মাত্র ৪৮ ঘণ্টায় দেউলিয়া হলো যুক্তরাষ্ট্রের ২য় বৃহত্তম ব্যাংক
চলতি সপ্তাহের বুধবারও আর দশটি সাধারণ ব্যাংকের মতো বাণিজ্যিক ও আর্থিক লেনদেন সম্পন্ন করেছে যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালি ব্যাংক (এসভিপি), যা দেশটির দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক ব্যাংক
সময় ভোর পৌনে ছটা। তখনো সূর্য ওঠেনি, মসজিদগুলোতে ধ্বনিত হয়নি ফজরের আজান। কিন্তু ‘ফ্যাট টুয়েসডে’র লাইন দীর্ঘ হয়ে তখন দোকানের দরজা ছাড়িয়ে বাইরের রাস্তায় ঠেকেছে। শীতার্ত অপেক্ষার শেষে মেলে পুরস্কার, খদ্দেররা হাতে পান ‘ফ্যাট টুয়েসডে’র এক বাক্স পাজকি (উচ্চারণ করা হয় পন-চকি)। পাজকি হচ্ছে এক ঐতিহ্যবাহী পোলিশ খাবারÑ কাস্টার্ড বা ফল বা কোকোয়ার পুর দেয়া গোলাপি রঙের পোলিশ পেস্ট্রি। মিশিগানের হ্যামট্রামক শহর ছিল প্রধানত পোলিশ অভিবাবসীদের শহর। আজ তারা কয়েকজন মাত্র আছে এ শহরে, বাকিরা অন্যত্র চলে গেছে। কিন্তু রয়ে গেছে তাদের ঐতিহ্যবাহী অতি সুস্বাদু খাবার পাজকি। স্থানীয় বাসিন্দাদের কাছে কয়েক প্রজন্ম ধরেই পাজকি ডে এক আনন্দপূর্ণ দিন। শুধু এ ‘ফ্যাট টুয়েসডে’তেই পাওয়া যায় লোভনীয় পাজকি।
এদিনের শুরু সে সময়ে যখন মোটামুটি দু’বর্গমাইল আয়তনের এ বসতিটির অধিকাংশ মানুষই ছিল পোল্যান্ড থেকে আসা অভিবাসী। প্রায় চারদিকই ডেট্রয়েট শহর বেষ্টিত এ ছিটমহলে পোলিশরা আসত চাকুরির সন্ধানে এবং নিজেদের মাতৃভাষায় কথা বলার জন্য।
সাম্প্রতিক কয়েকটি দশকে হ্যামট্রামকের অনেক পরিবর্তন ঘটেছে। এখন আছে হালাল পণ্যের গ্রোসারি শপ। দোকানগুলোর সামনে আরবি বা বাংলায় বিভিন্ন ডিসপ্লে দেখা যায়। একটি প্রধান রাস্তার সম্মানসূচক নাম ‘বাংলাদেশ এভিনিউ।’ ২০১৫-র নির্বাচনের পর হ্যামট্রামক সিটি কাউন্সিল দেশের প্রথম মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ সিটি কাউন্সিল হয়েছে। এ বিষয়টি অনাকাক্সিক্ষতভাবে মিডিয়ার কাছে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে ওঠে। কিছু সমালোচনাকারী সামাজিক মাধ্যম কয়েক দশক আগে চলে যাওয়া সাবেক অধিবাসীদের আক্ষেপকে প্রকাশ করে।
তবে সবরকম পরিবর্তন সত্তে¡ও পাজকি ডে’র আকর্ষণ কমেনি, বরং তা দিনব্যাপী উপভোগ্য একটি দিনের রূপ পেয়েছে। একটি বিখ্যাত বেকারি তো এদিন ভোর ৩টায় খোলে। স্থানীয় ব্যবসায়ীরা পাজকি বার্গার ও লিকার সমন্বিত ‘পাজকি বোমা’ সরবরাহ করে। এমনকি আগে পোলিশ দোকান, বর্তমানে হালাল খাবার বিক্রিকারী ইয়েমেনি মালিকানাধীন দোকানও এ পেস্ট্রি বিক্রি করে।
যারা কখনো হ্যামট্রামক (উচ্চারণ হ্যাম-ট্রাম-ইক) থেকে চলে যাননি তাদের এবং অতি সম্প্রতি আসা লোকজনের জন্য দিনটি হয়েছে মিষ্টি খাবার একটি বড় সুযোগের দিন। তারা দিনটির নাম দিয়েছেন পাজকি ডে।
হ্যামট্রামকের মহিলা মেয়র পোলিশ-আমেরিকান কারেন মাজেউস্কি বলেন, শহরের মানুষের সহাবস্থান সুন্দর। যদি তারা পরস্পরের সাথে মানিয়ে নিতে না পারত তাহলে তারা শহরতলির দিকে চলে যেত। তিনি বলেন, কোনো কোনো সময় লোকে অভিযোগ করে। একই সাথে তারা বলে, তারা প্রতিবেশিদের সাথে একসঙ্গে থাকবে। তাই এ ব্যাপারে আমার আসলে কোনো উদ্বেগ নেই।
পোলিশ-ভাষার রেডিও স্টেশন আছে হ্যামট্রামকে। শহরে আজ এত পরিবর্তন ঘটেছে যে সেখানে স্টোরগুলোর উইন্ডোতে হিজাব প্রদর্শন করা হয়। এর শুরু হয়েছিল ২০০৪ সালে যখন একটি মসজিদকে মাইকে আজান দেয়ার অনুমতি দেয়া হয়। মিজ মাজেউস্কি বলেন, ঐ সময় একজন ডেমোক্র্যাট দলীয় কাউন্সিলর এ অনুমোদন দেয়ায় ভ‚মিকা রাখেন।
তিনি বলেন, কিছু বাসিন্দা এর বিরুদ্ধে আপত্তি করায় ও সংবাদপত্রের লোকজন এটা নিয়ে খবর তৈরির জন্য এলে তিনি দুঃখিত হয়েছিলেন। তিনি আজানকে শহরের নানা শব্দের অংশ বলে আখ্যায়িত করেন। বিভিন্ন দেশ, বিভিন্ন সংস্কৃতি, বিভিন্ন ভাষাভাষী হ্যামট্রামকের মুসলিম বাসিন্দারা আজানের অনুমতিকে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা বলে মনে করেন।
আশির দশকে বাংলাদেশ থেকে অভিবাসী হয়ে আসা আনাম মিয়া বলেন, এটা লোকজনের মধ্যে এ দেশকে নিজের দেশ বলে, নিজেদের এখানকার মানুষ বলে উপলব্ধি সৃষ্টি করেছে।
তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে জনসংখ্যাগত পরিবর্তন ঘটেছে। নতুন অভিবাসীরা এসেছে, বিশেষ করে এসেছে বাংলাদেশ ও ইয়েমেন থেকে। পোলিশ বাসিন্দারা এখান থেকে চলে গেছে। গত কয়েক বছর ধরে ডেট্রয়েটের মূল শহরে জনসংখ্যা বেড়েছে, নানা দেশের তরুণরা এখানে এসেছে সস্তা বাসস্থানের আশায়। তারা তাদের সাথে কফিশপ নিয়ে এসেছে।
সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য মোতাবেক, ২০১৭ সালে হ্যামট্রামক-এর জনসংখ্যার মাত্র ৭ শতাংশ ছিল পোলিশ বংশোদ্ভ‚ত। কিন্তু পর্যটকরা এখনো পোলিশ আর্ট সেন্টার পরিদর্শন করেন, পোলোনিয়া রেস্টুরেন্টে পাইরোগিখান বা পোলিশ লিজিয়ন অব আমেরিকান ভেটেরান পোস্টে পাজকি খাওয়া প্রতিযোগিতা দেখেন। গত মঙ্গলবার অনুষ্ঠিত এ প্রতিযোগিতায় বিজয়ী প্রতিযোগী সোয়া ৮টি পেস্ট্রি উদরস্থ করেন। (২০১৫ সালের প্রতিযোগিতায় বিজয়ী খেয়েছিলেন ২৩টি পেস্ট্রি।
পোলিশ-আমেরিকান গ্রেগ কোয়ালস্কি (৬৮) বরাবর হ্যামট্রামকেই আছেন। তিনি স্থানীয় জাদুঘরটি পরিচালনায় সাহায্য করেন। এ জাদুঘরে নতুন রং করা ম্যুরালগুলো শহরের প্রথম দিকের পোল ও ইউক্রেনীয়দের; মধ্য বিশ শতকে বসনীয়দের এবং সাম্প্রতিক দশকগুলোতে ইয়েমেনি ও বাংলাদেশি অভিবাসীদের তুলে ধরে। তিনি বলেন, এ শহর হচ্ছে এক চিত্তাকর্ষক জীবন নাট্যমঞ্চ।
অনেক বছর ধরেই এ শহরে সাংস্কৃতিক ভুল বোঝাবুঝি ও সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। কিছু অধিবাসী অপর গ্রæপগুলোর বস্তাপচা নিষ্পত্তি রীতি বা নিকটস্থ মসজিদের আজানের শব্দের মাত্রা বা তাদের ভাষায় মুসলিম শহর-কর্মীদের স্বল্পতা নিয়ে অভিযোগ করেছেন।
তবে শহরের নানা কিসিমের মানুষের বেশি ক্ষোভের কারণ হচ্ছে বাইরের লোকদের কাছে তাদের শহর সম্পর্কে ধারণা ও চিত্রটি। বাংলাদেশ থেকে আসা অভিবাসী নাজ হুদা (৩৬) বলেন যে একমাত্র যে বিষয়টি আমাকে আহত করে তা হচ্ছে লোকে যখন হ্যামট্রামক-কে সন্ত্রাসীদের শহর বা মুসলিম পরিচালিত শহর বলে। আমি এটা ঘৃণা করি। এখানে যারা আছে তারা আমেরিকান। তারা নির্বাচনে জয়ী হয়।
একটি মুসলিম প্রধান সিটি কাউন্সিলের নির্বাচনের পর কিছু লোক বলেছে যে সাংবাদিকরা তাদের কথা ফাঁস করার আগে তারা এসব লোকের ব্যাপারে কিছুই জানত না। সাংবাদিকরা তাদের ব্যাপারে লেখালেখি করার পর বিশ^দৃষ্টি পড়েছে এ শহরের উপর।
ওয়াশিংটন পোস্টের সাংবাদিক এ শহর পরিদর্শন করেছেন। এসেছেন কয়েকটি ইউরোপীয় দেশের সাংবাদিকও। এসেছে ফক্স নিউজও যারা ২০১৬ সালে সংবাদ শিরোনাম করে যাতে বলা হয় যে হ্যামট্রামক এখন প্রায় সম্পূর্ণ মুসলিম অধ্যুষিত শহর।
ফক্স নিউজের এক উপস্থাপক একজন সাংবাদিককে প্রশ্ন করেন, মানুষের পরিচয় জানতে বোরকা দ্রæত সাহায্য করে। আপনি কি রাস্তায় প্রচুর বোরকা দেখছেন? তিনি এ প্রশ্ন দিয়ে সারা শরীর ঢাকা কিছু মুসলিম মহিলার দিকে ইঙ্গিত করেন। সাংবাদিক জবাব দেন, আমরা তাদের দেখেছি। অবশ্যই।
হ্যামট্রামক-এ বেড়ে উঠেছেন ও কয়েক বছর আগে চলে গেছেন এমন এক ব্যক্তি এড ওলিনিয়েক (৬০) বলেন, যারা শৈশব থেকে তার পরিচিত ছিলেন তারা এ শহর থেকে চলে গেছেন। বর্তমান নেতৃত্ব সম্পর্কে তার ধারণা ভালো নয়। তিনি এক বার্ষিক পথ-উৎসবে বিয়ার ও পর্ক সসেজের কথা উল্লেখ করে বলেন, এটা পরিষ্কার যে এখানো শারিয়া আইন নেই। এ দুটির কোনোটিই মুসলমানরা খায় না।
বলার অপেক্ষা রাখে না যে হ্যামট্রামক-এ নানা সমস্যা আছে। সেন্সাস ব্যুরোর তথ্য মোতাবেক শহরের ২২ হাজার বাসিন্দার অর্ধেক দারিদ্র্যের মধ্যে বাস করে। তাদের জন্য পৌর কর্তৃপক্ষের কোনো পরিকল্পিত কর্মসূচি নেই। শহরের সীমানার দু দিক জুড়ে থাকা জেনারেল মোটরসের কারখানা জানুয়ারিতে বন্ধ হয়ে যাবে। যেখানে সরকারি সেবা এমনিতেই ক্ষীণ সেখানে এ ঘটনা শহরের রাজস্ব আয়ের ক্ষেত্রে এক বড় রকম বিপর্যয়।
পাজকির সময় যখন অধিকাংশ পার্কিং স্পট ভাড়া হয়ে যায় , বারগুলো থেকে পোলকা সঙ্গীত ভেসে আসে, তখন এক ধরনের আশাবাদ জেগে ওঠে। যারা এ শহরে আছেন তারা বলেন, তারা একসাথে বাস করা, পরস্পরের সাথে ঘনিষ্ঠতা, কয়েক দশক আগে আসা পোলিশ অভিবাসী এবং সম্প্রতি মধ্যপ্রাচ্য ও এশিয়া থেকে আসা নতুন অভিবাসীদের সমান্তরালে দেখতে চান।
মেয়র মাজেউস্কি বলেন, ১শ’ বছরে আমি আসলে হ্যামট্রামক-এর পরিচয়ের পরিবর্তন হতে দেখিনি। আর পরিবর্তন হবে বলেও মনে করি না। শুধু ভারসাম্য ও সংখ্যার পরিবর্তন হতে যাচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।