ইসালে সাওয়াব’ হিসেবে দেশে-বিদেশে তাঁর জন্য হাজার হাজার কোরআন খতম ও দোয়া-ইসতেগফার অনুষ্ঠিত হয়েছে। অসংখ্য শোকবাণীর কথা বাদ দিলেও জমিয়াতভুক্ত মাদরাসা এবং বহু মসজিদে তার বিদেহী আত্মার প্রতি সাওয়াব রেসানির জন্য কোরআন খতমের যে ধারা জারি হয়েছিল, তা বিস্মৃত হওয়ার নয়। তাছাড়া প্রতি বছরই তাঁর ওফাত বার্ষিকীতে ইসালে সাওয়াবের অনুষ্ঠানাদিতে তাঁর রূহের মাগফেরাত কামনা করা হয়। জীবদ্দশায় তাকে সম্মাননা প্রদানের যে ধারা লক্ষ্য করা গিয়েছে পরবর্তী বর্ণনায় তার ইঙ্গিত রয়েছে।
মাওলনা এম. এ. মান্নান (রহ.) জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের একজন দীর্ঘস্থায়ী সফল সভাপতি হিসেবে আলেম সমাজে মর্যাদার যে আসন লাভ করেছিলেন তার প্রতিফলন দেখা যায় নানাভাবে। তাঁর প্রতি অগাধ আস্থা-বিশ^াস এবং মাদরাসা শিক্ষকদের আশা ভরসার কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে তাদের যে কোনো সমস্যার কথা তারা বিনা সংকোচে পেশ করতে পারতেন। তিনিও আন্তরিকতা ও নিষ্ঠার সাথে সংকট সমাধানের চেষ্টার ত্রæটি করতেন না। তাই দেখা যায়, মাওলানা এম. এ. মান্নান যখন কোন মাদরাসা পরিদর্শনে গমন করতেন, ছাত্র-শিক্ষক সবাই তাকে বিপুলভাবে স্বাগত জানিয়েছে, অভিনন্দিত করেছেন এবং প্রাণঢালা সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেছেন। তাঁর প্রতি সকলের এ ভক্তি, ভালবাসার মর্যাদা প্রদানেও তিনি কুণ্ঠিত হননি। তাকে বহু মাদরাসা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে সম্মাননা প্রদানের নেপথ্যে সক্রিয় ছিল শিক্ষক সমাজের দাবি-দাওয়ার প্রতি জমিয়াত প্রধানের দৃষ্টি নিবদ্ধ করা, মাওলানা এম. এ. মান্নানও তা গুরুত্ব সহকারে বিবেচনায় রাখতেন।
এ পর্যায়ে ব্যক্তিগত প্রত্যক্ষদর্শী হিসেবে একটি ঘটনা মনে পড়ে। বনানীস্থ আমতলী জমিয়াত অফিসে প্রথমবারের মতো যখন গমনের সুযোগ হয়, তখন অফিসের চতুর্দিকে সাজানো কাচে বাঁধাই করা অভিনন্দনগুলোর প্রতি দৃষ্টি পড়ে, গুণে দেখলাম শতাধিক। বাংলা, আরবি, উর্দুতে লেখা ছোট, বড়, মধ্য আকারের এসব মানপত্র দেখলে অবাক না হয়ে পারা যায় না। মাওলানা সাহেব জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কতটি গুণলেন?’ বলালাম ‘শতাধিক।’ তিনি বললেন; ‘আরও অনেক আছে, স্থানাভাবে এখানে টানানো সম্ভব হয়নি, অন্যত্র একাট্টা করে রাখা হয়েছে।’ তিনি আরও জানালেন, বিভিন্ন মাদরাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিদর্শনে যেতে হয়, এ উপলক্ষে ভক্ত, শিক্ষক-ছাত্র, কমিটি তথা কর্তৃপক্ষের পক্ষ হতে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন ও মানপত্র প্রদান করা হয় এবং তারা তাদের নানা সমস্যার কথা তুলে ধরেন ও বিভিন্ন ধরনের দাবি দাওয়া পেশ করে থাকেন, তাদের যৌক্তিক দাবি-দাওয়া ও চাহিদার কথা আলাদাভাবে নোট করে রাখা হয় এবং সেগুলোর যথাসময়ে সুরাহা করার চেষ্টা করা হয়। আর যেসব চাওয়া-পাওয়ার বিষয় সরকারের সাথে সম্পৃক্ত, সেগুলো নিয়মতান্ত্রিকভাবে সরকারের কাছে উপস্থাপন করা হয়। তিনি আরও জানালেন, প্রদত্ত মানপত্রগুলোর লেখক, উপস্থাপক, শিক্ষক-ছাত্র সবাই অন্তর্ভুক্ত। তাতে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি ও মনোভাব জানা যায়। এসব মানপত্রের ভাষা বাংলা ছাড়াও উর্দু, আরবিতেও হয়ে থাকে।
জমিয়াতের আমতলী অফিস স্থানান্তরিত হয়ে মহাখালী মসজিদে গাউসুল আজম কমপ্লেক্সে নিজস্ব অফিসে আসার পর সভাপতি হিসেবে হজরত মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) দীর্ঘকাল এখান থেকেই জমিয়াতের যাবতীয় কর্মকান্ড পরিচালনা করতে থাকেন। এ সময় জমিয়াতের সাংগঠনিক তৎপরতা বৃদ্ধির সাথে সাথে এর অন্তর্ভুক্তি হতে থাকে আরও বিপুল সংখ্যক নানা স্তরের মাদরাসা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এ সময়ও জমিয়াত প্রধান মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর মাদরাসা পরিদর্শন কর্মসূচি থেমে থাকেনি এবং বহু শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পক্ষ হতে মানপত্র প্রাপ্তির ধারাও অব্যাহত থাকে। আর এর সংখ্যা যে পূর্বের তুলনায় বহুগুণে বেশি তা বলাই বাহুল্য। মাওলানা সাহেবের প্রাপ্ত সকল মানপত্রের সঠিক সংখ্যা যেমন জানা নেই, তেমনি সকল মানপত্র সযত্নে সংরক্ষিত আছে কিনা তাও এ লেখকের জানা নেই। এসব মানপত্র সঠিকভাবে গবেষণা করা হলে এ দেশে ইসলামী শিক্ষার প্রচারসহ নানাবিধ গুরুত্বপূর্ণ তথ্য উপাত্ত অজানা থেকে জানা জগতে আসতে পারে।
জমিয়াত প্রধান হিসেবে একটানা তিন দশক মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর যোগ্য নেতৃত্বে সংগঠন পরিচালিত হতে থাকে। সাংগঠনিক তৎপরতা হোক কিংবা পরিদর্শন হোক, হাজার হাজার মাদরাসা শিক্ষক প্রতিষ্ঠান পরিদর্শন-পর্যবেক্ষণের সুযোগ তিনি পেয়েছিলেন এবং অধিকাংশ ক্ষেত্রেই মাদরাসা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ হতে তিনি সম্বর্ধিত হয়েছেন এবং অভিনন্দন ও মানপত্র প্রাপ্ত হয়েছেন। দেশের আলেম সমাজের আস্থাভাজন, বিশ^স্থ এবং অতিপ্রিয় ব্যক্তিত্ব হিসেবে মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) তাদের সকলের ভালবাসার এবং ঐক্যের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত হয়েছিলেন। তাই দেখা যায়, তিনি যখন কোনো মাদরাসা পরিদর্শনে গমন করতেন তখন সকল মতাদর্শের শিক্ষক, আলেম তাকে প্রাণঢালা খোশামদেদ জ্ঞাপন করতেন এবং বিনা সংকোচে তাদের আবদার পেশ করতেন। তাকে প্রদত্ত মানপত্রগুলো তারই প্রকৃষ্ট প্রমাণ।
ছোট, বড়, মাঝারি তথা নানা আকার-আকৃতির ও বিভিন্ন ভাষায় রচিত এবং জমিয়াত প্রধানকে প্রদত্ত অভিনন্দন পত্রের সমাহার দেখলে একদিকে যেমন এসব দ্বীনী প্রতিষ্ঠানের ইতিহাস, ঐতিহ্য এবং পরিবেশ-পরিস্থিতি সংক্রান্ত গুরুত্বপূর্ণ তথ্যাবলি অবগত হওয়া যায়, তেমনি অপরদিকে সেগুলোতে বিদ্যমান নানা সমস্যা-সংকটের চিত্রও জানা সম্ভব হয়ে উঠে এবং বিরাজমান সকল সমস্যার সমাধানের আশা-ভরসার নির্ভরযোগ্য মাধ্যম হিসেবে মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.)-কেই দেখতে পাওয়া যায়।
এখানে মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.)-কে প্রদত্ত সর্বশেষ ‘সম্মাননা’র তথ্যটি তুলে ধরতে চাই। যা নি¤œরূপ: ‘জাতীয় সীরাত কমিটি বাংলাদেশ’ নামক সংস্থার পক্ষ হতে ‘২০০৪ সালের ২৫ মে, শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ব আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান ১৪২৫ হিজরী’ শিরোনামে যে সম্মাননা প্রদান করা হয় তার মাত্র দুই বছর পর (২০০৬ সালে) মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) ইন্তেকাল করেন। তাঁর জীবনের এটি ছিল সর্বশেষ ‘সম্মাননা’। রঙিন সুসজ্জিত মসজিদের ছবি সম্বলিত সুন্দর মোড়ক, দ্বিতীয় পৃষ্ঠায় জাতীয় সীরাত কমিটি পরিচিতি এবং তৃতীয় ও চতুর্থ পৃষ্ঠাব্যাপী আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর ‘জীবন ও কর্ম’ শীর্ষক বিশেষ প্রবন্ধ স্থান পায়। ইনার পৃষ্ঠায় আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর তিন কলামী রঙিন ছবি এবং পরবর্তী চার পৃষ্ঠা ব্যাপী মাওলানা সাহেবের ‘কিছু ঐতিহাসিক মুহূর্তের স্মরণীয় আলোকচিত্র’।
জাতীয় সীরাত কমিটির বক্তব্যের শেষ ভাগে বলা হয়: ‘কমিটি চিন্তা-গবেষণার মাধ্যমে দেশের অন্যতম শ্রেষ্ঠ আলেমে দ্বীন, বাংলাদেশ জমিয়াতুল মোদার্রেছীনের সভাপতি, দৈনিক ইনকিলাবের প্রতিষ্ঠাতা ও ব্যবস্থাপনা পরিচালক, আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব, সাবেক মন্ত্রী আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.)-কে চলতি ১৪২৫ হিজরী সালের শ্রেষ্ঠ ইসলামী ব্যক্তিত্ব পুরস্কার প্রদান করার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। সেই মোতাবেক আজ ২৯ রবিউল আউয়াল ১৪২৫ হিজরী ২০ মে ২০০৪, ঈসায়ী বৃহস্পতিবার ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনিস্টিটিউট মিলনায়তনে মুহতারাম মাওলানাকে এই সম্মাননা পুরস্কারে ভ‚ষিত করা হচ্ছে।’
প্রবন্ধের শেষে বলা হয়: ‘বহুমুখী গুরুদায়িত্ব পালন এবং দীর্ঘদিন যাবত অব্যাহত চিন্তা ও তৎপরতার মাধ্যমে আলহাজ¦ মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) দেশ ও জাতিকে দিয়েছেন অনেক কিছু। সে সবের প্রকৃতরূপ তুলে ধরার ও যথার্থ মূল্যায়নের দায়িত্ব আগামী দিনের জাতীয়, সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসের রূপকারগণের। এই মহান আলেমে দ্বীনকে জাতীয় সীরাত কমিটি ১৪২৫ হিজরীর সেরা ইসলামী ব্যক্তিত্ব হিসাবে নির্বাচন করতে পেরে গৌরবান্বিত।’
স্মরণযোগ্য যে, মাওলানা এম. এ. মান্নান (রহ.) এর জন্ম ১৯৩৫ সালের ৯ মার্চ বলে অনেকের লেখা হতে জানা যায়। প্রকৃতপক্ষে তা হবে ১৯৩৩ সালের ৯ মার্চ। এ তথ্য দৈনিক ইনকিলাব ‘স্মরণীয় দিবসসমূহের তালিকা’য় প্রদত্ত হয়েছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।