পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। সম্প্রতি স্কুল শিক্ষার্থীসহ অন্যদের সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হওয়ার প্রতিবাদে নারায়ণগঞ্জে পোশাক শ্রমিকরা সড়ক অবরোধসহ বিক্ষোভ প্রদর্শন করেছে। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক রিপোর্ট থেকে জানা যায়, প্রতিদিন গড়ে ১০ জনের বেশি জীবন কেড়ে নিচ্ছে ঘাতক ট্রাক, বাস ও অন্যান্য যানবাহন। অবস্থা এমন পর্যায়ে দাঁড়িয়েছে যে, মানুষ ঘর থেকে বেড়িয়ে সুস্থ অবস্থায় আবার ঘরে ফিরে আসবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সড়ক দুর্ঘটনার জন্য দায়ী দেশের ট্রাফিক ব্যবস্থা। ট্রাফিক ব্যবস্থাকে যুগোপযোগী ও উন্নত দেশের মতো করতে না পারলে সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না।
অনেকেরই স্মরণ থাকার কথা, ২৯ জুলাই ২০১৮ রবিবার দুপুরে দুটি বাস মিরপুর থেকে বিমানবন্দর সড়কের দিকে আসার সময় ফ্লাইওভারে একে অন্যকে ওভারটেক করার অপখেলায় মেতে ওঠে। যাত্রী ধরার জন্য পাল্লা দিয়ে বাস দুটি ফ্লাইওভার থেকে নামে। এ সময় ফ্লাইওভারের গোড়ার দিকে শহীদ রমিজউদ্দিন ক্যান্টনমেন্ট কলেজের বেশ কয়েকজন শিক্ষার্থী বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলো। তাদের কেউ কেউ দেওয়াল ঘেঁষে হেঁটে যাচ্ছিলো। সামনের দিকে এমন মুহূর্তে ঘাতক বাসটি অপেক্ষমান শিক্ষার্থীদের ওপর চড়াও হলে ঘটনাস্থলে প্রাণ হারায় এইচএসসি প্রথম বর্ষের ছাত্রী দিয়া খানম মীম ও দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র আব্দুল করিম রাজীব। আহত হয় আরও ১২ শিক্ষার্থী। মাওসেতুং বলেছিলেন, ‘কোনো কোনো মৃত্যু পাহাড়ের চেয়েও ভারী।’ কলেজ শিক্ষার্থীদের এ মৃত্যু পাহাড়ের চেয়েও ভারী মনে হয়। চলন্ত বাসের অসুস্থ প্রতিযোগিতার শিকার হয় সম্ভাবনাময় তরুণ শিক্ষার্থীরা। এই বেদনা শুধু শিক্ষার্থীদের পরিবারের নয়, এই বেদনা সমগ্র জাতির। সড়ক দুর্ঘটনা নিয়ে অনেক লেখালেখি, অনেক গবেষণা, অনেক আন্দোলন হচ্ছে। কিন্তু সড়ক দুর্ঘটনা দিন দিন বেড়েই চলছে। এর অন্যতম কারণ, ট্রাফিক আইন লংঘন, চালকদের বেপরোয়া গাড়ি চালানো। সারাদেশে বর্তমানে ফিটনেসবিহীন যানবাহনের সংখ্যা প্রায় পাঁচ লাখ। আর যানবাহনের তুলনায় লাইসেন্সধারী চালকের সংখ্যা নয় লাখের কম। অর্থাৎ নয় লাখ যান চালাচ্ছে ভূয়া বা অদক্ষ চালক। অদক্ষ ও লাইসেন্স বিহীন চালক, ফিটনেসবিহীন যানবাহন সড়ক মহাসড়ককে অনিরাপদ করে তুলেছে। সহপাঠীদের জন্য ন্যায় ও ন্যায়বিচার আর নিরাপদ সড়কের দাবিতে রাজধানীসহ সারা দেশে রাজপথে নেমেছিল স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। শিক্ষার্থীরা জানতে চায়, আর কত লাশের বিনিময়ে শান্তি আসবে। আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা চিৎকার করে জানতে চেয়েছিল, ‘আমার ভাই কবরে, খুনি কেন বাইরে?’ সংবাদ মাধ্যমে বিভিন্ন সময় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়, এমন অসংখ্য ড্রাইভার আছে যাদের কোনো ট্রেনিং নেই, যোগ্যতা যাচাই ছাড়াই লাইসেন্স দেয়া হচ্ছে।
নিরাপদ সড়ক চাই এর চেয়ারম্যান ইলিয়াছ কাঞ্চন বলেছেন, সারা দেশে অসংখ্য অদক্ষ ড্রাইভার গাড়ি চালাচ্ছে। এমন অসংখ্য ড্রাইভার আছে যাদের কোনো ট্রেনিং নেই, যোগ্যতা নেই, তাদের লাইসেন্স দেওয়া হচ্ছে। এমন ড্রাইভারদের হাতে কেউ নিরাপদ নয়। তাদের জন্য সড়কে মৃত্যু, এটা দুঘর্টনা নয় হত্যাকাণ্ড। তিনি বলেন, ঢাকায় গণপরিবহনে যারা ড্রাইভার তারা ড্রাইভিং আইন কানুন জানে না। শুধু গাড়ি চালানো শিখেই সড়কে নেমে পড়ে। রাজধানীতে একের পর এক দুর্ঘটনা সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে মারাত্মক হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে। এধরনের দুর্ঘটনা রাজধানীর বাইরেও ঘটছে। বেশির ভাগ দুর্ঘটনা ঘটে চালকের দায়িত্বজ্ঞানহীন আচরণের কারণে। গত বছর ঢাকা-সিলেট মহাসড়কে মৌলভীবাজারের শেরপুরের কাছাকাছি সরকার বাজারের নাদাম পুর নামক স্থানে সিএনজি ও প্রাইভেট কারের মুখোমুখী সংঘর্ষে একই পরিবারের ৪ জন ও উভয় গাড়ির চালকসহ মোট ৬ জন মর্মান্তিকভাবে নিহত হয়। চালকের অবহেলার কারণে এ ধরনের দুর্ঘটনা প্রায়ই ঘটে থাকে। সা¤প্রতিক সময়ে এধরনের নৈরাজ্যের শিকার হয়ে আরো কয়েকজনের মৃত্যু হয়েছে। দায়ী চালকদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে না পারলে নিরাপদ সড়ক চাই আমাদের প্রত্যাশার বৃত্তেই আটকে থাকবে। গণপরিবহন হয়রানি বেড়েই চলছে। আমাদের দেশের গণপরিবহন ব্যবস্থা যাত্রীবান্ধব নয়। অনেক সময় ভাড়া নিয়ে বাস কন্ডাকটারদের সঙ্গে যাত্রীদের ঝগড়া লাগে। যে কারণে যাত্রার মাঝপথে যাত্রীদের নামিয়ে দেওয়ার মতো ঘটনাও ঘটে থাকে। কখনও মারাত্মক ধরনের অপরাধ করলেও পরিরবহন কর্মীদের খুব সহজে শাস্তির আওতায় আনা সম্ভব হয় না। অনেক সময় চালকের সাজার রায়ের প্রতিবাদে আন্দোলন হয় এবং ভোগান্তি পোহাতে হয় সাধারণ যাত্রীদের। এ অবস্থা থেকে সাধারণ মানুষকে মুক্তি দিতে হবে। রাজধানীতে গণপরিবহনে অপ্রাপ্তবয়ষ্ক ও ড্রাইভিং লাইসেন্সবিহীন অবৈধ গাড়ি চালকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ আছে প্রধানমন্ত্রীর কার্য্যালয়ের। আসলে শাস্তির ভয় না থাকার কারণেই অনেক চালক বেপরোয়া গাড়ি চালায়। তারা কোনো নিয়মনীতির তোয়াক্কা করে না। সড়ক দুর্ঘটনায় মৃত্যু হলে বর্তমানে প্যানাল কোড ৩০৪ (খ) ধারায় মামলা হচ্ছে। এ ধারার সর্বোচ্চ সাজা ৩ বছর। শাস্তি কম হওয়ায় গাড়ি চালানোর সময় চালকরা তেমন সতর্ক থাকে না। আমাদের দেশে যানবাহন দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হলো, চালকের মোবাইল ফোন সঙ্গে থাকা এবং গাড়ি চালানো অবস্থায় মোবাইল ফোনে কথা বলা। মোবাইলের এ অপব্যবহার রোধ করতে হবে। নিরাপদ সড়কের জন্য গাড়ি চালানোর সময় চালকের মোবাইল ফোনে কথা বলা বন্ধ করা অপরিহার্য।
নিরাপদ সড়কের জন্য মানুষ আন্দোলন করছে অথচ সড়কে প্রতিদিন লাশের সংখ্যা বাড়ছে। চলার পথে মানুষ মুহূর্তেই বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে যাচ্ছে। এভাবেই কি দেশ থেকে শতশত করিম, মিম, রাজীব, পায়েল, তারেক মাসুদ, মিশুক মনির ও রূপারা বাসের চাকায় হেলপারের অমানবিকতায় সবাইকে কাঁদিয়ে যাবে? বিচারের বাণী নিরবেই কাঁদবে? এমন সম্ভাবনাময় তরুণ প্রাণের মৃত্যুর দায় কে নেবে? সড়ক দুর্ঘটনা রোধে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির বিধান এখন সময়ের দাবি। নিরাপদ সড়ক এর জন্য নিম্নোক্ত সুপারিশ করছি:
১। ট্রেনিং ছাড়া ড্রাইভিং লাইসেন্স দেওয়া যাবে না।
২। গণপরিবহন ব্যবস্থাকে যাত্রীবান্ধব করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৩। পরিবহন সেক্টরকে আইন মেনে চলতে বাধ্য করতে হবে।
৪। গাড়ি চালানার সময় চালক মোবাইল ফোন ব্যবহার করলে তাৎক্ষণিক জরিমানার ব্যবস্থা করতে হবে।
৫। যানবাহনের গতির তারতম্য নিয়ন্ত্রণ, ওভারটেকিং, ওভারলোডিং ইত্যাদি বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৬। মহাসড়কে নিষিদ্ধ ঘোষিত যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে।
৭। সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে চালকদের দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
৮। সকল মহাসড়ক চারলেন করার জন্য কার্যকর উদ্যোগ ও ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
৯। পথচারীদেরও আইন মানতে হবে। আইন মানার জন্য সচেতন করার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।