Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

পাকিস্তান আমলে পূর্ব পাকিস্তান ও বাংলা ভাষার অবমূল্যায়ন

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ১৪ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৪ এএম

পাকিস্তান আমলে বাংলা ভাষার অবমূল্যায়নে কোন চেষ্টাই বাকী রাখেনি সরকার। প্রথমে তো চেষ্টা করা হয় তদানীন্তন পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার মেজরিটি জনগোষ্ঠীর ভাষা বাংলাকে অবহেলা করে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসাবে জনগণের উপর চাপিয়ে দিতে। এর পিছনে যে কারণ ছিল তা হল পাকিস্তান সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দু ভাষীদের বিপুল সংখ্যাধিক্য। পাকিস্তান সরকারের উচ্চ পদস্থ কর্মকর্তাদের মধ্যে উর্দুভাষীদের বিরাট প্রভাব থাকায় তারা পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে আনুষ্ঠানিক কোন সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগেই উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ধরে নিয়ে পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয়ের হবার পর পরই পোস্ট কার্ড, মানি অর্ডার ফর্ম, পোস্টার এনভেলাপ প্রভৃতিতে বৃটিশ আমলের ইংরেজী ভাষার পাশাপাশি শুধু উর্দু ব্যবহার শুরু করে দেন।
এর ফলে পূর্ব পাকিস্তানের সাধারণ শিক্ষিত সমাজের কাছে ব্যাপারটি ধরা পড়ে যায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট পাকিস্তান রাষ্ট্রের অভ্যুদয় হওয়ার পর পর নতুন রাষ্ট্রের সাংস্কৃতিক ভিত্তি জোরদার করবার উদ্দেশ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থ বিজ্ঞান বিভাগের তরুণ শিক্ষক অধ্যাপক আবুল কাসেমের উদ্যোগে তমদ্দুন মজলিস নামের একটি সাংস্কৃতিক সংস্থার জন্ম হয়। এই সংস্থার দৃষ্টি আকৃষ্ট হয় পোস্টকার্ড, পোস্টাল এনভেলাপ, ষ্ট্যাম্প, কোন অর্ডার ফর্ম প্রভৃতিতে ইংরেজীর পাশাপাশি শুধু উর্দুর ব্যবহারের মধ্যে তারা পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাকে অবমূল্যায়নের যে পরিকল্পিত অপপ্রয়াস দেখতে পান, তার বিরুদ্ধে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার যে আন্দোলন গড়ে তোলেন, ইতিহাসে রাষ্ট্রভাষা তথা ভাষা আন্দোলন হিসাবে তারা সেটাই পরিচিতি লাভ করে।
বর্তমানে অনেকে ভাষা আন্দোলন বলতে শুধু উনিশ শো বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর রক্তাক্ত ঘটনার কথা মনে করে থাকেন। যদিও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে উনিশ শো বায়ান্ন সালের একুশে ফেব্রুয়ারী লাল হরফে লেখা একটা দিন হিসাবে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি লাভে ধন্য হয়েছে, তবুও ভাষা আন্দোলন কিছুতেই উনিশ’শো বায়ান্নো সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল না। উনিশ শো বায়ান্নো সালের একুশে ফেব্রুয়ারীর আগে আটচল্লিশে বাংলাভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার দাবীতে আরেকটি সফল অভ্যুত্থান সংঘটিত হয়। সেটি ছিল ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ। করাচীতে অনুষ্ঠানরত পাকিস্তান গণপরিষদের সে অধিবেশনে কংগ্রেস দলীয় সদস্য বাবু ধীরেন্দ্র নাথ দত্ত ইংরেজী ও উর্দুর পাশাপাশি পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগোষ্ঠীর মাতৃভাষা বাংলাতেও সদস্যদের কথা বলার সুযোগ দাবী করেন। যে দাবী প্রত্যাখ্যাত হয়। এই প্রত্যাখ্যানের বিরুদ্ধে ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে হরতাল পালিত হয়।
ভাষা আন্দোলনের স্থপতি প্রতিষ্ঠান তমদ্দুন মজলিসের নেতাদের সঙ্গে রেলওয়ে কর্মচারী লীগের নেতাদের সুসম্পর্ক থাকায় ঐ দিন চট্টগ্রাম থেকে কোন ট্রেন ঢাকার উদ্দেশ্যে রওনা হতেই সফল হয়নি। রাজধানী ঢাকার অবস্থা ছিল আরও ভয়াবহ। ঐ দিন সকাল থেকেই সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে পিকেটারদের দ্বারা ঘেরাও থাকায় বহু কর্মকর্তা ও কর্মচারী অফিসে ঢুকতেই পারেননি। তখন সেক্রেটারিয়েটের চারদিকে এখনকার মত পাকা দেয়াল ছিল না। ছিল কাঁটাতারের বেড়া। কাঁটাতারের বেড়া ডিঙ্গিয়ে অনেক পিকেটার সেক্রেটারিয়েটের ভেতরে প্রবেশ করে সচিব ও কর্মকর্তা কর্মচারীদের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে সরকার বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা না করলে চাকুরী থেকে ইস্তফা দিতে তাদের রাজী করিয়ে আসেন। পুলিশ পিকেটারদের অনেককে লাঠিচার্জ করে এবং অনেককে গ্রেপ্তার করে। পিকেটারদের উপর পুলিশের লাঠিচার্জ এবং গ্রেপ্তারের খবর শহরের চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে জনসাধারণের মধ্যে বিক্ষোভ ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ে। ফলে কিছুক্ষণের মধ্যেই সমগ্র সেক্রেটারিয়েট এলাকা বিক্ষুব্ধ জনসমুদ্রে পরিণত হয়। তাতে সমগ্র ঢাকা মহানগরী বিক্ষুব্ধ জনগণের নগরীতে পরিণত হয় এবং সর্বত্র অরাজকতা সৃষ্টি হয়।
এই অবস্থা চলতে থাকে ১১ মার্চ থেকে শুরু করে ১২, ১৩, ১৪, ১৫ মার্চ পর্যন্ত। এতে তদানীন্তন প্রাদেশিক চীফ মিনিস্টার খাজা নাজিমুদ্দিন ভয় পেয়ে যান। কারণ কয়েক দিনের মধ্যে কায়েদে আজম মুহম্মদ আলী জিন্নাহর ঢাকা সফরে আসার কথা। তিনি ঢাকা এসে যদি ঢাকা মহানগরীর এই অরাজক পরিস্থিতি দেখতে পান, তার নাজিমুদ্দিনের উপর খুশী থাকার কথা নয়। তিনি স্বতপ্রণোদিত হয়ে রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের নেতাদের সাথে যোগাযোগ করে তাদের সকল দাবী দাওয়া মেনে নিয়ে তাদের সঙ্গে চুক্তি স্বাক্ষর করেন।
চুক্তি স্বাক্ষর করায় পরিস্থিতি আপাতত শান্ত হয়ে আসে। এরপর কায়েদে আজম যথাসময়ে ঢাকা আসেন। তিনি রেসকোর্স ময়দানে একটি বিশাল জনসভায় ভাষণ দেন। কার্জন হলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন উৎসবেও তিনি ভাষণ দান করেন। কায়েদে আজম উভয় স্থানেই ইংরেজীতে ভাষণ দান করেন এবং উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা করার পক্ষে বক্তব্য দেন। উভয় সভায় তাঁর বক্তৃতার প্রতিবাদ হয়।
রেসকোর্সের মাঠে বিশাল জনসভায় কোণ দিক থেকে তাঁর বক্তৃতার প্রতিবাদ ওঠে, তা তিনি খেয়াল করতে না পারলেও কার্জন হলের সমাবর্তন উৎসবে সীমিত সংখ্যক উপস্থিতির মধ্য থেকে ওঠা ‘নো’ ‘নো’ প্রতিবাদ ঠিকই তিনি বুঝতে পারেন। তিনি বিস্ময়ে হতবাক হয়ে যান, যে তরুণ ছাত্র সমাজ এই সেদিন পর্যন্ত পাকিস্তান আন্দোলনে তার নেতৃত্বে যে কোন ঝুঁকি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে, তারা রাতারাতি এমন বদলে গেছে কী করে। তিনি কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে বক্তৃতা সংক্ষেপ করে সভাস্থল ত্যাগ করেন।
এরপর তিনি ছাত্রনেতাদের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনায় বসেন। কিন্তু আলোচনায় দুই পক্ষই যার যার বক্তব্যে অটল থাকায় আলোচনা সফল হতে পারেনি। তবে একটা বিষয় ছিল লক্ষণীয়। ঐ বছরে (১৯৪৮ সাল) ১১ সেপ্টেম্বর তাঁর ইন্তেকাল পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রভাষা সম্পর্কে আর কোন প্রকাশ্য বক্তব্য দেননি। শুধু তাই নয়। মৃত্যু-শয্যায় তাঁর ব্যক্তিগত চিকিৎসক কর্ণেল এলাহি বখশকে কয়েক বার একটি কথা বলেন, জীবনে অন্যের কথা বিশ্বাস করে কয়েকটি ভুল করেছি। এর একটা ছিল রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে। বিষয়টি আমার গণপরিষদের উপর ছেড়ে দেয়া উচিৎ ছিল।
বিশ্বস্থ সূত্রে জানা যায় ‘অন্যের কথা’ বলতে তিনি খাজা নাজিমুদ্দিনকে বুঝিয়েছেন। নাজিমুদ্দিন পারিবারিকভাবে উর্দুভাষী ছিলেন এবং মনে করতেন পূর্ব পাকিস্তানের সকল লোকই উর্দু ভাষা বোঝেন।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে, খাজা নাজিমুদ্দিন ১৯৪৮ সালে বাংলা রাষ্ট্র ভাষা সংগ্রাম পরিষদের সঙ্গে যে চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, সে বিষয়ে তিনি আন্তরিক ছিলেন না। আন্তরিক ছিলেন না বলে তিনি ১৯৪৮ সালের ১৫ মার্চ শুধু তিনি পরিস্থিতি শান্ত করার লক্ষ্যে এ চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন। তিনি রাষ্ট্রভাষা উর্দুর সমর্থক ছিলেন বলেই ১৯৫২ সালের জানুয়ারী মাসে পলন্ট ময়দানে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষার করার সংকল্প ঘোষণা করে রাষ্ট্রভাষা ইস্যুকে পুনজীবিত করেন। সে নিরিখে বায়ান্ন সালের রক্তাক্ত ঘটনাবলীর জন্য প্রকৃত পক্ষে দায়ী ছিলেন নাজিমুদ্দিন।
প্রধানত রাষ্ট্রভাষা প্রশ্নে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দের দ্বিমত থাকার কারণেই পাকিস্তানের সংবিধান রচনা অনেক বিলম্বিত হয়ে যায়। এই অস্বাভাবিক বিলম্বের জন্য দায়ী এক শ্রেণীর পশ্চিম পাকিস্তানী (বর্তমানে পাকিস্তানী) নেতারাই যে মূলত দায়ী তার প্রমাণ জুলফিকার আলী ভুট্টোর মতো স্বার্থান্ধ নেতৃবৃন্দ। পাকিস্তান অবিভক্ত থাকা অবস্থায় পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের আর্মি নেভী ও এয়ার ফোর্স-সহ সকল সামরিক বিভাগের সদর দফতরই ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে অথচ পাকিস্তানের অধিকাংশ জনগোষ্ঠী বাস করতো পূর্ব বঙ্গ তথা পূর্ব পাকিস্তান। জনসংখ্যার নিরিখে তদানীন্তন পূর্ব বঙ্গ বা পূর্ব পাকিস্তান যে শুধু বঞ্চিত ছিল, তাই নয় পাকিস্তান আন্দোলনে বাঙালী মুসলমানদেরই অবদান ছিল বেশী এ সত্যও অস্বীকার করার কোন উপায় নেই।
ইংরেজ শাসনের শেষ দিকে ১৯৪৬ সালে বর্তমান পাকিস্তানের কোন প্রদেশে যখন পাকিস্তান আন্দোলন সমর্থক মুসলিম লীগ শাসন কর্তত্বে অধিষ্ঠিত ছিল না, তখন একমাত্র বাংলাদেশেই হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে মুসিলম লীগ মন্ত্রিসভা থেকে পাকিস্তান আন্দোলনে কায়েদে আজমের হাতকে শক্তি যুগিয়ে চলেছিলো। এসব কঠোর বাস্তবতা যদি পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ স্মরণ রাখতেন তাহলে তাদের পক্ষে ১৯৭১ সালে এদেশের জনগণের বিরুদ্ধে টিক্কাশাহী জুলুমবাজি চালাতে পারতেন না। ১৯৭১ সালে টিক্কা খান, ভুট্টো ও জেনারেল ইয়াহিয়া সেদিনের পূর্ব পাকিস্তান তথা আজকের বাংলাদেশের উপর জুলুম বাজির পথে বেছে নিতে পারতেন না।
সে নিরিখে বলতে হয়, এক শ্রেণীর লোক যে তমদ্দুন মজলিসের কোন লোককে দেখলেই তাদের উদ্দেশ্যে বক্রোক্তি করে বলতে চান এরা ভাষা আন্দোলন করে বলেই পাকিস্তান ধ্বংস হয়ে গেছে, একথা আদৌ সত্য নয়। আজকের বাংলাদেশ তথা সেকালের পূর্ব পাকিস্তানের জনগোষ্ঠী যেমন পাকিস্তান আন্দোলনের জন্য সর্ব কৃতিত্বের অধিকারী তেমনি তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তান তথা আজকের পাকিস্তানের ভুট্টো-টিক্কাখান প্রমুখ নেতৃত্বের কারণেই পাকিস্তান ধ্বংপ্রাপ্ত হয়েছে। অন্যদিকে পাকিস্তান আন্দোলনে যেমন বাংলার অবদান ছিল সর্বাধিক, তেমনি পাকিস্তানের উন্নতিতে সর্বাধিক ত্যাগ স্বীকার করে বাংলাদেশী জনগোষ্ঠী।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: পাকিস্তান


আরও
আরও পড়ুন