পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়িত হলে দ্রব্যমূল্য অনাকাক্সিক্ষতভাবে বাড়বে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে চিঠি পাঠিয়েছে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই। সংগঠনটির মতে, এর ফলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পোদ্যোক্তাদের ক্ষতির শিকার হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, যা দেশের অর্থেনৈতিক অগ্রাযাত্রাকে ব্যাহত করবে। তার আশঙ্কা, আইনটি কার্যকর হলে ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের অসন্তোষ ও ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়াকে পুঁজি করে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার অপচেষ্টাও হতে পারে। এ পরিস্থিতিতে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট এবং ক্ষুদ্র ও মাঝারি ব্যবসায়ীদের জন্য ‘প্যাকেজ’ পদ্ধতির ভ্যাট প্রথা পুনর্বহালসহ যৌথ কমিটির সাত দফা সুপারিশ বাস্তবায়ন করার তাকিদ দেয়া হয়েছে এফবিসিসিআইর পক্ষ থেকে। এর আগে ২৪ এপ্রিল একই বিষয়ে আরেকটি চিঠি প্রধানমন্ত্রীকে দিয়েছিল সংগঠনটি। তাতে বলা হয়েছিল, নতুন ভ্যাট আইনের অধীনে মোট বিক্রয় মূল্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হবে। এতে রেয়াত গ্রহণে অসমর্থ ৮৫ শতাংশ করদাতা বিশেষ করে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বা বাণিজ্যের ক্ষেত্রে ভ্যাটব্যবস্থা কার্যত আবগারি শুল্কে পরিণত হবে। যৌথ কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী মূল্য সংযোজিত অংশের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলে ভ্যাটব্যবস্থা সহজ, সরল ও ব্যবসাবান্ধব হবে। ফলে ভ্যাট নেটওয়ার্ক বৃদ্ধি পাবে এবং রাজস্ব আদায় গতিশীল হবে। ভ্যাট আইন আগামী জুলাই থেকে কার্যকর করতে যাচ্ছে সরকার। ২০১২ সালে আইনটি পাস হলেও ব্যবসায়ীদের বিরোধিতার কারণে তা কার্যকর হয়নি। ২০১৪ সালের সেপ্টেম্বরে ব্যবসায়ীদের দাবির প্রেক্ষিতে একটি উচ্চ পর্যায়ের যৌথ কমিটি গঠন করা হয়। যৌথ কমিটি সাত দফা সুপারিশ প্রদান করে। ১৫ শতাংশের বদলে হ্রাসকৃত হারে কিংবা বহুস্তর ভ্যাটব্যবস্থা রাখা, টার্নওভার ভ্যাটের হার শিথিল করা, ব্যবসায়ীদের দায় তার আত্মীয়দের ঘাড়ে না দেয়াসহ সাতটি বিষয়ে সরকার ও ব্যবসায়ী নেতারা একমত হন। কিন্তু এসব সুপারিশ অর্থ মন্ত্রণালয় গ্রহণ করছে না বলে ব্যবসায়ীদের অভিযোগ। ইতোমধ্যে অর্থমন্ত্রী জানিয়ে দিয়েছেন, সব ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ ভ্যাট রেখেই নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হবে।
নতুন ভ্যাট আইন নিয়ে যে বিতর্ক ও আলোচনা-সমালোচনা চলছে তা এড়িয়ে যাওয়ার উপায় নেই। এর সঙ্গে শুধু ব্যবসায়ীদের স্বার্থ ও অর্থনীতির ভালোমন্দই জড়িত নয়. জনগণের স্বার্থ ও তাদের ভালোমন্দের প্রশ্নও জড়িত। বিশ্লেষকদের মতে, নতুন ভ্যাট আইন কার্যকর হলে মূল্যস্ফীতি হবে ব্যাপক হারে। বিদ্যুৎসহ সব সেবা খাতে বাড়তি অর্থ ব্যয় করতে হবে। এমনকি পোশাক ও গয়নার ক্ষেত্রেও বাড়তি ভ্যাট দিতে হবে। বিশেষ করে সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে এবং নির্ধারিত মূল্যের (ট্যারিফ মূল্য) ওপর যেসব পণ্যে বা সেবা পর্যায়ে বর্তমানে যে হারে ভ্যাট আদায় করা হয় সেসব খাতে সরাসরি ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট বসবে। এছাড়া নতুন আইনে ১ হাজার ৯৭৩টি পণ্যের ভ্যাট অব্যাহতি সুবিধাও উঠে যাবে। এনবিআর নতুন ভ্যাট আইনের চ্যালেঞ্জগুলো নিয়ে যে বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদন তৈরি করেছে তাতেও বলা হয়েছে, নতুন আইনের বাস্তবায়ন হলে নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন পণ্যের মূল্য বৃদ্ধি পেয়ে মূল্যস্ফীতি দেখা দিতে পারে। কারণ, এতে গৃহস্থালি ব্যয় বেড়ে সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়বে। এ আইনের কারণে সরকারি প্রকল্পের ব্যয় বাড়বে। এতে বাজেট বাড়বে। একই সঙ্গে বাড়বে ব্যবসা পরিচালনা ব্যয়। কোন কোন খাতে কিভাবে ভোক্তা পর্যায়ে মূল্য বাড়বে এর কিছু উদাহরণ এনবিআরের প্রতিবেদন তুলে ধরা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিলের সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে এখন ৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আছে। নতুন আইন অনুযায়ী বিদ্যুৎ বিলের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট বসবে। এতে গৃহস্থালি ও শিল্পের অর্থনৈতিক ব্যয় বাড়বে, যা সার্বিক জীবনযাত্রার ব্যয় বাড়িয়ে দেবে। বর্তমানে বিদ্যুৎ বিলসহ ২০ ধরনের সেবার ওপর সংকুচিত ভিত্তিমূল্যে বিভিন্ন হারে (২ থেকে ১০ শতাংশ) ভ্যাট আরোপ করা আছে। নতুন আইন অনুযায়ী এসব খাতে অভিন্ন ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট আরোপ হবে যাতে ওই সব পণ্য ও সেবার পেছনে ক্রেতার খরচ বাড়বে। নতুন আইনে যে ১ হাজার ৯৭৩টি পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি উঠে যাবে সেসব পণ্যের জন্যও ক্রেতা-ভোক্তাদের বাড়তি কর গুনতে হবে। এনবিআরের বিশ্লেষণ অনুযায়ী সব মিলিয়ে ট্যারিফ আইনের ৭৪ দশমিক ৪ ভাগ পণ্যে সরাসরি ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। স্থানীয় উৎপাদন পর্যায়ে ৮৫টি পণ্যের ওপর ট্যারিফ মূল্য ধরে ভ্যাট আরোপ করা আছে। অর্থাৎ পণ্যগুলোর পরিমাপের এককের ওপর ভ্যাট নির্ধারিত আছে। এখন ১৫ শতাংশ ভ্যাট আরোপ করা হলে এগুলোর মূল্য বাড়বে। সবচেয়ে বেশি বাড়বে রডের দাম। এখন প্রতি টন রডে ৪১২ টাকা ৫০ পয়সা ভ্যাট দিতে হয়। নতুন আইনে রেয়াতের পরও বর্তমান বাজারদরে ৩ হাজার ২২৯ টাকা ভ্যাট দিতে হবে। অর্থাৎ টনপ্রতি দাম বাড়বে ২ হাজার ৮১৬ টাকা। ভ্যাটের কারণে ইট-বালুর দামও বাড়বে। কারণ, এসব ক্ষেত্রেও ১৫ শতাংশ ভ্যাট দিতে হবে। এভাবে নির্মাণ সামগ্রীর দাম বাড়লে সরকারি-বেসরকারি নির্মাণ খাত বিশেষ করে বেসরকারি আবাসন খাত মারাত্মক সঙ্কটে পড়বে। সব নির্মাণেই ব্যয় বৃদ্ধি পাবে। সরকারের বড় বড় নির্মাণ প্রকল্পে অনিবার্যভাবেই বাজেট বাড়াতে হবে। ব্র্যান্ডের দোকান থেকে পোশাক কিংবা গয়না কিনতে গিয়ে ভ্যাটের কারণে বাড়তি মূল্য দিতে হবে।
দেখা যাচ্ছে, নতুন ভ্যাট আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে জনগণের কথা, ব্যবসা-বাণিজ্য ও অর্থনীতির কথা এবং শিল্প বিকাশের কথা গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় না নিয়ে রাজস্ব বাড়ানোর প্রতিই গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। এ ক্ষেত্রে পণ্য ও সেবার ক্রেতা কিংবা ব্যবসায়ীদের সক্ষমতার কথা বিবেচনা করা হয়নি। পণ্য ও সেবার ওপর যে উচ্চ ভ্যাট আরোপ করা হবে তা মূলত ক্রেতা-ভোক্তার পকেট থেকেই যাবে। ব্যবসায়ীরা দায় নেবে না। এফবিসিসিআই’র সভাপতি আবদুল মতলুব আহমাদ স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, সরকার যদি চায় ভ্যাটের হার বাড়াতে, মূল্যস্ফীতি বাড়াতে, তাহলে আমরা তো কিছু করতে পারব না। বলা নিষ্প্রয়োজন, সরকারের যদি নীতি হয় জনগণের কাছ থেকে নানাভাবে অর্থ আদায় করা, যেটা এখনো হচ্ছে, তাহলে ব্যবসায়ীদের করার কিইবা থাকতে পারে! অবশ্য ব্যবসায়ীরা যাই বলুন, জনগণের পণ্য ও সেবা কেনার সামর্থ্য হ্রাস পেলে তাদেরও বিপাকে পড়তে হবে, ক্ষতিগ্রস্ত হতে হবে। এতে বিনিয়োগ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে মন্দা নেমে আসবে। দেশের জন্যও তা সুখবর হবে না। সরকারের যাবতীয় নীতি-পদক্ষেপ ও কর্মের লক্ষ্য হওয়া উচিত জনগণের সুখ ও স্বাচ্ছন্দ্য নিশ্চিত করা। ভ্যাট আইনে তার কোনো প্রতিফলন নেই। জনগণকে দোহন করা, শোষণ করার একটা প্রবণতা এখানে রয়েছে। দুর্ভাগ্যের বিষয়, ব্যবসায়ীরা তাদের স্বার্থে ভ্যাট আইন সংশোধনের দাবি জানাচ্ছেন, আন্দোলন করছেন কিন্তু জনগণের করার কিছু নেই। তাদের জীবন যাত্রা যে আরো কঠিন ও বিপর্যয়কর হয়ে উঠবে, সে কথা বলার কোনো মাধ্যম নেই। তাদের কোনো সংঘশক্তি নেই। নীরবে সবকিছু হজম করাই যেন তাদের নিয়তি। সরকারকে মনে রাখতে হবে, জনগণকে ঠকিয়ে কিংবা কষ্ট দিয়ে আখেরে কোনো লাভ হয় না। এক সময় তা বুমেরাংও হয়ে দেখা দিতে পারে। সঙ্গতকারণেই আমরা আশা করতে চাই, সরকার ভ্যাট আইনকে বাস্তবানুগ, জনবান্ধব, ব্যবসাবান্ধব, অর্থনীতিবান্ধব ও দেশবান্ধব করে সংশোধন ও কার্যকর করবে। এ ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় যথাযথ পদক্ষেপ নেবে, এটাই আমরা কামনা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।