Inqilab Logo

বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪, ০৪ বৈশাখ ১৪৩১, ০৭ শাওয়াল ১৪৪৫ হিজরী

সরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা

নাজমুল হোসেন | প্রকাশের সময় : ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

ডাক্তার, নার্স ও দালালদের দৌরাত্ম্যে জিম্মি হয়ে পড়েছে সরকারি হাসপাতালের রোগীরা। এমন পরিণতিতে হাসপাতালগুলোতে আসা রোগীদের দুর্ভোগ চরমে পৌঁছেছে। দেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে চিকিৎসা সেবা দেওয়ার নামে চলমান নৈরাজ্য ও নির্মমতা দেখার যেন কেউ নেই। দেশের ৬৪টি জেলা শহরের বেশিরভাগ হাসপাতালে প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও জনবল নেই। আর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ক্লিনিকগুলোর অবস্থা আরও নাজুক। এসব হাসপাতালে প্রয়োজনের তুলনায় এমবিবিএস চিকিৎসক নেই। আবার কোনো কোনো হাসপাতালে একাধিক এমবিবিএস কর্মরত। যেখানে এমন ডাক্তারের স্বল্পতা সেখানে ডাক্তারের সহকারী ও ওয়ার্ড বয় জনসাধারণের স্বাস্থ্যসেবার একমাত্র ভরসা। হাসপাতালসমূহে শুধু ডাক্তার সংকট নয় বরং সিনিয়র স্টাফ নার্সসহ অন্যান্য বিভাগে লোকবলের চরম সংকট। জেলা সদর ও উপজেলার বেশিরভাগ হাসপাতালে এক্স-রে, মেশিন, ডেন্টাল যন্ত্রপাতি, প্যাথলজিস্ট যন্ত্রপাতি, আর্ট বিভাগের যন্ত্রপাতি ইত্যাদিসহ বহু নাম না জানা মূল্যবান চিকিৎসা সামগ্রী ব্যবহারের অভাবে অকেজো হয়ে পড়ে। ফলে হাসপাতালে চিকিৎসা সেবার আশায় আগত সাধারণ মানুষ ওই সমস্ত চিকিৎসা সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। বিভাগীয় শহরের সরকারি মেডিকেল কলেজ হাসপাতালগুলোতেও বেহাল দশা। একটু ভালো আর বিনামূল্যে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা পেতে দেশের বিভিন্ন প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে বড় আশা নিয়ে দরিদ্র রোগীরা হাসপাতালে আসে। কিন্তু এখানে এসেই তাদের পড়তে হয় বিপাকে, নানা বিড়ম্বনায়। হাসপাতালের প্রবেশ গেট থেকে শুরু করে কেবিন, বেড পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে এক শ্রেণির দালাল। নানা প্রলোভন, যেমন দ্রুত ডাক্তার সেবা পাইয়ে দেয়া, প্রয়োজনীয় ঔষধ, থাকার জন্য কেবিন ইত্যাদি দেখিয়ে তারা দরিদ্র ও সহজ সরল রোগীদের কাছ থেকে টাকা নিয়ে এক রকম সর্বস্বান্ত করে ছাড়ে। বিষয়টা অনেকটা এমনই- আগে টাকা পরে চিকিৎসা সেবা। এদের খপ্পরে পরে অনেকেরই চিকিৎসা সেবা তো দূরের কথা উল্টো দ্বিগুণ অসুস্থ হয়ে কখনো হাসপাতালের বারান্দায়ও শুয়ে কাতরাতে দেখা যায়। ওই সব দালালই এই পর্ব শেষে আবার সরকারি মেডিকেলের কাজের হতাশাপূর্ণ বর্ণনা দিয়ে প্রাইভেট ডাক্তারদের কাছে চিকিৎসা নিতে উদ্বুদ্ধ করে। অভিযোগ আছে, এরা সরকারি ডাক্তারদের দ্বারা নিয়োজিত ও নিয়ন্ত্রিত আর রোগী প্রতি এসব দালালদের ডাক্তাররা কমিশন দিয়ে থাকে। রোগী দেখার সময় দেখা যায় তাদের বিভিন্ন রকম মিটিং থাকে। দুপুরের খাবারের আগেই ডাক্তারসহ নার্সরা বিরতিতে চলে যায়। নির্দিষ্ট সময়ের অনেক পরেও তাঁদের দেখা মেলে না। ভুক্তভোগী রোগীদের অভিযোগ, ডাক্তাররা তাদের সরকারি কর্মক্ষেত্রের চেয়ে নিজের ব্যক্তিগত প্রতিষ্ঠানকেই বেশি প্রাধান্য দেন। আরও একটি উল্লেখযোগ্য চিত্র হচ্ছে, ডাক্তাররা কর্তব্যরত থাকা অবস্থায় বিভিন্ন ঔষধ কোম্পানির বিক্রয় প্রতিনিধিদের উপস্থিতি। দামী গিফট কিংবা বড় ধরনের সুবিধা পাওয়ার আশায় অনেক সময় ওই সব প্রতিনিধির সাথে ডাক্তারদের গল্প ও আলাপ-চারিতায় মেতে উঠতে দেখা যায়। তাদের এই কার্যক্রমের মাধ্যমেও লাইনে অপেক্ষামান থাকা রোগীদের নানা হয়রানির শিকার হতে হয়। ডাক্তারদের অবহেলা ও অনুপস্থিতির সুযোগে নার্স, ওয়ার্ড বয় ও আয়ারাই হয়ে উঠে সর্বেসর্বা। রোগী দেখা থেকে শুরু করে অস্ত্রোপচার পর্যন্ত করছে অবলীলায়। সুযোগ-সুবিধাহীন সরকারি হাসপাতালে একশ্রেণির ডাক্তার, নার্স, আয়া-কর্মচারীর চরম দুর্ব্যবহারের সামনে রোগীরা থাকছেন বড়ই অসহায়। হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীসহ অন্যান্য রোগীরা পর্যাপ্ত ঔষধ থাকা সত্তে¡ও সঠিকভাবে ঔষধ পায় না। ডাক্তারদের লেখা স্লিপ নিয়ে ঔষধ আনতে গেলেই ২/১টা সস্তা ঔষধ দিয়ে বলা হয়, বাকীগুলো স্টোরে নেই তাই বাহির থেকে কিনতে হবে। অথচ বাহিরের ফার্মেসীতে গেলেই দেখা যায় না পাওয়া ঔষধগুলো অগ্নিমূল্য। এতসব দামী ঔষধ তাহলে যায় কোথায়? দেশের বেশিরভাগ চিকিৎসকদের বাণিজ্যিক মন-মানসিকতার কবলে পড়ে সাধারণ মানুষ সরকারি চিকিৎসা সেবা পাচ্ছে না। এই সব যন্ত্রণা থেকে মুক্তির আশায় নিকটস্থ বেসরকারি ক্লিনিকগুলোতে সেবা নিতে গিয়েও সাধারণ রোগীরা পড়ে নতুন হতাশা ও যন্ত্রণায়। উন্নত চিকিৎসার নামে চাকচিক্যময় ওই সব ক্লিনিকে ভালো চিকিৎসার নামে চলছে গলাকাটা বাণিজ্য। সাধারণ রোগীরা চিকিৎসকদের নামী-দামী ডিগ্রি দেখে চিকিৎসা নিতে গিয়ে বিপাকে পড়ে।
ডাক্তারদের অতিরিক্ত ফি, প্রয়োজনীয় ঔষধের সাথে অপ্রয়োজনীয় ঔষধ, ঊর্ধ্বমূল্যের টেস্ট ফি, বেড ভাড়া দিয়েই ধার দেনা করে আনা অসহায় রোগীদের পকেট খালি হচ্ছে। এই সব চার্জ তারা নিজেদের খেয়াল খুশি মতই বাড়াচ্ছে। তাছাড়া রোগীকে দরকারি ও অদরকারি প্যাথলজি টেস্টের জন্য লম্বা স্লিপ দিয়ে মনোনীত ক্লিনিক কিংবা ল্যাবরেটরি থেকে পরীক্ষা করার জন্য পরামর্শ দেয়। অন্য কোথাও থেকে করলে সেগুলো অগ্রহণযোগ্য হয়। এখানেও রয়েছে কমিশন বাণিজ্য। স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের নিয়মনীতি আর হুঁশিয়ারির কোন কিছুতেই পরোয়া নেই হাসপাতালগুলোর। অভিজাত হাসপাতাল নামের চিকিৎসা বাণিজ্য প্রতিষ্ঠানগুলোর মালিক কর্তৃপক্ষও অনেক বেশি প্রভাবশালী। ট্রান্সফারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ (টিআইবি) এর তথ্যানুযায়ী জানা যায়, সরকারি হাসপাতালগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশী ৩৫% দুর্নীতি হয় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে, ২৪.৯% জেনারেল হাসপাতালে ও মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ২০.৭%।
অথচ উন্নত দেশের মতো আমাদের দেশেও রয়েছে উন্নত চিকিৎসা সেবা। বড় বড় ও জটিল রোগের অপারেশন করার মতো সরকারি ব্যবস্থা ও আধুনিক যন্ত্রপাতিও এদেশের সরকারি হাসপাতালগুলোতে রয়েছে। তাহলে কেন রোগীরা এত সব চিকিৎসা সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে? বর্তমান সরকার চিকিৎসা সেবা ও খাতে অনেক বড় বাজেট রাখে। ইতোমধ্যে দেশের বিভিন্ন এলাকায় মেডিকেল কলেজ স্থাপন, হাসপাতালগুলোতে আধুনিক চিকিৎসা ব্যবস্থা, অসংখ্য ডাক্তার নিয়োগ ইত্যাদি কমবেশি সকল ব্যবস্থা থাকলেও সেই হিসেবে নেই চিকিৎসা সেবা। প্রতিনিয়তই দেখা যাচ্ছে, বারবার ডাক্তারদের অবহেলা, কর্মক্ষেত্রে অনুপস্থিতির চিত্র দেশের বিভিন্ন হাসপাতালে। স¤প্রতি প্রধানমন্ত্রী এই সব ডাক্তারদের চাকরি ছাড়ারও হুঁশিয়ারি দিয়েছেন।
সরকারি হাসপাতালে দালালদের উৎখাত ও ডাক্তারদের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে মনিটরিং সেল জোরদার করাসহ কঠোর পদক্ষেপ নিতে হবে এবং পাশাপাশি ডাক্তাররা যেসব যৌক্তিক সমস্যায় জর্জরিত সেগুলোকেও আমলে নিতে হবে। এছাড়া অন্যান্য আনুষঙ্গিক সমস্যাগুলোর সমাধানকল্পে দ্রুতই স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কে কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই সাধারণ জনগণের স্বাস্থ্যসেবা পাওয়ার পথ সুগম হবে।
লেখক: প্রকৌশলী



 

Show all comments
  • মামুন ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৯:৫২ এএম says : 0
    সত‍্য বলেছেন বাস্তবতা তুলে ধরেছেন।ধন‍্যবাদ আপনাকে ও ইনকিলাবকে।
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: হাসপাতালে চিকিৎসাসেবা
আরও পড়ুন