পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
হায়াত, মউত, রেজেক, দৌলত এসবই একমাত্র সর্বশক্তিমান আল্লাহতায়ালার হাতে, একথা আমরা সবাই জানি। আমার কৃষিজীবী ধর্মপরায়ণ আব্বা আলহাজ্জ মোহাম্মদ হাবিলউদ্দিন ৯৪ বছর হায়াত পেয়েছিলেন। কিন্তু তার সন্তানদের অর্থাৎ আমার বড় ভাইদের মধ্যে কেউই তাঁর বয়সের ধারে-কাছেও যেতে পারেননি। একমাত্র আমি গত ১৯ ফেব্রুয়ারি (২০১৯) ৯০ বছর পার করে ৯১-তে পা রাখতে পেরেছি। এ উপলক্ষে দৈনিক ইনকিলাবের সহকর্মীদের আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে মাননীয় সম্পাদক মহোদয় শুধু আমাকে অভিনন্দনই জানাননি, তিনিসহ কেউ কেউ আমাকে শতায়ু হবার জন্য দোয়াও করেছেন।
দৈনিক ইনকিলাবে জয়েন করবার ঠিক আগে আমি আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান ইসলামিক ফাউন্ডেশনে ছিলাম। তখন বাংলাদেশের ধর্মমন্ত্রী ছিলেন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন ইসলামী চিন্তাবিদ মাওলানা এম. এ. মান্নান। ইসলামিক ফাউন্ডেশনের অন্যতম পরিচালক হিসেবে বিভিন্ন আলোচনা সভায় যোগদান সূত্রে মাওলানা সাহেবের অন্যতম ঘনিষ্ঠ সহযোগী মওলানা রূহুল আমীন খানের সঙ্গে গড়ে ওঠে আমার গভীর হৃদ্যতা। এই হৃদ্যতার সূত্র ধরে একদিন দুপুরে আমার ফাউন্ডেশন অফিসে গিয়ে হাজির হন মওলানা রূহুল আমীন খান। তিনি জানালেন, হুজুর (অর্থাৎ এম. এ মান্নান) আপনাকে সালাম দিয়েছেন। আমি বললাম, বাসা থেকে আমার খাবার এসেছে। মেহেরবানী করে একটু বসুন। খাওয়াটা সেরেই আপনার সঙ্গে যাব। তিনি বললেন, না, আপনাকে এখনই নিয়ে যেতে বলেছেন হুজুর।
সুতরাং বাসার খাবার না খেয়েই তার সঙ্গ নিলাম। মওলানা সাহেবের বাসায় গিয়ে তো আমার চক্ষু স্থির। হরেকরকম মূল্যবান সুস্বাদু খাবার নিয়ে বসে আছেন তিনি। বললেন, চলুন, আগে খেয়ে নিই। পরে কথা হবে। খাওয়া শেষ করে তিনি কথা শুরু করলেন। আমি প্রকাশনা পরিচালক ছিলাম। তিনি বললেন, আপনি এখান থেকে যেসব বই প্রকাশ করেন, তা কত লোকে পড়ে বলে মনে করেন? বললাম, তা কমপক্ষে পাঁচশো তো হবেই। তিনি বললেন, এমন একটা ব্যবস্থা যদি হয়, আপনি যা প্রকাশ করবেন তা প্রতিদিন হাজার নয়, লাখ লাখ লোকে পড়বে, সেখানে যাবেন?
উত্তরে আমি বললাম, আধা-সরকারি প্রতিষ্ঠান হিসাবে ইসলামিক ফাউন্ডেশনে আমি আরও কয়েক বছর চাকরি করতে পারব। এর মধ্যে আমি অন্য কোথাও যেতে চাই না। তিনি বললেন, ঠিক আছে, আপাতত সেখানে অস্থায়ী হিসেবে জয়েন করবেন। পরে ফাউন্ডেশনে চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে সেখানে নিয়মিত হবেন। এরপর আমার অসম্মত হবার আর উপায় থাকল না। সেই সম্মতির আলোকে দৈনিক ইনকিলাবের যাত্রা শুরুর দিন (৪ জুন ১৯৮৬) থেকেই আমি ফিচার সম্পাদক হিসেবে ইনকিলাবে কাজ শুরু করলাম।
সেই থেকে আমি দৈনিক ইনকিলাবে এই পদে আছি। এরপর বহু সাংবাদিক ইনকিলাব থেকে নানা কারণে বাদ গেছেন। কিন্তু আমি রয়েই গেছি। এমনকি আমার বয়স ৮০ বছর পেরিয়ে ৯০-এর কাছাকাছি চলে যাবার কারণে বার্ধক্যজনিত কারণে দুর্বল হয়ে যাবার পরও মাননীয় সম্পাদক মহোদয় জনাব এ. এম. এম. বাহাউদ্দীন বলেছেন, উনি যদি দৈহিকভাবে আসতে না পারেন বাসায় লিখে লেখা অফিসে পাঠিয়ে দিলেই চলবে।
তারপরও আমার বিশ্বাস ছিল, আমি হয়তো এরপরও কষ্টে-সৃষ্টে অফিসে নিয়মিত আসতে পারব। কিন্তু মানুষ যা কল্পনা করে তা অনেক সময় বাস্তবে ঘটে না। আমি সাধারণত প্রতি সপ্তাহে মঙ্গলবার বাসায় বসে লিখে লেখাটি আমার ছেলেকে দিয়ে ইনকিলাবে পাঠিয়ে দেই। এটাই পাঠকরা পড়েন বৃহস্পতিবার দৈনিক ইনকিলাবে উপসম্পাদকীয় কলাম হিসাবে।
দুঃখের সঙ্গে জানাচ্ছি, গত রবিবার দিবাগত রাত থেকে অজ্ঞাত কারণে আমার চলাফেরা কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। সোমবার ভোর থেকেই আমার চলাফেরা করা প্রায় অক্ষম হয়ে পড়ে। এমতাবস্থায়, আমি ইনকিলাবের উপসম্পাদকীয় আর নিয়মিত লিখতে পারব কিনা, তা নিশ্চিত করে বলতে পারি না।
তবে সঙ্গে সঙ্গে একথাও আমি জানিয়ে রাখতে চাই যে, আমি এতদিন ইনকিলাবে বেতন পেয়েছি বলেই নিয়মিত কাজ করেছি, তা নয়। দৈনিক ইনকিলাবের আদর্শের সঙ্গে আমার জীবনাদর্শের মিল রয়েছে বলে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত দৈনিক ইনকিলাবকে আমি ভালবেসে যাব এবং আমার সাধ্যের মধ্যে কুলালে অতীতের মতো লিখে যাব ইনশাআল্লাহ।
পরিশেষে দৈনিক ইনকিলাবের যাত্রা শুরুর দিন থেকে এতদিন পর্যন্ত যাদের সাথে কাজ করেছি, মাননীয় প্রতিষ্ঠাতা মরহুম মাওলানা এম. এ. মান্নান, সম্পাদক জনাব এ. এম. এম. বাহাউদ্দীন, নির্বাহী সম্পাদক মওলানা রূহুল আমীন খান, পরিচালক আবদুল কাদের এবং সম্পাদকীয়, বার্তা ও ফিচার বিভাগে কর্মরত আমার সকল সহকর্মীর প্রতি জানাই আন্তরিক শ্রদ্ধা ও প্রীতি।
সর্বশেষে সংশ্লিষ্ট সকলের প্রতি বিনীত নিবেদন জানাই, আমার বর্তমান শারীরিক দুর্বলতা যেন দূর হয় এবং আমি যেন পুনরায় সুস্থ হয়ে দৈনিক ইনকিলাবে পুনোর্দ্যমে কাজ করার ক্ষমতা ফিরে পাই, এ জন্য পরম করুণাময় আল্লাহ তায়ালার কাছে দোয়া করবেন।
আমার পেশাগত সাংবাদিক জীবন দৈনিক ইনকিলাবে শুরু হয়নি। পেশাগত সাংবাদিক জীবনের কথা যদি বলি তবে অধুনালুপ্ত দৈনিক মিল্লাতের সহকারী সম্পাদক, দৈনিক নাজাতের সম্পাদক, ডেইলি পিপলের সহকারী সম্পাদক, দৈনিক দেশের সহকারী সম্পাদক, দৈনিক আজাদের বার্তা সম্পাদক, (১৯৭১) প্রভৃতি পদে কাজের কথা বলতে হয়।
পেশাগত সাংবাদিকতায় যোগ দেয়ার আগে ভাষা আন্দোলনের মুখপত্র সাপ্তাহিক সৈনিকের সম্পাদক হিসেবে কাজ করেছি। সেখানে আমার সহকর্মী ছিলেন কথাশিল্পী শাহেদ আলী, এনামুল হক, সানাউল্লাহ নূরী, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী, হাসান ইকবাল প্রমুখ। তবে সেখানে কেউ তাদের কাজের জন্য পারিশ্রমিক বা সম্মানী নিতেন না। আজ আমি তাদের প্রতিও জানাচ্ছি আমার আন্তরিক প্রীতি ও শুভেচ্ছা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।