চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক
॥ শেষ কিস্তি ॥
কর্ডোভাতে মুসলমানরা যে স্থাপত্য পদ্ধতি উদভাবন করল তা টলোডোসহ বিভিন্ন স্পেনীয় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এর ভিতর রয়েছে ঘোড়ার নালের আকৃতিতে খিলান ও অন্যান্য পদ্ধতি। টলেডোতে মুসলমানরা সঙ্গীত স্কুলও প্রতিষ্ঠা করে অন্যান্য শহরের মতো যেমন কর্ডোভা, সেভিল, ভ্যালেনসিয়া ও গ্রানাডা।
স্পেনে ইসলাম প্রবেশ করলে সেখানকার বুদ্ধিজীবীদের ভিতেরও এর প্রভাব পড়ল। টলেডো শহরের বিশপ এলিপ্যানডাস (খ্রিস্টাব্দ ৮১০) বিশ্বাস করলেন যে যীশু খোদার পুত্র জৈবিকভাবে নন, দত্তকের মতো পুত্র। তিনি ইসলামের সংস্পর্শে এসেই এই ধারণা দিয়েছিলেন (প্রফেসর টমাস আরনল্ড, ‘দি স্প্রেড অব ইসলাম ইন দি ওয়ার্লড,’ পৃষ্ঠা ১৩৯)। এই যে এই নতুন তত্ত্ব তা স্পেনের বহু জায়গাতে ছড়িয়ে পড়েছিল এমনকি দক্ষিণ ফ্রান্সে পর্যন্ত প্রসারিতও হয়। ফ্রান্সের খ্রিস্টান রাজা শার্লিমেন এ ধারণার বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেন। ৯৩৬ খ্রিস্টাব্দে টলেডোতেই খ্রিস্টানরা একটি কাউন্সিল সভা করে মুসলিম প্রভাবে এ ধরনের ধারণা যেন খ্রিস্টানরা না করে তা নিশ্চিত করতে। উদারচেতা মুসলমান শাসকরা এ ধরনের ধর্মীয় সভার কোন বিরোধিতা করেননি।
মুসলিম স্থাপত্য কর্ডোভাতে প্রথম পরিস্ফুট হয়। তারপর তা টলেডো, সারাগোসা ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ শহরে ছড়িয়ে পড়ে। ইটের কাজে এটা বেশি স্পষ্ট। টলেডোর ইমারতে ‘ডামি’ খিলান লাগানো হয়। একে ‘ব্ল্যাংক আরকেডিং’ও বলা হয়। এছাড়া মুসলমানরা টলোডো থেকে উৎখাত হলেও বিজিত মুসলমানদের ‘মুদেজার’ স্থাপত্য টলেডোতে থাকে। এ সময়ের তৈরি গির্জাতে মুসলিম রীতির প্রভাব পড়ে। (“দি লিগেসি অব ইসলাম”, সম্পাদক আরনল্ড ও গুইলম, পৃষ্ঠা ১১-১৩)।
টলেডোতে মুসলিম জ্যোতির্বিজ্ঞানীরা সমুদ্রের নাবিকদের ব্যবহারের উপযোগী এস্ট্রোলেব যন্ত্র তৈরি করতেন। এসব যন্ত্র ছাড়া সে যুগে সমুদ্র পরিবহন অসম্ভব ছিল। এ, এইচ, ক্রিস্টি লিখেছেন যে, একটা এস্ট্রোলেব তৈরি করেছিলেন টলোডোর ইব্রাহিম ইবনে সৈয়দ ১০৬৬-৬৭ খ্রিস্টাব্দে। (“দি লিগেসি অব ইসলাম”, পৃষ্ঠা ১১৫)।
বনু আল লূনের আমলে টলেডোর কাজী ছিলেন আবু আল কাসিম সৈয়দ ইবন-আহমদ আল-আন্দালুসী (১০২৯-৭০)। তিনি লেখেন একটি বিখ্যাত বই “তাবাকাত আল-উমাম” (জাতির শ্রেণী বিভাগ)। এটি বহু প্রখ্যাত পরবর্তী প-িতগণ ব্যবহার করেন তাদের লেখালেখিতে। সৈয়দ ছিলেন একাধারে ইতিহাসবিদ, গণিতবিদ ও জ্যোতির্বিদ। টলেডোর আর একজন স্পেনীশ-আরব জোতির্বিদ ছিলেন আল-জারকালি (১০২৯-১০৮৭)।
জ্যোতির্বিদ্যায় যে টলেডো ‘টেবিল’ বলা হয় তার মূলে ছিলেন স্পেনীশ-মুসলমান ও ইহুদি জ্যোতির্বিদগণ। তন্মধ্যে ছিলেন আল-জারকালি ও আবু ইসহাক ইব্রাহিম ইবন-ইয়াহিয়া (১০৮৭ খ্রিস্টাব্দ)।
এই সব ‘টেবিল’ ল্যাটিন ভাষায় অনুবাদ করেন ক্রেমোনার গেয়ার্ড। ফ্রান্সের মারসেলের রেমন্ড (১১৪০ খ্রি.) যেসব লেখা লিখেছেন তার প্রায়টাই আল-জারকালির জ্যোতির্বিজ্ঞানের কানুন থেকে নেয়া। টলেমী ভূমধ্যসাগরের দৈর্ঘকে বেশি মাত্রায় ৬২ ডিগ্রিতে দেখান, আল-খারিজিমি তা কেটে করেন ৫২ ডিগ্রি, আর আল-জারকালি তা প্রায় শুধু ৪২ ডিগ্রিতে নামান। আল-জারকালি তার সময়ের শ্রেষ্ঠ জ্যোতির্বিজ্ঞানী ছিলেন। যার স্বীকৃতি টলেডোর কাজী সৈয়দ আন্দালুসী পর্যন্ত দেন। তিনি এস্ট্রোলেবের (জ্যোতির্বিজ্ঞানে ব্যবহৃত এক ধরনের কম্পাস যন্ত্র) উন্নত সংস্করণ বের করেন। নাম “সাফিহা”।
আল-জারকালি (আরজ্যাকেল-১০২৯-১০৮৭) সম্পর্কে কারা ডি ভক্স লেখেন, তিনি একজন প্রখ্যাত যন্ত্র প্রস্তুতকারক ছিলেন। তিনি তার উদভাবিত ‘এস্ট্রোলেব’ (নাম ‘সফিহা’) নিয়ে একটি গবেষণা সন্দর্ভ লেখেন যার উপর ভিত্তি করে একটি পুরো সাহিত্য গড়ে উঠে। দক্ষিণ ফ্রান্সের মন্টপেলিয়ারের এক ইহুদি এটি লাটিনে অনুবাদ করেন। এম আকবর আলী বলেন, আল-জারকালির এস্ট্রোলেবের উপর বর্ণনা হিব্রু ও অন্যান্য ইউরোপীয় ভাষাতেও অনুবাদ হয়। (“আসপেকট অব সাইন্স ইন রিলিজিয়নস”, এম আকবর আলী, পৃষ্ঠা ৮৬৭)। ক্যাসটাইলের রাজা অলফনসো দুটো অনুবাদ করেন এর রোমান্স (স্পেনীশ) ভাষাতে। রেজিও মনটেনিয়াস পঞ্চদশ শতাব্দীতে “প্রখ্যাত যন্ত্র সফিহা” সংক্রান্ত গাইডবুক প্রকাশ করেন। কোপারনিকাস আলবাত্তানী (আলবাটেগনিয়াস) নামে আর এক মুসলিম জ্যোতিবিজ্ঞানীসহ আরজ্যাকেল অর্থাৎ আল-জারকালিকে উল্লেখ করেন তার প্রখ্যাত গ্রন্থে। ত্রয়োদশ শতাব্দীতে যে জ্যোতির্বিদ্যা সম্পর্কীয় আলফোনসাইন টেবিলসমূহ প্রকাশ করেন দশম আল ফোনসো তা হোল আরব জ্যোতির্বিদ্যার অংশ বিশেষ। এতে যে দ্রাঘিমাসমূহ দেখানো হয়েছে তাতে টলেডোকে কেন্দ্র করে তা দেখানো হয়। এম আকবর আলী লেখেন, আল জারকালি টলেডোর প্রাসাদে একটি পানি ঘড়ি তৈরি করে ছিলেন (পৃষ্ঠা ৮৬৬)।
তিনি তারকারাজির সঙ্গে সৌরগতির সম্পর্ক নিয়ে সর্ব প্রথম প্রমাণ উপস্থাপন করেন। তার হিসাব মতে সে হিসাব হলো বছরে ১২. ০৪”, তবে প্রকৃত পক্ষে ১১.৮। খুবই সামান্য তফাৎ সেই যুগের গবেষণাতেও। পাশ্চাত্যের খ্রিস্টান জ্যোতির্বিদ কোপারনিকাস আল-জারকালি (আরজ্যাকেল নামে)ও আর একজন প্রখ্যাত মুসলিম জ্যোতির্বিদ আল বাত্তানীকে উদ্ধৃত করেন তার “ডি রিভোলিউসনিবাস” ইত্যাদি নামক গ্রন্থে। (হিট্টি, পৃষ্ঠা ৫৭১-৫৭২)। মুসলিম স্পেন ভেঙ্গে পড়তে থাকলেও, মুসলিম প-িতগণ তাদের ইজতিহাদ বন্ধ করেননি তখনও।
টলেডো খ্রিস্টানদের হাতে চলে গেলেও দু’শতাব্দী পর্যন্ত আরবী ভাষা সেখানে আইন ও ব্যবসার ভাষা হিসাবে ব্যবহৃত হয়। টালোডোর খ্রিস্টান রাজা ষষ্ঠ আলফনসো ও তার কয়েক উত্তরাধিকারী তাদের মুদ্রায় আরবী ছাপ দিতেন। উল্লেখ্য যে আরাগনের প্রাথমিক এক রাজা প্রথম পিটার (১১০৪ খ্রিস্টাব্দ) শুধু মাত্র আরবী লিখতে পারতেন (হিট্টি, পৃষ্ঠা ৫৪৩)।
আর্নেস্ট বার্কার লেখেন, টলেডো যখন খ্রিস্টানদের হাতে পুনর্দখল হোল, টলেডো মসজিদের লাইব্রেরিও তাদের দখলে গেলে তা থেকে তারা ফায়দা হাসিল করে। (“দি লিগেসি অব ইসলাম,”, পৃষ্ঠা ৫৫)।
টলেডো থেকেও মুসলমানদের চিকিৎসা বিজ্ঞানসহ অন্যান্য জ্ঞান-বিজ্ঞান ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ে। টলেডোতে বসে ক্রিমোনার গেরার্ড ও মিকায়েল স্কট আরবী থেকে অনুবাদ কর্ম জ্ঞানকে ছড়িয়ে দিচ্ছিলেন ইউরোপে।
টলেডো শহর অনুবাদ কর্মের একটা বড় কেন্দ্র হওয়ার কারণ হল টলেডো মুসলমানদের হাত ছাড়া হয়ে গেলেও (১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে) স্পেনের বাকি মুসলিম এলাকার এটি খুব নিকটবর্তী। গ্রানাডা থেকে মুসলমানরা উৎখাত হল ১৪৯২ সালে, আরো প্রায় চারশো বছর পরে। বাকি ইউরোপ তখনও অন্ধকারে। তাই মুসলমানদের উপর সামরিক আঘাত হানলেও খ্রিস্টান ইউরোপ মুসলমানদের উন্নত জ্ঞান-বিজ্ঞান হাতড়াতে লাগল। মুসলিম এলাকার লাগোয়া তখনকার খ্রিস্টান টলেডো স্বাভাবিক একটা কেন্দ্রে পরিণত হোল এই গ্রন্থ সংগ্রহের অনুবাদ কর্মের। হিট্টি বলেন, ১০৮৫ খৃস্টাব্দে টলেডো খ্রিস্টানরা নিয়ে নিলেও এর মুসলিম শিক্ষা কেন্দ্রগুলো রয়ে যায়। ব্রিটেন থেকেও বিদ্যোৎসাহীরা টলেডোতে ভিড় জমালেন। তন্মধ্যে ছিলেন স্কটল্যান্ডের মিকায়েল স্কট (১২৩৬ খ্রিস্টাব্দ) ও চেষ্টারের রবার্ট। ১১৪৫ সালে রবার্ট আল-খারিজমির এলজেবরার অনুবাদ করলেন। ১১৪৩ সালে তিন হারমান দি ডালমাসিয়ানের সঙ্গে মিলে কোরআনের প্রথম ল্যাটিন অনুবাদ করলেন। এমনকি মুসলমান ও ইহুদিদের ভিতর খ্রিস্টানী মতবাদ করতে ইউরোপের প্রথম প্রাচ্য বিষয়ক স্কুল প্রতিষ্ঠিত হোল টলেডোতে ১২৫০ খ্রিস্টাব্দে “অর্ডার অব প্রিচারস” নামক এক গোষ্ঠীর দ্বারা। টলেডোতে থাকাকালীন সময়ে মিকায়েল স্কট অনেক গ্রন্থের সঙ্গে আল-বিটরুজির জ্যোতির্বিদ্যার গ্রন্থ “আল-হায়া”, ইবনে রুশদের ব্যাখ্যাসহ এরিস্টটলের কিতাব অনুবাদ করলেন। তবে সবচেয়ে বেশি বই অনুবাদ করেন টলেডোতে বসে ক্রিমোনার গেরার্ড।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।