পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঔপনিবেশিকতা থেকে তৃতীয় বিশ্বের জনগণের স্বাধীনতায় উত্তরণের মূলমন্ত্রটি ছিল, সম্পদের সুষম বন্টন, নাগরিকের বাকস্বাধীনতা ও ব্যক্তিগত নিরাপত্তার নিশ্চয়তা। বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে নতুন বাস্তবতায় বৃটিশ- ফরাসী-স্পেনিশ-ইতালীয় ঔপনিবেশিক শাসকরা তাদের উপনিবেশগুলো ত্যাগ করার আগে সীমান্ত, নদনদী, ভূরাজনৈতিক, অর্থনেতিক-সাংস্কৃতিকভাবে নানা রকম প্যাঁচ লাগিয়ে, অনেক বিষয় অমিমাংসিত রেখে দেশভাগ করার মধ্য দিয়ে স্বাধীন জাতিসমুহের মধ্যে পারস্পরিক দ্বন্দ-সংঘাত, অস্থিতিশীলতার বীজ বপণ করে যায়। ভারতীয় উপমহাদেশ, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরেশিয়া, ল্যাটিন আমেরিকা, ক্যারিবিয়া এবং উত্তর আফ্রিকার দেশগুলোতে এখনো যে রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক, বিবাদ, বিভাজন চলছে তার পেছনে সেই রাজনৈতিক নীলনকশা সক্রিয় রয়েছে। ডুরান্ট লাইন, ম্যাকমোহন লাইন, সাইকস-পাইকট চুক্তি, জায়নবাদ, আগ্রাসন ইত্যাদি সাবেক ঔপনিবেশিক অঞ্চলগুলোকে এখনো অস্থির করে রাখছে। যে সব দেশ ও জাতি এসব বাধা ডিঙ্গিয়ে ঐক্য ও সম্প্রীতির নবযাত্রা সূচিত করতে পেরেছে তারাই শুধু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিকভাবে পরাশক্তির প্রতিদ্বন্দী সম্ভাবনাময় জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাতে পেরেছে। এর বাইরে জাতিরাষ্ট্রগুলোর বেশীরভাগ এখনো পারস্পরিক বিভাজন, অনাস্থা, অবিশ্বাস ও হানাহানিতে লিপ্ত রয়েছে। শতকরা ৯৯ ভাগ মানুষ একই ভাষাভাষী, শতকরা ৯০ ভাগ মানুষ অভিন্ন ধর্ম, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক ইতিহাস-ঐতিহ্যের উত্তরাধিকারী হওয়া সত্ত্বে ও অনেক দেশ কৃত্রিম বিভাজনের কুটিল গহ্বর থেকে বের হতে পারছে না। বাংলাদেশ তার জাজ্জ্বল্যমান উদাহরণ। জাতির সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, মুক্তির লক্ষ্য, আন্দোলন-সংগ্রাম ও রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে স্বাধীনতা অর্জনের গৌরবময় ইতিহাসে বাংলাদেশের শতকরা ৯৫ ভাগ মানুষ অভিন্ন উত্তরাধিকার বহন করেও এখন বিভাজনের পথ ধরে বৈষম্য-বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। আমাদের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, জননিরাপত্তা, বাক ও ব্যক্তিগত রাজনৈতিক স্বাধীনতার উপর কৃত্রিম প্রতিবন্ধকতার খড়গ সক্রিয় রয়েছে। কোনো এককদল বা গোষ্ঠির পক্ষে এই প্রতিবন্ধকতা অর্গল উপড়ে ফেলা সম্ভব নয়। সমাজে ও রাষ্ট্রে গণতান্ত্রিক-রাজনৈতিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার মধ্য দিয়ে বৃহত্তর জাতীয় রাজনৈতিক ঐক্যই পারে সত্যিকারের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে এবং আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র ও প্রতিবন্ধকতা মোকাবেলা করতে। এর জন্য সর্বাগ্রে প্রয়োজন রাষ্ট্র, সরকার ও রাজনৈতিক প্রক্রিয়ার প্রতি সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সামাজিক-রাজনৈতিক বৈষম্য দূর করার পাশাপাশি ন্যায়বিচার ও সুশাসন নিশ্চিত করা। হীন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে নিবর্তনমূলক আইন প্রণয়ন এবং আইনের অপপ্রয়োগের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র ও সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি সাধারণ মানুষের অনাস্থা তৈরীর যে কোনো প্রয়াস থেকে রাষ্ট্রকে অবশ্যই সরে দাঁড়াতে হবে। আইন প্রণয়নের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের কল্যাণ ও নিরাপত্তার লক্ষ্যকে সামনে তুলে ধরা এবং আইনের শাসন ও নিরাপত্তার প্রশ্নে রাষ্ট্রের সব মানুষের সমান সুযোগ নিশ্চিত করাই আধুনিক রাষ্ট্রে ন্যায়বিচার ও গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠার প্রধান চ্যালেঞ্জ। এ ক্ষেত্রে আমরা ক্রমশ: পিছিয়ে পড়ছি। এটা এমন সময়ে ঘটছে, যখন বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী পালন করতে যাচ্ছে এবং দেশ অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে বলে ক্ষমতাসীনদের তরফ থেকে জোর গলায় দাবী করা হচ্ছে। গড় সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামো উন্নয়নের এই দাবী ভিত্তিহীন নয়। তবে রাষ্ট্রের কাছে জনগণের প্রত্যাশা এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার লক্ষ্য অনুসারে এর চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা এবং মানুষের নিরাপত্তা ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখা।
মহাযুদ্ধোত্তর বিশ্বব্যবস্থায় পরিবর্তন এবং নতুন ভূ-রাজনৈতিক বাস্তবতায় ঔপনিবেশিকতা থেকে যে সব স্বাধীন রাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল তারই ধারাবাহিকতায় পাকিস্তান ভেঙ্গে বাংলাদেশ নামক রাষ্ট্রের আত্মপ্রকাশ খুব সহজ ছিলনা। প্রথমে ভারতের বুক চিরে পূর্ববাংলায় পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলন, সেই পূর্ব পাকিস্তানে বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষায় রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে রাজনৈতিক অধিকারের সুদীর্ঘ সংগ্রাম এবং অবশেষে স্বাধীনতা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার পেছনে আঞ্চলিক রাজনীতি ও পরাশক্তির ভূরাজনৈতিক হিসাব নিকাশ সক্রিয় থাকলেও ভারতীয় উপমহাদেশে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশের মধ্য দিয়ে বিশ্বে গণতান্ত্রিক রাজনীতির ইতিহাসে এক অনন্য নজির সৃষ্টি হয়। লাখো মানুষের ত্যাগ ও রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলাদেশের স্বাধীনতার মূল স্পিরিট ছিল গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার, অর্থনৈতিক মুক্তি ও বৈষম্যহীনতা। বাহাত্তরের প্রথম সংবিধানে ধর্মনিরপেক্ষতাকে অন্যতম রাষ্ট্রীয় মূলনীতি হিসেবে গ্রহণ করা হলেও ’৭০এর নির্বাচনী মেনিফেস্টো এবং ’৭১এর মুক্তিযুদ্ধের সময় সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ধর্ম হিসেবে ইসলামী মূল্যবোধ সমুন্নত রাখার সুস্পষ্ট অঙ্গিকার ছিল। এসব বাস্তবতার বিচার-বিশ্লেষণে বাংলাদেশের সামাজিক-রাজনৈতিক মনস্তত্বে ইসলাম ও আধুনিক গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের যুগপৎ সংমিশ্রণ ও সমন্বয় ছিল অনিবার্য। স্বাধীনতাত্তোর ৪৭ বছরের জাতীয় রাজনীতিতে গণমানুষের সেই আবেগ, প্রত্যাশা ও চিন্তা-চেতনার প্রতিফলন ধারাবাহিকভাবে বার বার উঠে এসেছে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইসলামিক ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা, জিয়াউর রহমান কর্তৃক সংবিধানে ‘বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহীম’ এবং ‘আল্লাহর উপর আস্থা ও বিশ্বাস’সংযোজন , হুসেইন মুহাম্মদ এরশাদ কর্তৃক সংবিধানে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে স্বীকৃতি, বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর হাতে কওমী মাদরাসা সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠাসহ ইসলামি মূল্যবোধের প্রতি নানা অঙ্গিকারের মধ্য দিয়ে সেই ধারাবাহিকতা অক্ষুন্ন রয়েছে। এটি এ দেশের মানুষের স্বাধীন রাষ্ট্র গঠনের বহুমাত্রিক প্রত্যাশার একটির খন্ডিত অংশ মাত্র। সামাজিক-রাজনৈতিক প্রত্যাশার মূল বিষয় হচ্ছে, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সামাজিক ন্যায়বিচার এবং বৈষম্যমুক্ত রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তা। স্বাধীনতার ৪৭ বছর পেরিয়ে এসে আমরা গভীরভাবে অনুভব করছি, আমরা সেই প্রত্যাশা থেকে অনেক পিছিয়ে গেছি। মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, মানবাধিকার ও ভোটাধিকারের মত বিষয়গুলো এখন রাষ্ট্রশক্তির দ্বারাই বেশী অগ্রাহ্য ও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিল একপাক্ষিক ও ভোটারবিহীন। গণতান্ত্রিক বিশ্বের কাছে সেই নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। তারা রাজনৈতিক সমঝোতার ভিত্তিতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছিল। রাজনৈতিক সমঝোতা ছাড়াই একাদশ জাতীয় নির্বাচন অংশগ্রহণমূলক হওয়ার সমুহ সুযোগ সৃষ্টি হওয়া সত্তে¡ও নির্বাচনটি ইতিহাসের নিকৃষ্টতম নির্বাচন হিসেবে আখ্যায়িত হচ্ছে।একজন মার্কিন কূটনীতিক ও বাংলাদেশে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত উইলিয়াম বি মাইলাম ৩০ ডিসেম্বরে অনুষ্ঠিত একাদশ জাতীয় নির্বাচনকে এভাবেই চিত্রিত করেছেন। নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি, নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর থেকে নির্বাচনী কার্যক্রম, বিরোধিদের জন্য প্রতিকুল ও অসমতল নির্বাচনী মাঠ ও পরের সামগ্রিক অবস্থা সবারই জানা। নির্বাচনে সরকারীদলের বিজয় নিশ্চিত করতে প্রশাসন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সমন্বিতভাবে সম্ভাব্য সবকিছুই করেছে। নির্বাচনের পর একমাসের বেশী সময় অতিবাহিত হলেও এখনো বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাগারে আটক আছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী হয়তো এসব রাজনৈতিক নেতাকর্মীর মামলা ও গ্রেফতার সম্পর্কে ভিন্ন আইনগত ব্যাখ্যা দাঁড় করাবে। তবে বাস্তবতা হচ্ছে, দেশের কারাগারগুলোতে ধারণক্ষমতার চেয়ে কয়েকগুন বেশী মানুষকে কয়েদ করা হয়েছে। ধারণক্ষমতা ও সুযোগ সুবিধার তুলনায় তিন-চারগুনের বেশী বন্দী থাকায় সেখানে একপ্রকার মানবিক বিপর্যয় সৃষ্টি হয়েছে। গত রবিবার নারায়ণগঞ্জে ‘মানবাধিকার, সংবিধান ও বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক সেমিনারে প্রধান অতিথির বক্তব্য দিতে গিয়ে মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেন, দেশের কারাগারগুলোতে যে সব বন্দি রয়েছে তার দুই-তৃতীয়াংশই বিনাবিচারে বন্দী।
গুম-খুন, জেল-জুলুম, নির্যাতন, দুর্নীতি-অনিয়ম ও লুটপাটের রাজনীতি ক্ষমতার সাথে হাত ধরাধরি করে চলেছে। দুর্নীতি প্রতিরোধ করতে গিয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেনীর সদস্যের অদক্ষতা বা ব্যর্থতার কারণে খোদ দুর্নীতি দমন কমিশনও ভিন্নমাত্রায় আরো ভয়ানক দুর্নীতির সাথে জড়িয়ে পড়ছে। সোনালী ব্যাংকের১৮ কোটি টাকার একটি ঋণ জালিয়াতির বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের দায়ের করা মামলায় অভিযুক্ত আবু সালেকের বদলে জনৈক জাহালমকে ধরে কারাগারে পাঠায় পুলিশ। বিনা অপরাধে ৩ বছর জেল খাটার পর সম্প্রতি এ বিষয়ে একটি দৈনিকে সংবাদ প্রকাশিত হওয়ার পর প্রশাসন ও আদালতের টনক নড়ে। অবশেষে হাইকোর্টের স্বপ্রণোদিত রুলে সংশ্লিষ্ট সব পক্ষকে আদালতে হাজির হয়ে জবাবদিহিতা করার নির্দেশের পর নির্দোষ জাহালমকে মুক্তির আদেশ দেয়া হয়েছে। সারাদেশে কারাগারগুলোতে যেমন গায়েবী ও মিথ্যা মামলায় হাজার হাজার মানুষ বন্দী রয়েছে, একইভাবে জাহালমের মত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বাদীপক্ষের ভুলে আরো অসংখ্য মানুষ কারাভোগ করছে। ভুল মামলায় বিনাদোষে ১৫-২০ বছর জেল খাটার নজিরও আমাদের দেশে আরো অনেক আছে। যেখানে দেশের আদালতগুলোতে লাখ লাখ মামলার জট লেগে আছে, যেখানে লাখ লাখ মানুষ প্রভাবশালীদের দ্বারা নানাভাবে আক্রান্ত ও নির্যাতিত হলেও আইনগত প্রতিকার বা নিরাপত্তা পাচ্ছে না। সেখানে উদ্দেশ্যমূলক রাজনৈতিক মামলা, মিথ্যা মামলা, গায়েবী মামলা ও ভুল মামলায় ভুল ব্যক্তিদের নিয়ে একদিকে আদালতের মূল্যবান সময় নষ্ট করা হচ্ছে, অন্যদিকে এসব মামলার অবিচারের শিকার হয়ে জাহালমের মত তরুনদের ব্যক্তিগত ও পারিবারিক ভাগ্য বিপর্যয় ঘটছে। শুধুই বিনা বিচারে আটক ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধে নিহত হয়নি বলে এটিও এক ধরনের সৌভাগ্য হিসেবেই গণ্য হতে পারে। প্রতিপক্ষের দ্বারা ম্যানেজড হয়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একশ্রেনীর সদস্য যাচ্ছে তাই করছে। ভাড়াটিয়া খুনীর ভ’মিকায় অবতীর্ণ হয়েছে, এমন বেশ কিছু উদাহরণ আমাদের চোখের সামনেই আছে। যারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর পোশাক পরে জনগণের ট্যাক্সের টাকায় কেনা অস্ত্র ও গাড়ি ব্যবহার করে ভাড়াটিয়া খুনি বা অপহরণকারীর ভ’মিকা পালন করেছে, কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারীর বদলে নির্দোষ ব্যক্তিকে আসামী সাজিয়ে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা আইন ও মানবাধিকারের দৃষ্টিতে কোটি টাকা আত্মসাতের চেয়েও অনেক বড় অপরাধ। এমন অপরাধের পুনরাবৃত্তি চিরতরে বন্ধ না হলে জননিরাপত্তা নিরাপত্তা, সুশাসন, আইনের শাসন, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ ইত্যাদি অভিধাগুলো শুধু কথার কথা হয়েই থাকবে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানে কিছু বিভ্রান্ত-বিপথগামী ও অপরাধপ্রবণ সদস্যের অবস্থান থাকা অস্বাভাবিক নয়। তবে আমাদের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন ও গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপর সাম্প্রতিক সময়ে যা ঘটেছে তাকে কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে দাবী করার সুযোগ খুব ক্ষীণ। হাজার হাজার গায়েবি মামলায় লাখ লাখ মানুষকে আসামী করে দেশের কারাগারগুলোকে তিন-চারগুন বন্দি দিয়ে ভর্তি করে ফেলার মত ঘটনা সরকারের নীতির বাইরে ঘটতে পারে না। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাজ হচ্ছে আদালতের রায় এবং সাংবিধানিক আইন অনুসারে দায়িত্ব পালন করা। সরকারের পক্ষ থেকে একটি অন্যায়কে প্রশ্রয় দেয়া হলে দলের নেতাকর্মী বা বিশেষ বাহিনীর প্রশ্রয় পাওয়া সদস্যরা নিজ স্বার্থে ও স্বপ্রণোদিত হয়ে আরো গুরুতর অন্যায়ে লিপ্ত হতে পারে। সাম্প্রতিক সময়ের বিভিন্ন ঘটনায় এরই প্রতিফলন দেখা যায়।
প্রায় এক দশক আগে মধ্যপ্রাচ্যে শুরু হওয়া তোলপাড় গণআন্দোলনকে আরব বসন্ত নামে অভিহিত করা হয়। আরব সমাজে বিদ্যমান অর্থনৈতিক সংকট- বৈষম্য, দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক অসন্তোষ ও পরিবর্তনের আকাঙ্খা থেকে এই গণআন্দোলনের সুত্রপাত হলেও এর পেছনেও পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদী আন্তর্জাতিক কুশীলবদের মতলবী ভূমিকা ছিল। অনেকের হয়তো মনে থাকবে, তিউনিসিয়ার বেন আলী সরকারের স্বৈরাচারী শাসনে অতীষ্ট ও বিক্ষুব্ধ জনগণের ভেতর থেকে উঠে আসা সেই আরব বসন্তের ঢেউ পুরো মধ্যপ্রাচ্যে আছড়ে পড়েছিল। অর্থনৈতিক বৈষম্য, কর্মসংস্থানের সংকট, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও সরকারী প্রশাসনের দুর্নীতি ইত্যাদি ছিল তিউনিসিয়ার রেভ্যুলুশনের নেপথ্য ইন্ধন। ঘটনার সুত্রপাত ঘটেছিল তিউনিসের রাস্তায় ভ্যানগাড়ীতে বিভিন্ন মালামাল বিক্রি করা ফেরিওয়ালা যুবক মোহাম্মদ বাউজিজির পুলিশি নির্যাতনের বিচার না পাওয়ার প্রতিবাদে ঘোষণা দিয়ে প্রকাশ্য রাস্তায় নিজের গায়ে আগুন ধরিয়ে দেয়ার মধ্য দিয়ে। ২০১০ সালের ১৭ ডিসেম্বর বাওজিজির প্রতিবাদের সাথে হাজার হাজার মানুষ রাস্তায় নেমে আসে। তারা সরকারী প্রশাসনের দুর্নীতি, ক্রমবর্ধমান বেকারত্ব এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য অবসানের দাবীতে রাজপথে নেমে আসার এক পর্যায়ে একনায়কতান্ত্রিক শাসক জইন উদ্দিন বেন আলীর পদত্যাগ দাবী করে। মুমুর্ষূ অবস্থায় কয়েকদিন হাসপাতালে টিকে থাকার পর বাওজিজির মৃত্যু হলে জনরোষ তীব্র আকার ধারণ করার পর বেন আলী দেশ ছেড়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হন। ২০১১ সালের ১৪ জানুয়ারী তিউনিসিয়ায় বেন আলীর ২৪ বছরের স্বৈরাচারী শাসনের পতন ঘটে। বেন আলীর পতনের মধ্য দিয়ে তিউনিসিয়ায় স্বৈরাচারী শাসনের অবসান ঘটলেও সেখানে এক দীর্ঘমেয়াদী রাজনৈতিক সংকট ও বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা দেখা দেয়ার প্রেক্ষাপটে একটি রাজনৈতিক সংলাপ ও সমঝোতার প্রয়াস শুরু হয়। দেশের ট্রেড ইউনিয়ন, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, মানবাধিকার এবং রাজনৈতিক প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে গঠিত কোয়ার্ট্টেট আলোচনা ও সমঝোতার মধ্য দিয়ে তিউনিসিয়ায় শান্তি ও গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের পরিবেশ গড়ে তোলতে সক্ষম হয়। এই সাফল্যের কারণে তিউনিসিয়ার ন্যাশনাল ডায়লগ কোর্য়াট্রেটকে ২০১৫ সালে শান্তিতে নোবেল পুরস্কারে ভ’ষিত করা হয়। আর তিউনিসিয়ার গণতান্ত্রিক অগ্রযাত্রার ঢেউয়ে অস্থির পেট্টোডলারের আশির্বাদ আরব বিশ্বে নতুন জুুজু ধরিয়ে দিয়ে পশ্চিমা সাম্রাজ্যবাদীরা হাজার হাজার কোটি ডলারের সমরাস্ত্র চুক্তি করিয়ে নিতে সক্ষম হয়। তবে তিউনিসিয়ার গণতান্ত্রিক আন্দোলন ও পরিবর্তনের প্রভাব আরব বিশ্বের জনগণের মধ্যে যে পরিবর্তন সূচিত করেছে তা থেমে নেই। বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থায় তিউনিসিয়ার কাছ থেকে অনেক কিছুই শিক্ষনীয় রয়েছে যেখানে সংবিধানে রাষ্ট্রের উপর জনগণের মালিকানার স্বীকৃতি রয়েছে, সেখানে জনগনই আজ সবচেয়ে বেশী অবহেলা ও বঞ্চনার শিকার হচ্ছে। মানুষের ভোটাধিকার, মানবাধিকার, জননিরাপত্তা ও রাষ্ট্রের কাছে ন্যায়বিচার প্রাপ্তির অধিকারের নিশ্চয়তা ক্রমে সংকীর্ণ হয়ে পড়ছে। গুম-খুন ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকান্ডের অভয়ারণ্যে পরিনত বাংলাদেশে একশ্রেনীর মানুষ এখনো আইনের উর্ধ্বে থেকে ব্যক্তিগত সম্পদ ও ক্ষমতার চর্চা করে চলেছে। নিরপেক্ষ আইনের শাসন নাগরিক হিসেবে রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও একজন সাধারণ নাগরিকের মধ্যে তেমন কোনো পার্থক্য তৈরী করেনা। এ ক্ষেত্রে তিউনিসিয়ার একটি সাম্প্রতিক উদাহরণ টেনে আজকের নিবন্ধ শেষ করতে চাই। বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রেক্ষাপটে এই উদাহরণটি খুবই প্রাসঙ্গিক। স্মরণ করা যায়, তিউনিসয়ান রেভ্যুলেশনের ঢেউ তিউনিসিয়া থেকে পুরো মধ্যপ্রাচ্যে অগ্নিস্ফুলিঙ্গের মত ছড়িয়ে পড়েছিল সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে। ২০১৪ সালে ইমাদ দেঘজি নামের এক সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে প্রেসিডেন্ট বেজি সাইদ ইসেবজি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে তাঁর ও তার পরিবারের জন্য মানহানিকর মন্তব্য ও ভিডিও পোষ্ট করার অভিযোগ তুলে একটি মামলা দায়ের করেছিলেন। লিগ ফর প্রটেকশন দ্যা রেভ্যুলেশন নামের একটি সংগঠনের প্রধান ইমাদ দেঘজির বিরুদ্ধে স্বয়ং প্রেসিডেন্টের দায়ের করা মামলায় অভিযোগ গঠন ও যুক্তিতর্ক শেষে আদালতের রায়ে প্রেসিডেন্ট হেরে যাওয়ার পর উক্ত নাগরিককে অভিযোগ থেকে মুক্তি দেয়ার সাথে সাথে মামলার বাদী প্রেসিডেন্ট বেজি সাইদ ইসেবজির প্রতি মামলার যাবতীয় খরচ দেঘজিকে পরিশোধের আদেশ দিয়েছেন আদালত। একজন সাধারণ নাগরিকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলায় রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের হেরে যাওয়া ও ক্ষতিপুরণ দেয়ার এই রায়কে তিউনিসিয়ান বিপ্লবের ফসল হিসেবে আখ্যায়িত করেছে সেখানকার গণমাধ্যমের বিশ্লেষকরা। লাখো প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন বাংলাদেশে এমন দিনের অপেক্ষায় দেশের ১৭ কোটি মানুষ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।