Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

ভারতের আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্প

প্রকাশের সময় : ১৮ মে, ২০১৬, ১২:০০ এএম

প্রতিবেশীর বৈরী পানিনীতি এবং ফারাক্কার কারণে এককালের প্রমত্তা পদ্মায় যখন শুধুই হাহাকার তখন ভারতের পানিসম্পদমন্ত্রী উমা ভারতী বলেছেন, সরকার গঙ্গা, ব্রহ্মপুত্রসহ বিভিন্ন নদীর পানি প্রবাহ ভিন্ন খাতে সরিয়ে নিতে যাচ্ছে। বিবিসিকে তিনি জানিয়েছেন, নদীর পানি অন্যদিকে প্রবাহিত করার জন্য আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্পের আওতায় ৩০টি সংযোগের পরিকল্পনা রয়েছে। দেশটির পরিবেশবাদীরা এ উদ্যোগের বিরোধিতা করেছেন। তাদের অভিযোগ, এটি পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। এ প্রকল্প সম্পর্কে ভারতের সমালোচকরা বলছেন, অর্থনৈতিক, সামাজিক ও পরিবেশগত দৃষ্টিকোণ থেকে আন্তঃনদীসংযোগ প্রকল্প বাস্তবায়নযোগ্য নয়। এছাড়াও সরকারের বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, প্রকল্পটি যথাযথ পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণ ছাড়াই পরিবেশগত ছাড়পত্র নেয়া হয়েছে। পরিবেশবাদী সংগঠন সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক ফর ড্যাম, রিভার অ্যান্ড পিপলের হিমাংশু ঠাক্কার বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত বাস্তবতায় এ প্রকল্প আরো কঠিন হয়ে উঠছে। কারণ, এ প্রকল্পের ফলে নদীর স্বাভাবিক গতিপথের কী অবস্থা হবে আপনি তা জানেন না। তিনি আরো বলেছেন, প্রকল্পের অন্যতম লক্ষ্য বাস্তবায়ন করার বিষয় নিয়ে এখনো বিজ্ঞানসম্মত কোন গবেষণাই করা হয়নি।
ভারতের আন্তঃনদী সংযোগ প্রকল্প পরিকল্পনা নতুন কিছু নয়। অনেকদিন থেকেই এনিয়ে সংশ্লিষ্টরা কথাবার্তা বলছেন। ভারতীয় পরিবেশ বিশেষজ্ঞসহ অনেকেই এ প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছেন। নিজ দেশের বিশেষজ্ঞ এবং প্রতিবেশীদের দুর্দশার কথা কোন বিবেচনাতে না নিয়ে এ প্রকল্পের একরোখা বাস্তবায়নের দিকেই যে ভারত ঝুঁকছে সে প্রমাণই আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে ভারতীয় পানি সম্পদমন্ত্রীর বক্তব্যে। এই প্রকল্পের মূল টার্গেট হলো মানসসংকোশসহ গোটা ব্রহ্মপুত্র অববাহিকা। এদিকে বাংলাদেশ ব্রহ্মপুত্র অববাহিকার পানির উপর বিশেষভাবে নির্ভরশীল। বাংলাদেশে উভয় মওসুমে সবচেয়ে বেশি পানি আসে ব্রহ্মপুত্র থেকে। ভারতীয় পানিমন্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী, এ নদ থেকে পানি প্রত্যাহার করে নেয়া হলে সবচেয়ে বিপদের মধ্যে পড়বে বাংলাদেশ। এমনিতেই শুষ্ক মওসুমে পানি না পাবার কারণে বাংলাদেশের নদ-নদীগুলো প্রায় মৃত দশা। অধিকাংশ নৌপথই শুষ্ক মওসুমে বন্ধ হয়ে গেছে। স্বাধীনতার পর থেকে এপর্যস্ত প্রতিবছরই নদ-নদীগুলো একটির পর একটি শুকিয়ে যাচ্ছে। মূলত ফারাক্কা বাঁধের কারণে এবং চুক্তি অনুযায়ী, পানি না পাওয়ায় বাংলাদেশের প্রাণ নদ-নদীগুলোর এই মৃত্যুদশায় পরিণত হয়েছে। পানি আলোচনায় ভারত বারবারই পানির প্রাপ্যতা নিয়ে আলোচনা করে আসছে। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ উৎসে রিজার্ভারের আলোচনা করলেও সে ব্যাপারে বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করতে ভারতীয়দের আগ্রহের কোন প্রমাণ পাওয়া যায়নি। বাংলাদেশ যৌথ নদী কমিশনে নেপালের অন্তর্ভুক্তির প্রস্তাবও ভারত মেনে নেয়নি। প্রকৃত অবস্থা হচ্ছে, প্রতিবেশীর বৈরী পানিনীতির কারণে বাংলাদেশের প্রকৃতি দিন দিন রুক্ষতার দিকে ধাবিত হচ্ছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ইতোমধ্যেই কৃষির জন্য পানি সংকট সৃষ্টি হয়েছে। কোথাও কোথাও খাবার জন্য সুপেয় পানির সংকট দেখা দিয়েছে। নোনা পানির কারণে উপকূলীয় অঞ্চলে জীবনযাপনে নয়া সংকট দেখা দিয়েছে। অন্যদিকে ভূগর্ভস্থ পানির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে মাটির স্তর দেবে যাচ্ছে। সব মিলে এ কথাই সত্যি যে, পানির অভাবে বাংলাদেশ এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখোমুখি। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ প্রাকৃতিক পানির যেটুকু অংশীদার ছিল তা থেকেও স্থায়ীভাবে বঞ্চিত করার চক্রান্ত বাস্তবায়নের পথে। এটি কোন বিবেচনাতেই সৎ প্রতিবেশীসুলভ আচরণের মধ্যে পড়েনা। এই অনাকাক্সিক্ষত প্রবণতারোধে বাংলাদেশের সংশ্লিষ্টদের ভূমিকাও যে খুব একটা সক্রিয় তেমনটা মনে হবার কোন কারণ নেই।
ফারাক্কা বাঁধের কারণে পদ্মার করুণ পরিণতিতে অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে রাজশাহীসহ বরেন্দ্র অঞ্চলের খাল-বিল, নদী-নালা। পদ্মা পানি শূন্য হবার পাশাপাশি ভূগর্ভের পানির স্তরও নেমে গেছে। গভীর নলকূপেও ঠিকমত পানি পাওয়া যাচ্ছেনা। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, গঙ্গার উৎস থেকে ফারাক্কা পর্যন্ত বহু বাঁধ আর খালের মাধ্যমে গঙ্গার পানি প্রত্যাহার করে চলছে ভারত। শুধু ফারাক্কা বাঁধ নয় কানপুরে গঙ্গা ব্যারাজ ও হরিদ্বারে গঙ্গার পানি প্রত্যাহারে নির্মিত কৃত্রিম খালসহ অসংখ্য স্থাপনা নির্মাণ করেছে ভারত। ফারাক্কার উজানে উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুরে গঙ্গার উপর আরো একটি বাঁধ নির্মাণ করেছে ভারত। ফলে নতুন যে উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে ভারত তার ফলে বাংলাদেশের অবস্থা কি দাঁড়াবে বোধকরি তা লিখে বা বলে বোঝাবার কোন প্রয়োজন নেই। এই বাস্তবতায় বাংলাদেশ যদি নীরবে বসে থাকে অথবা লোক দেখানো প্রতিবাদ করে তাহলে দেশের মানুষকে হয়ত পানির অভাবেই মরতে হবে। ভারতের স্বার্থ রক্ষার ব্যাপারে বর্তমান সময়ে সংশ্লিষ্টরা যে মাত্রায় তৎপর আলোচ্য ক্ষেত্রে যদি তাদের বিন্দুমাত্র ভাবান্তর পরিলক্ষিত হয় তাহলে সেটাই হবে দেশপ্রেমের প্রমাণ। ভারতের আন্তÍঃনদী সংযোগ প্রকল্প নিয়ে যতদিন ধরে কথাবার্তা হচ্ছে ততদিনে এ প্রকল্প রোধে বা এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষার জন্য কোন কার্যকর পরিকল্পনার কথা এখন পর্যন্ত শোনা যায়নি। ভারতীয় পানিমন্ত্রীর সাম্প্রতিক ঘোষণার পর এটা বুঝতে বাকি থাকার কথা নয়, বিপদ আসন্ন। বলার অপেক্ষা রাখে না, আন্তঃসংযোগ প্রকল্পের মাধ্যমে ব্রহ্মপুত্র, গঙ্গা ও বরাকের পানি সরিয়ে নেয়া হলে বাংলাদেশকে পানির অভাবে শুকিয়ে মরতে হবে। আমরা মনে করি, সময় ক্ষেপণের বিন্দুমাত্র সময়ও আর হাতে নেই। ভারত পানি নিয়ে কী কী করছে তার খোঁজ-খবর নিয়ে অবিলম্বে দেশ বাঁচাতে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়া জরুরি।

 

 

 

 



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: ভারতের আন্তঃ নদী সংযোগ প্রকল্প
আরও পড়ুন