চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
ড. মুহাম্মদ সিদ্দিক
॥ এক ॥
টলেডোতে বানু যুন-নুন (১০৩২-৮৫ খ্রিস্টাব্দ) নামে উত্তর আফ্রিকার এক বারবার উপজাতির মুসলমান গোষ্ঠী বিদ্রোহ করে ছোট্ট রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। মূল মুসলিম শক্তি এভাবে খ- খ- হলে টলেডো ও অন্যান্য শহরের মতো খ্রিস্টান অধিকারে চলে গেল। লিওন ও ক্যাসটাইলের খ্রিস্টান রাজা ষষ্ঠ আলফনসো টলেডো মুসলমানদের হাত থেকে ছিনিয়ে নিলেন ১০৮৫ খ্রিস্টাব্দে। রাষ্ট্রকে টুকরা টুকরা করে মুসলমানরা এইভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হোলো। মুসলমান কর্মকর্তারা স্বার্থের জন্য আত্মহত্যা করলেন এভাবে।
আন্দালুসিয়ায় উম্মিয়া খিলফত বিলুপ্ত হলে বানু যুন-নুন বংশ টলেডোতে ক্ষমতাশীন হয়। তারা ছিলেন উত্তর-আফ্রিকার বারবার বংশোদ্ভূত মুসলমান অভিজাত বংশ। তারা সামরিক বাহিনীতে কর্মরত ছিলেন এর পূর্বে। এরা ৪২৭ হিজরী বা ১০৩৫-৩৬ সালে টলেডোর স্থানীয় ক্ষমতায় আসেন। সৈয়দ আমীর আলীর মতে তারা ছিলেন খুবই শান-শওকতের অধিকারী। (হিস্টরি অব দি সারাসেনস, পৃষ্ঠা ৫৩০)। তবে এই বংশের পরবর্তী শাসক ইয়াহিয়া আল-কাদির বিন-ইসমাইলের সময় মিত্রদের বিশেষ করে গুরুত্বপূর্ণ সেভিল শহরের শাসকের দ্বারা পরিত্যক্ত হলে উঠতি খ্রিস্টান রাজা ক্যাসটাইল ও লিওনের ষষ্ঠ আলফনসো-এর মিত্রতা গ্রহণে তিনি বাধ্য হন। তবে কর প্রদানে বাধ্য করা হয় আল-কাদিরকে। বিদেশি চাপে কর বৃদ্ধি হতে থাকে। আল-কাদির তখন প্রয়োজনে কর বাড়ালে জনসাধারণ বিদ্রোহী হলে করারোপ বন্ধ হয়। তবে তিনি কয়েকজন প্রভাবশালী ব্যক্তিকে বিদ্রোহের কারণে প্রাণদ-ে দ-িত করলেন। এতে জনগণ আরো রাগান্বিত হলে তিনি টলেডো ছেড়ে যান। টলেডো রাজ্যটি বাদাজোসের ক্ষুদ্র আফতাসীয় রাজা আল-মুতাওয়াক্কিল গ্রহণ করেন (৪৭২ হিজরী তথা ১০৭৭ খ্রিস্টাব্দ)।
তবে কিছুকালের ভিতর খ্রিস্টান রাজা ষষ্ঠ আল ফনসো তার নামমাত্র মিত্র বিতাড়িত মুসলিম শাসক অলকাদিরের সঙ্গে মিলে আল কাদিরের জন্য টলোডো জয় করলেন। কিন্তু এটা ছিল খ্রিস্টান রাজার একটা ফাঁদ। ২৭ মুহাররাম, ৪৭৮ হিজরী তথা ২৫ মে, ১০৮৫ সালে ক্যাসটাইল-লিওনের খ্রিস্টান রাজা আলফনসো আল কাদিরের সঙ্গে একটি সন্ধি চুক্তি করেন। আলফনসো এর বাহানায় নিজেই টলেডো দখল করলেন আল-কাদিরকে না দিয়ে। সেই যে ১০৮৫ সালে মুসলমানরা টলেডো হারালো আর কেউই-না পরবর্তী মুরাবিত, না মুওয়াহহিদ বংশের মুসলিম শাসকবৃন্দ টলেডো পুনরুদ্ধার করতে সক্ষম হয়েছিলেন। টলেডো ক্যাসটাইলের খ্রিস্টান রাজাদের রাজধানীতে পরিণত হলো আবার। হায় হতভাগা মুসলিম নেতারা!
টলেডের পুনর্বার জয় করতে দুবার ব্যর্থ অবরোধ করে মুসলমানরা। ষষ্ঠ আলফোনসোর মৃত্যুর পর একবার, আর ৫৯২ হিজরী তথা ১১৯৫ সালে আল-মুওয়াহহিদ শাসক আবু য়ুসুফ আল-মনসুর কর্তৃক আর একবার। তারা পার্শ্ববর্তী মাদ্রিদ শহর, কালাট্রাভা, গুয়াডালাজারা প্রভৃতি স্থান দখল করেন, তবে টলেডোর কিল্লাকে জয় করা যায়নি। এটি সুরক্ষিত একটি শহর ছিল প্রাকৃতিকভাবেও।
বনু হুদ বংশ ১১১৮ সাল পর্যন্ত সারাগোসা দখলে রাখল যখন খ্রিস্টান রেমিরের নেতৃত্বে তা হাতছাড়া হলো তখন। বাডাজোস, ভেলেনসিয়া, মুরসিয়া ও আলমেরিয়া পৃথক পৃথক স্বাধীন নেতার দখলে গেল। ডেনিয়া ও ভূমধ্য সাগরীয় দ্বীপগুলো মুজাহিদ বিন আব্দুল্লা আল আমিরির স্বাধীন দখলে গেল।
মুসলমান নেতাদের এই অবস্থা দেখে ১০৫৫ সালে কাসটাইল ও লিওনের রাজা প্রথম ফার্দিনান্দ মুসলমানদের বহু স্থান দখল করে নিলেন। এসব স্থান দখলের পরে খ্রিস্টান রাজা যে বর্বর ব্যবহার বিজিত সাধারণ মুসলমানের সঙ্গে করেছেন তা বর্ণনার অতীত। প্রতিটি শহরে বসনিয়ার ¯্রেেবনিকা বা রেড ইন্ডিয়ান হত্যার মতো পরিস্থিতি করা হয়। ব্যাবাসস্ট্রো দখলের পরে মুসলিম গণহত্যা ছিল অবর্ণনীয়। যুদ্ধের সময় সৈনিক হত্যাকে স্বীকৃতি দিলেও যীশুর অনুসারীরা দখল সমাপ্তের পরেও সাধারণ নারী-শিশু-বৃদ্ধ কাউকেও রেহাই দিত না। মুসলমানরা বিজয়ের পরে কমই গণহত্যা করে। তবুও খ্রিস্টানরা নাকি সভ্য, আর মুসলমানরা সন্ত্রাসী, অসভ্য! রেকর্ড তো বলে উল্টো। বিজয় লাভের পর বেসামরিক মানুষ হত্যা হলো গণহত্যা, বর্বরতা। যীশুর নামে তা কিভাবে করা হতে পারে?
সেভিলের মুসলিম রাজা মুতাজিদ লিওনের খ্রিস্টান রাজাকে কর দিয়ে বিপদ এড়ান। ১০৬৫ সালে ষষ্ঠ আলফনসো ক্যাস্টাইলের সিংহাসনে বসেন। তার ভাইদের বিতাড়িত করে ক্যাসটাইলসহ লিওন, গ্যালিসিয়া ও ন্যাভাররে দখল করলেন তিনি। ১০৮৫ সালে তিনি টলেডো দখল করলেন টলেডোর যুন-নুন বংশের শেষ মুসলিম রাজা কাদিরের হাত থেকে।
টলেডোকে যে সময় খ্রিস্টানরা দখল করলো তখন উম্মিয়া খিলাফত ছিন্নবিচ্ছিন্ন। আর টলেডোতে স্বাধীন শাসক ছিলেন এক দুর্বল মুসলমান। এই ছোট্ট স্বাধীন রাজ্যের পক্ষে অসম্ভবপর ছিল সম্মিলিত খ্রিস্টান কোয়ালিসন হামলা প্রতিহত করার। একে প্রতিরক্ষায় অর্থ কমে গেছে রাজ্যটি ক্ষুদ্র হওয়ায়, তার উপর ভিতর থেকে ইহুদীরা বিশ্বাসঘাতকতা করল। অথচ মুসলামনরা স্পেনে আসার পূর্বে ইহুদীরা যে কি নির্মম পরিস্থিতিতে ছিল তা তারা ভুলে গেছে। মুসলমানরা প্রথমে টলেডো জয় করে প্রশাসনের দায়িত্ব স্থানীয় ইহুদিদের হাতে তুলে দেয়। ইহুদিরা সাময়িক লাভে খ্রিস্টানদের ডেকে আনল। তবে অচিরেই তারা দেখতে পেল যে তারা সমূলে শুধু টলেডো থেকে নয়, সমগ্র স্পেন থেকে উৎখাত হচ্ছে। আর দরাজদিল মুসলমানরা ইহুদিদের উত্তর আফ্রিকা ও তুর্কী সা¤্রাজ্যে আবার আশ্রয় দিচ্ছে। সেই ‘ইহুদিরাই এখন মধ্যপ্রাচ্য মুসলমান নিধন ও মুসলিম এলাকা জয়ে মাতোয়ারা। তবে কথা হোল, এক মাঘে শীত যায় না। সামনে আরো বছর, আরো শীত আসবে। ইহুদিরা যে মুসলমানদের অন্যতম শত্রু তা কোরআন স্পষ্ট করেছে।
১৩৯১ খিস্টাব্দে টলেডোর ইহুদিদের উপর খ্রিস্টানরা চড়াও হয়ে শত শত জনকে হত্যা করল। ১৪৯২ খ্রিস্টাব্দে রানী ইসাবেলা রাজা ফার্ন্দিনান্দের হুকুমে টলেডোসহ সমগ্র স্পেন থেকেই ইহুদিরা বিতাড়িত হয়ে আরবও তুর্কী মুসলিম দেশগুলোর আশ্রয়ে গেল। অন্যদিকে টলেডো তথা স্পেন থেকে মুসলিম বিতাড়নও শুরু হলো। যেসব মুসলমানকে বাধ্য করে খ্রিস্টান করা হয়েছিল তারাও তাদের ধর্ম গোপনে পালন করার সময় ধরা পড়ে হয় আগুনে পুড়ে নিহত, না হয় বিতাড়িত হোল। টলেডোর দুর্দিন তখন থেকেই শুরু হোল। টলেডো আর তার সুদিন ফিরে পায়নি। টলোডো এখন প্রায় প্রত্যাখ্যাত একটি শহর।
মুসলমানরা টলেডো শহরে উন্নত তরবারি তৈরি পদ্ধতি নিয়ে যায়। দামাস্কাসের ন্যায় টলেডোর ইস্পাত ও জগদ্বিখ্যাত হয়ে উঠে। (হিট্টি, পৃষ্ঠা ৫২৮)। ইস্পাত ও অন্যান্য ধাতব পদার্থে সোনা, রুপা দিয়ে ফুলের মতো করে সাজসজ্জা করার পদ্ধতি দামাস্কাস থেকে টলেডো ও অন্যান্য স্পেনীয় ও ইউরোপীয় শহরে ছড়িয়ে পড়ে। এমনকি ‘দামাস্কাস’ শব্দটা পর্যন্ত পাশ্চাত্যের ভাষায় ঢুকে পড়ে, ইংরেজি ‘দামাসসেন’ ‘দামাসকেন’, ফরাসী। ‘দামাসকুইনের’, ইটালিয়ান ‘দামাসকিনো’ হোল এই সব শব্দ যার মূল হল ‘দামাস্কাস’।
টলেডো ও সেভিলের ধাতব দ্রব্য-খুব নাম করা ছিল। চামুচ ও অন্যান্য রন্ধনশালার সামগ্রী, তরবারি, এস্ট্রোলেব ছিল জনপ্রিয়। দামাস্কাসের পরেই টলেডোর তরবারি পৃথিবী বিখ্যাত। টলেডো শহর মুসলিম আমলে তৈজসপত্র প্রস্তুতে বিখ্যাত ছিল। সেখানকার চীনামাটির দ্রব্যাদি ছিল খুবই উন্নত।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।