পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ইভিএম অর্থাৎ ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন ব্যবহারের বিরুদ্ধে বিরোধী দলের জোর আপত্তির মুখে সুষ্ঠু নির্বাচনের নিশ্চয়তা দিয়েই প্রধান নির্বাচন কমিশনার প্রতিটি প্রশাসনিক বিভাগে একটি আসনে নির্বাচনের ব্যবস্থা করেন। তখন সরকারি ঘরানার অনেকই এ বিরোধিতাকে আধুনিক বৈজ্ঞানিক পদ্ধতির বিরোধিতা বলে অখ্যায়িত করেন। কিন্তু প্রধান নির্বাচন কমিশনার নিজেই পরে বলেছেন, সংসদ নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারে ভুলক্রটি ছিল। তার বক্তব্যটি এ রকম, ‘জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ছয়টি নির্বাচনী এলাকায় আমরা ইভিএম ব্যবহার করেছি। দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্যি, সেটা কোথাও কোথাও ভুলক্রটি ছিল, অসুবিধা ছিল।’
প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) এ বক্তব্য সরল স্বীকারোক্তি না, জনগণের প্রতি তামাশা- সেটাই প্রশ্ন। ইভিএম সংগ্রহের বিষয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ ছিল। যথাযথ নিয়মে এ ইভিএম ক্রয় করা হয়নি বলে সভা সেমিনারে যথেষ্ট অভিযোগ উপস্থাপিত হলেও এখন সিইসির স্বীকারোক্তি অর্থাৎ ইভিএম ব্যবহার ভুল ছিল, এ কথায় গণমানুষের বিবেকে ছায়াপত করবে কি না জানি না। সাংবিধানিক চেয়ারে বসে সিইসির বিবেক কী বলে? সিইসি কি শুধুমাত্র হুকুম তামিল করার জন্যই সাংবিধানিক চেয়ারে বসেছেন, না কি জনগণের ভোটাধিকার রক্ষার জন্য শপথ নিয়েছেন? এ প্রশ্ন এক দিন না এক দিন উপস্থাপিত হতেই হবে।
জাতীয় নির্বাচনের সুষ্ঠুতা ও গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে সিইসি যতই গলা উঁচিয়ে বলছেন ততই অন্যতম কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেন ভিন্নকথা, যা সম্পূর্ণভাবে পরষ্পরবিরোধী। ৩১ ডিসেম্বর তিনি বলেছেন, ‘আমি এখন পর্যন্ত যেসব কাগজপত্র দেখেছি। তাতে রিটার্নিং অফিসার থেকে শুরু করে পর্যবেক্ষক পর্যন্ত সকলের প্রতিবেদনে দুটি শব্দ অতিমাত্রায় ব্যবহৃত হয়েছে। একটি শব্দ হচ্ছে সন্তোষজনক এবং অন্য শব্দটি হচ্ছে স্বাভাবিক। তার মানে কি আমাদের নির্বাচন খুবই সন্তোষজনক হয়েছে? এই ক্ষেত্রে পাবলিক পারসেপশন কি, তা নিজেদের কাছেই জিজ্ঞেস করতে হবে। তিনি আরো বলেছেন, নির্বাচন গ্রহণযোগ্য ও বিশ্বাসযোগ্য করার বিষয়ে আমি সবসময় গুরুত্বারোপ করেছি। এই গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা অবশ্যই দৃশ্যমান হতে হবে। নির্বাচন কমিশন সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবি করলেই যে তা সুষ্ঠু হয়ে যাবে এমন কোনো কথা নেই। জনতার চোখ বলে একটা কথা আছে।’
মাহাবুব তালুকদারের বক্তব্যে ‘পাবলিক পারসেনশন’ ও ‘জনতার চোখ’ দুটি কথা উঠে এসেছে। প্রশ্ন হলো, সরকার বা সাংবিধানিক পদাধিকারীরা কি পাবলিক পারসেপশনের মূল্য দেন? এ দেশের পাবলিকের কি মূল্য রয়েছে, না কি জনগণের অধিকার বাস্তবায়নে কারো কোনো দায়িত্ব আছে বলে তারা মনে করেন? অন্যদিকে জনতার চোখ কোথায় হারিয়ে গেল? জনগণ যেন কারো প্রতি কোনো আস্থা রাখতে পারছে না। অন্যায়-অত্যাচার দেখতে দেখতে তারা হয়রান হয়ে কি দৃষ্টিহীন না বিতশ্রদ্ধ হয়ে নিরব-নিস্তব্দ হয়ে পড়েছে? এতোদিন ধারণা ছিল যে, সত্যকে মিথ্যা দিয়ে ঢাকা যায় না। এখন দেখা যাচ্ছে, মিথ্যা দিয়ে সত্যকে শুধু ঢাকা নয়, ভাসিয়ে দেয়া যায়। নতুবা দিনের আলোর মতো সত্য যে, গণমানুষ যেখানে ভোট দেয়ার সুযোগ পায় নাই সেখানে ভোটের বাক্স ভরল কীভাবে? সরকারি দল যাকে নমিনেশন দিয়েছে তারই বাক্স ভরে গেছে। এরশাদ নেতৃতাধীন জাতীয় পার্টি লাঙ্গল মার্কায় নির্বাচন করেছে এবং তাদের প্রার্থীার নিয়মিত প্রচার করারও সুযোগ পেয়েছে কিন্তু ওপর থেকে যার প্রতি গ্রিন সিগন্যাল দেয়া হয়েছে তারই বাক্স ভোটে ভরে গেছে। বাকীদের ভাগ্যে জুটেছে পুলিশের হয়রানি। পুলিশ ভোটাধিকার হরণে যে ভ‚মিকা নিয়েছে, তার পুরস্কারও তারা পেয়েছে।
অনেকেই বলেছেন ও এখনো বলছেন যে, শক্তিশালী বিরোধী দল ছাড়া গণতন্ত্র পূর্ণতা পায় না। আওয়ামী লীগসহ ১৪ দলের সবচেয়ে বড় শরীক দল হলো জাতীয় পার্টি। জাতীয় পার্টি অনুষ্ঠানিকভাবে এখন বিরোধী দলে। পূর্বে তারা সরকার ও বিরোধী দুইটি অবস্থানে ছিল। গণমানুষ তখন জাতীয় পার্টিকে গৃহপালিত বিরোধীদল বলতো। এখন হয়তো সে কারণে জাতীয় পার্টি বিরোধী দলেই রয়ে গেল। রাজনৈতিক দলের চা চক্র অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যে, ‘১৪ দল আমার আসল জোট। এটা আমাদের আদর্শিক রাজনৈতিক জোট। এ জোট আছে, থাকবে।’ ১৪ দলের সর্বোচ্চ নেতা শেখ হাসিনা নিজেই। একমাত্র জাতীয় পার্টি ছাড়া সকলেই ‘নৌকা’ মার্কা নিয়ে নির্বাচন করেছেন। আওয়ামী লীগের মার্কা ও সমর্থন নিয়ে যারা নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছেন তারাই এখন বিরোধী দলের আসনে বসবেন। ফলে সাংবিধানিক বিরোধী দল আর রইল না। এমনিভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে সরকার গণতান্ত্রিক কাঠামোকে ভেঙ্গে দিচ্ছে। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান স্বাধীন হওয়ার পরও শক্তিশালী বিরোধীদল গড়ে উঠতে পারে নাই। ভাঙ্গা-গড়া, পূর্ব-পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃত্বের লড়াই, পূর্ব পাকিস্তানকে নেতৃত্বশূন্য করার চেষ্টা, সামরিক শাসন, সব মিলিয়ে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা টেকসই হওয়ার পূর্বেই পশ্চিমাদের চাপিয়ে দেয়া মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলেও বিরোধী দল প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিতে পারে নাই। বিরোধী দল মানেই নির্যাতনের শিকার, এ মনোভাব নিয়েই ১৯৪৭ এর পর থেকে রাজনৈতিক মঞ্চ পরিচালিত হয়ে আসছে। যে দেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা রয়েছে সে দেশের দিকে তাকালে বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক বা বিরোধী দলের প্রতিষ্ঠানিক অবস্থা খুঁজে পাওয়া যায় না। ব্রিটেনের পার্লামেন্ট রাণীর নেতৃত্বাধীন পার্লামেন্ট। সেখানের ট্রেজারি বেঞ্চ (সরকারি দল) এবং বিরোধী দলেরও একটি ছায়া মন্ত্রিসভা থাকে এবং সরকারি ও বিরোধী উভয়ই রাণীর। ছায়া মন্ত্রিসভার অনেক দায়িত্ব রয়েছে, যার দায়িত্ব সরকারের মন্ত্রণালয়ের কার্যক্রমের প্রতি তিক্ষ্ন দৃষ্টি রাখা এবং যেখানে ব্যত্যয় হবে সে বিষয় জনগণের সম্মুখে তুলে ধরা, প্রতিবাদ করা, পরামর্শ প্রদান প্রভৃতি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই যে, আমাদের রাজনৈতিক বা পার্লামেন্টারি ব্যবস্থায় সে অবস্থা নাই। তদুপরি একই জোটের বিরোধী দল হওয়ার সমস্ত কর্তৃত্বই এখন থাকবে প্রধানমন্ত্রীর হাতে। কথিত বিরোধী দল ব্রিটেনের রাণীর আদলে চলতে হবে যা হবে প্রধানমন্ত্রীর নেতৃত্বাধীন ট্রেজারি কেঞ্চ এবং বিরোধী দল। ফলে পার্লার্মেন্টারি পরিবেশে সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী নিরাপদ আবস্থানেই থাকবেন। এখন পার্লামেন্ট হবে সমালোচনা বা প্রতিবাদের কেন্দ্রবিন্দু নয়, বরং প্রশংসার কেন্দ্রবিন্দু। হয়তো দেখা যাবে প্রতিবাদকারীদের দমানোর জন্য রাজপথে গুলি হয়েছে, কিন্তু পার্লামেন্টে পয়েন্ট অব অর্ডারে বক্তব্য রাখার জন্য কেউ নাই। বাস্তবসম্মত বিরোধী দলের পরিবর্তে ব্যাকরণিক বিরোধী দল হলে এ ধরনের আন্দাজ করাটা অমূলক নয়।
লেখক : কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।