পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আব্দুল মোমেনের প্রথম ভারত সফরের সময় দু’দেশের মধ্যে চারটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হয়েছে। এর মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য সমঝোতা স্মারকটি হলো, বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের ভারতে প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত। এই সমঝোতা স্মারক অনুযায়ী, বাংলাদেশের সিভিল সার্ভিসের এক হাজার ৮০০ মধ্যম পর্যায়ের কর্মকর্তা ভারতে প্রশিক্ষণ লাভ করবেন। সমঝোতা স্মারকটি নিয়ে ইতোমধ্যেই বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন উঠেছে। অনেকেই বিস্ময় ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন। কেউ কেউ উদ্বেগ ও হতাশা ব্যক্ত করেছেন। স্বাধীনতার এত বছর পর সিভিল সার্ভেন্টেদের প্রশিক্ষণের জন্য ভারতের দ্বারস্থ হতে হবে, এটা দেশের জন্য অত্যন্ত অমাননাকর। একইসঙ্গে আমাদের দৈন্যের প্রকাশ ও পরনির্ভরশীলতার উদাহরণ। একদা আমাদের দেশে শক্তিশালী আমলাতন্ত্র গড়ে উঠেছিল। পাকিস্তান আমলে সিএসপিদের শিক্ষা, দক্ষতা ও যোগ্যতা বিশ্বের যে কোনো উন্নত দেশের শীর্ষ আমলাদের সমপর্যায়ের ছিল। স্বীকার করতে কুণ্ঠা নেই, পাকিস্তান আমলের আমলাতন্ত্রের সেই ধারাবাহিকতা স্বাধীনতার পর ধরে রাখা সম্ভব হয়নি। কেন হয়নি সেটাও কারো অজানা নেই। কিন্তু এমন হীনতা দেখা দেয়নি যে, আমলাদের দক্ষতা-যোগ্যতার উন্নয়নে ভারতে প্রশিক্ষণ নিতে পাঠাতে হবে। তাছাড়া, ভারতের আমলাতন্ত্র এরূপ আহামরি হয়ে ওঠেনি যে, যেখান থেকে আমাদের আমলাদের প্রশিক্ষণ নিতে হবে। উত্তরাধিকারসূত্রে ভারত যে আমলাতন্ত্র লাভ করেছে, বাংলাদেশও সেই আমলাতন্ত্রই লাভ করেছে। প্রতি তুলনায় বাংলাদেশে কিছু অবনমন ঘটলেও সেটা এমন কিছু নয় যে, কাটিয়ে ওঠা যাবে না। তার জন্য ভারতে যাওয়ার কোনো প্রয়োজন নেই। খুব দরকার হলে ইউরোপ-আমেরিকায় কিছু সংখ্যক আমলাকে উন্নত প্রশিক্ষণের জন্য পাঠানো যেতে পারে। সেটাও একসঙ্গে এত বিপুল সংখ্যকের নয়।
দক্ষ ও যোগ্য আমলা গড়ে তোলার ক্ষেত্রে আমাদের যে আয়োজন আছে, তা মোটেই ন্যূন নয়। যথেষ্ট বলেই অভিমত দিয়েছেন সাবেক উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা এবং তত্ত¡াবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা এম হাফিজউদ্দীন খান। তিনি বলেছেন, সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের জন্য যা যা দরকার তার সবই আমাদের আছে। চাকরির শুরু এবং মাঝপথেও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা আছে। এতে আমাদের ঘাটতি নেই। এইসঙ্গে তিনি স্পষ্টই বলেছেন, ভারতে বাংলাদেশের সরকারি কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণ নিয়ে কোনো লাভ হবে না। যেখানে তারা কেন প্রশিক্ষণ নিতে যাবে? তার মতে, তাজমহল দেখা ও বউয়ের শাড়ি কেনা ছাড়া ভারতে আমলাদের প্রশিক্ষণ পাওয়ার কিছু নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. মাহবুবউল্লাহ বিষয়টি একটু অন্যভাবে দেখার চেষ্টা করেছেন। তিনি বলেছেন, ভারতে গিয়ে আমাদের সরকারি কর্মকর্তারা কী প্রশিক্ষণ নেবেন, সেটা একটা বড় বিষয়। ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা ‘র’-এর সাবেক কর্মকর্তাদের লেখা বিভিন্ন বই পড়ে আমরা সেটা জানি সেটা হলো, তারা খুব গভীরে তৎপরতা চালান। রাষ্ট্রের স্বার্থে তারা কোনো ছাড় দেন না। রাষ্ট্রের স্বার্থে তারা যেসব কাজ করেন তা আমাদের অনুকূলে নাও হতে পারে। সে জন্য এ ধরনের সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের আগে গভীরভাবে ভাবার দরকার ছিল। দেশেও এ নিয়ে আগে আলোচনা হতে পারত। তিনি প্রসঙ্গত এও বলেছেন, ভারতের সঙ্গে আমাদের বহু অমীমাংসিত ইস্যু রয়েছে। এ অবস্থায় যেখানে ভারতের কর্মকর্তাদের সাথে আমাদের দেশের কর্মকর্তাদের বিভিন্ন ইস্যুতে একই টেবিলে বসে দরকষাকষি করতে হয় সেখানে তাদের কাছ থেকে প্রশিক্ষণ নিলে আলোচনার টেবিলে আমাদের কর্মকর্তাদের মনোভঙ্গি কী দাঁড়ায় সেটা একটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বলা বাহুল্য, তার এসব কথাও অত্যন্ত প্রনিধানযোগ্য।
অতীতে আমাদের যেখানে দক্ষ আমলাতন্ত্রের ঐতিহ্য আছে এবং এখন আমলাদের প্রশিক্ষণের যাবতীয় আয়োজন ও ব্যবস্থা মজুদ আছে, সেখানে আমলাদের দক্ষতা-যোগ্যতা বাড়ানোর জন্য পরমুখাপেক্ষী হওয়া আত্মবিশ্বাসহীনতারই লক্ষণ। আমরাই আমাদের আমলাদের উপযুক্ত করে গড়ে তুলতে পারি যদি থাকে প্রতিজ্ঞা এবং যথাযথ উদ্যোগ ও পদক্ষেপ। এ বিষয়ে কেউ দ্বিমত পোষণ করবেন না যে, আমাদের আমলাতন্ত্রে যে দুর্বলতা ও ঘাটতি লক্ষ্য করা যায়, তার জন্য দলীয়করণ, আত্মীয়করণ এবং বিশেষ বিশেষ এলাকার লোকদের প্রাধান্য দেওয়াই মূলত দায়ী। আমলাদের দক্ষতা নির্ভর করে উপযুক্ত শিক্ষা, স্বচ্ছ নিয়োগ প্রক্রিয়া, প্রশিক্ষণ এবং ন্যায়সঙ্গত পদোন্নতিতে। এগুলোর ব্যতিক্রম ঘটার কারণে আমলাতন্ত্রের মান দিনকে দিন পড়ে যাচ্ছে। কারণ যেহেতু অজানা নয়, সুতরাং এ অবস্থা থেকে উত্তরণও কঠিন হওয়ার কথা নয়। কোনো দেশেই প্রশিক্ষণে পাঠিয়ে দক্ষ, যোগ্য, মানসম্পন্ন আমলা তৈরি করা যাবে না যদি না, উচ্চশিক্ষিত ও মেধাসম্পন্ন ব্যক্তিদের প্রতিযোগিতামূলক পরীক্ষার মাধ্যমে নিয়োগ প্রদান, উপযুক্ত প্রশিক্ষণ দান ও পদায়ন করা হয়। এদিকেই আমাদের নজর দিতে হবে; বিদেশে প্রশিক্ষণে নয়। এই বিবেচনা থেকেই আমরা আশা করি, আমাদের সিভিল সার্ভেন্টদের ভারতে প্রশিক্ষণ দেয়ার বিষয়টি পুনর্বিবেচনা করা হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।