Inqilab Logo

বুধবার ১৩ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

থ্যালাসেমিয়া রুগীর হরমোন রোগ

ডাঃ শাহজাদা সেলিম | প্রকাশের সময় : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৫ এএম

থ্যালাসেমিয়া অন্যতম জেনেটিক রোগ যাতে রক্তের হিমোগেøাবিন তৈরিতে বড় ধরণের সমস্যা থাকে। একটি বংশানুক্রমিক রোগ। থ্যালাসেমিয়া আক্রান্ত শিশু-কিশোরদের অ্যামোনিয়া বা রক্তস্বল্পতা থাকে। থ্যালাসেমিয়ার ধরনের উপর নির্ভর করে যার মাত্রা কম বেশি হয়। থ্যালাসেমিয়া রোগীদের চিকিৎসার অন্যতম প্রধান পদ্ধতি নিয়মিত রক্ত পরিসঞ্চালন করা। নির্দিষ্ট পরিমাণ রক্ত পরিসঞ্চালনের পর রক্তের আয়রনের মাত্রা কমাবার জন্য আলাদা ইনজেকশন (চিলেশন) দেওয়া হয়। 

থ্যালাসেমিয়া সাধারণত কম বয়সি ছেলে-মেয়েদের মধ্যেই শনাক্ত হয়। এদের অধিকাংশ ছেলে-মেয়েই লাগাতার রক্ত পরিসঞ্চালন করে স্বাভাবিক জীবন-যাপন করার উপযোগী হতে চায়। এ নিয়মিত রক্ত গ্রহণের ফলে শরীরের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ যেমন, হরমোন নি:সরণকারী গ্রন্থিসমূহ (পিটুইটারি, থায়রয়েড, অগ্ন্যাশয়, অন্ডকোষ, ডিম্বাশয়, অ্যাড্রেনাল গ্রন্থি ইত্যাদি), লিভার, স্পিøন প্রভৃতিতে ক্রম:বর্ধমান আয়রণ জমে এর কোষসমূহের বিনষ্ট সাধন করে এবং অঙ্গগুলোর কার্যকারীতা ব্যাপকভাবে ব্যহত হতে থাকে।
থ্যালাসেমিয়া রোগীর পেটে আয়রন জমে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্থ হয় হরমোন নি:স্বরনকারি গ্রন্থিসমূহের এবং তা শুরু হয় শৈশব বা কৈশরেই। থ্যালাসেমিয়ার কারণে ঘঠিত রোগসমুহ নিচে আলোচনা করা হলো:
১. শিশুর বৃদ্ধিজনিত সমস্যা: থ্যালাসেমিয়া আক্রান্তের দৈহিক বৃদ্ধিজনিত সমস্যা শুরু হতে পারে মাতৃগর্ভ থেকেই। এরপর নবজাতক শিশু-কিশোর যে কেউ এর শিকার হতে পারে। ২০% থেকে ৩০% থ্যালাসেমিয়া শিশুর গ্রোথ হরমোন কম থাকে। ক্রমান্বয়ে বাকিদেরও কম পাওয়া যেতে পারে। এদের শরীরে অতিরিক্ত আয়রন জমার সাথে সাথে, ডেসফেরোক্সামিন জমতে থাকে। এদের জিংক ঘাটতিও দেখা দেয়। এসকল এনিমিক বালক বালিকার বয়োঃসন্ধি বিলম্বিত হওয়ায় হাইপোথায়রয়েডিজম, লিভার সিরোসিস, গ্রোথ হরমোনের ঘাটতি ইত্যাদি হতে থাকে। এ সব শিশুর কাউকে কাউকে খর্বাকৃতির মনে হলেও তারা ক্রমশ: কাঙ্খিত দৈহিক উচ্চতা পেতেও পারে।
পিটুইটারি গ্রন্থির সম্মুখভাগ এক্ষেত্রে সবচেয়ে বেশি সংবেদনশীল থাকে। এমআরআই করে পিটুইটারি গ্রন্থিতে আয়রণ জমার প্রমাণ পাওয়া যেতে পারে। কারো কারো ২৪ ঘণ্টাই নি:সৃত গ্রোথ হরমোনের পরিমাণ যথেষ্ট ভাল হলেও তার প্রভাব পুরাপুরি নাও পাওয়া যেতে পারে। স্বাভাবিক গ্রোথ হরমোন ও কম আইজিএফ-১ এর উপস্থিতি গ্রোথ হরমোনের কার্যকারীতা ব্যহত হবার স্বাক্ষর বহন করে। গবেষণায় দেখা গেছে, থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত ৬২.৯ শতাংশ বালিকা ও ৬২ শতাংশ বালক স্বাভাবিক দৈহিক উচ্চতা অর্জনে ব্যর্থ হয়। মোটের উপর প্রায় ৪১ শতাংশ তাদের পরিণত বয়সে কম দৈহিক উচ্চতা নিয়েই থেকে যায়। থ্যালাসেমিয়ার বালক বালিকাদের অধিকাংশই বয়:সন্ধিকালীন সহসা দৈহিক উচ্চতা বৃদ্ধি পাওয়া থেকে বঞ্চিত হয়।
২. হাইপোগোনাডিজম ও স্বাবালকত্ব প্রাপ্তি : অপরিপক্ক যৌবন প্রাপ্তি থ্যালাসেমিয়ার অন্যতম প্রধান ধারাবাহিকতা। প্রজননতন্ত্রের চালিকা গ্রন্থি (ছেলেদের ক্ষেত্রে অন্ডকোষ, মেয়েদের ক্ষেত্রে ডিম্বাশয়) স্বাভাবিক আকার আকৃতি যেমন পায়না, তেমনি এদের কাজ করার বা হরমোন উৎপাদন করার সামর্থও সীমিত থাকে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বালক বালিকাদের ৬০-১০০ শতাংশের যৌবন প্রাপ্তি ব্যাহত হতে পারে। অন্ডকোষ বা ডিম্বাশয়ে ধীরে ধীরে আয়রণ জমে যেমন এদের ক্ষতি করে তেমনই পিটুইটারি ও অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির গাঠনিক ও কার্যকারীতার উপর ব্যাপক বাধা সৃষ্টি হয়। বাৎসরিক দৈহিক বৃদ্ধির গতি হ্রাস পাই বা অনুপস্থিত থাকে। বালিকাদের অনেক দেরি করে মাসিক শুরু হওয়া, অনিয়মিত বা অল্প পরিমাণে মাসিক হওয়া বা হাইপোগোনাডিজম দেখা দিতে পারে।
বয়:সন্ধিকাল শুরুর আগেই শরীর থেকে অতিরিক্ত আয়রণ দূর করার (চিলেশন) ব্যবস্থা করতে পারলে থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত বালক বালিকাদের দৈহিক বৃদ্ধি সম্ভাবনা যেমন বাড়ে, তেমনই যৌবন প্রাপ্তির সম্ভাবনাও বৃদ্ধি পায়।
৩. গøুকোজ অসহিষ্ণুতা এবং ডায়াবেটিস : থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্ত রোগীদের কার্যকরি চিকিৎসা করতে পারলে তার ফলাফল আশাব্যাঞ্জক। কিন্তু তা না হলে অন্য সমস্যাগুলোর সাথে প্রায় অর্ধেক রোগীর ডায়াবেটিস হবার সম্ভাবনা দেখা দেয়। বাকীদের অর্ধেকের গøুকোজ অহিষ্ণুতা থাকতে পারে। কিন্তু বয়:বৃদ্ধির সাথে সাথে এদের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত হবার হার অন্যদের ত‚লনায় ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়।
এদের অগ্ন্যাশয় থেকে ইনসুলিন নি:সরণের হার কমে যাবার সুস্পষ্ট নিদর্শন যেমন থাকে, তেমনই ইনসুলিন রেজিস্টেন্স বা ইনসুলিনের কার্যকারীতা ব্যাহত হবার প্রমাণও পাওয়া যায়। অগ্ন্যাশয়ের কোষগুলোর অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ারও ঝুঁকি থাকে।
৪. থায়রয়েড গ্রন্থির সমস্যা : থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের মাঝে থায়রয়েড গ্রন্থির সমস্যা খুব প্রকট। এদের প্রাই ৫ শতাংশ হাইপোথায়রয়েডিজম (থায়রয়েড হরমোনের ঘাটতিজনিত সমস্যা)- এ আক্রান্ত হয়ে থাকে। আরও বেশি সংখ্যক রোগী সাব-ক্লিনিক্যাল হাইপোথায়রয়েডিজম ( টি৪, টি৩ স্বাভাবিক কিন্তু টিএসএইচ বেশি)-এ আক্রান্ত থাকে। যে সব থ্যালাসেমিয়ার রোগীর এনিমিয়া বেশি থাকে তাদের মধ্যে থায়রয়েড সমস্যার প্রকটতা বেশি। তাই ১২ বছর বয়স থেকে প্রতিটি থ্যালাসেমিয়ার রোগীর থায়রয়েড হরমোনের পরীক্ষা করা উচিত এবং প্রতি বছর একবার করে চালিয়ে যেতে হবে। যাদের থায়রয়েড হরমোনের ঘাটতি এখনও ততটা বেশি নয়, তাদেরও হৃদ রোগ হলে দুয়ে মিলে মারাত্মক অবস্থা হতে পারে।
৫. হাইপো-প্যারাথায়রয়েডিজম : প্যারাথায়রয়েড গ্রন্থির হরমোন (চঞঐ)-এর ঘাটতির কারণে শরীরে ক্যালসিয়ামের ঘাটতি পাওয়াটা থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের একটু দূরবর্তী জটিলতা হিসাবে বিবেচনা করা হবে। কিন্তু তাদের থ্যালাসেমিয়ার কারণে গভীর রক্ত শূণ্যতা থাকলে, প্যারাথায়রয়েড হোরমোনের অস্বাভাবিকতা, ক্যালসিয়ামের ঘাটতি ও ভিটামিন ডি’র স্বল্পতা পাওয়া যাবে। এ সমস্যাটি সাধারণত দ্বিতীয় দশক থেকে প্রকাশ পেতে থাকে। ৩-৪ শতাংশ থ্যালাসেমিয়ার রোগী হাইপো-প্যারাথায়রয়েডিজমে ভুগতে পারে।
৬. অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির সমস্যা : থ্যালাসেমিয়ার রোগীদের মাঝে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির সমস্যার উপস্থিতি আয়রণ ওভার লোডের সাথে সরাসরি সম্পৃক্ত। অর্থাৎ যতবেশি আয়রণ শরীরে জমতে থাকবে, ততবেশি ঝুঁকি তৈরী হবে অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির উপর। কিন্তু অ্যাড্রেনাল গ্রন্থির সমস্যা থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের মাঝে অন্যান্য গ্রন্থির ত‚লনায় কম।
৭. হাড় ক্ষয় (অস্টিওপরোসিস) : বেটা থ্যালাসেমিয়ায় হাড়ের ভিতরের ম্যারো সম্প্রসারিত হয়, হাড় পাতলা হয় এবং কর্টেক্স ঘন হয়। এগুলো হাইপোগোনাডিজম, ডায়াবেটিস, হাইপোথায়রয়েডিম, হাইপো-প্যারাথায়রয়েডিজম, আয়রণ ওভারলোড এবং এদের চিকিৎসার সাথে সম্পৃক্ত। অপুষ্টি, শারীরিক শ্রম হীনতা এবং অ্যাড্রেনাল স্যাক্স হরমোনের ঘাটতি হাড় ক্ষয়ের ঝুঁকি তৈরী করে এবং তা বয়:সন্ধিকালেই হতে পারে। মেরুদন্ড ও কোমরের হাড় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের প্রাই অর্ধেকই মারাত্মক হাড় ক্ষয়ে আক্রান্ত হয়। তাই হাড়ের ঘনত্ব মেপে (বিএমডি) হাড় ক্ষয়ের মাত্রা নিরুপন করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। সবার আগে ক্যালসিয়াম ও ভিটামিন ডি সমৃদ্ধ খাদ্য গ্রহণ, পরিমিত- নিয়মিত শারীরিক শ্রম সম্পাদনে জোর দিতে হবে। হাইপোগোনাডিজম থাকলে হরমোন দিয়ে চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে।
উপসংহার : থ্যালাসেমিয়ায় আক্রান্তদের মাঝে হরমোনের ঘাটতিজনিত রোগে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা বেশি থাকে। তাই নিয়মিত প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা ও ল্যাবরেটরি পরীক্ষার মাধ্যমে যত দ্রæত সম্ভব রোগটিকে শনাক্ত করে কার্যকরি চিকিৎসার ব্যবস্থা করতে হবে। রক্ত পরিসঞ্চালনের ক্ষেত্রে আয়রণ ওভারলোড প্রতিহত করণের পদক্ষেপগুলো গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে।

সহকারী অধ্যাপক
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
মোবাইল ঃ ০১৯১৯০০০০২
কমফোর্ট ডক্টরস চেম্বার
১৬৫-১৬৬, গ্রীন রোড (২য় তলা), ধানমন্ডি, ঢাকা।
উত্তরা ক্রিসেন্ট হাসপাতাল
প্লট - ৪০, সেক্টর - ৭, রবীন্দ্র সরণী, উত্তরা - ১২৩০
ফোনঃ ০১৯১৭৭০৪৯৫০-১।



 

Show all comments
  • সাইফুল ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯, ৯:২০ পিএম says : 0
    Amarবোনের মেয়ে থ্যালাসিমিয়া তে আক্রা। রক্ত দিতে হয়। এখন কথা হল আমার বোনের পেটে আবার বাচ্চা এখন বাচ্চা সুস্থ হবে কিনা এটা কিভাবে জানা সম্ভব জানালে খুব ভাল হয়। কি পরিক্ষা করলে জানা যাবে আমার বাড়ি চুয়াডাংগা। তাহলে আমরা এসে সেখানে পরিক্ষা নিরীক্ষাকরব
    Total Reply(0) Reply

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোগ

১৬ ডিসেম্বর, ২০২২

আরও
আরও পড়ুন