পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশ ও ভারত দ্বিপক্ষীয় প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সন্ত্রাসবাদ দমন করবে। এমন কথা বলা হয়েছে, গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ও ভারতের সচিব পর্যায়ের বৈঠকে। বৈঠকটি অনুষ্ঠিত হয় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন মেঘনায়। বৈঠক শেষে ভারতের পররাষ্ট্র সচিব সুব্রামানিয়াম জয়শঙ্কর বলেন, আমি সন্ত্রাসবাদ ও চরমপন্থার বিরুদ্ধে ভারত সরকারের পক্ষ থেকে বাংলাদেশ সরকারের পদক্ষেপের প্রতি শক্তিশালী সমর্থন ব্যক্ত করতে এসেছি। এ ইস্যুতে আমরা দুই দেশ একে অন্যের সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে কাজ করছি। তিনি বলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে আমরা একসাথে কাজ করে যাচ্ছি। পরিস্থিতি মোকাবিলায় সব ধরনের সহযোগিতা করতে প্রস্তুত আছে নয়াদিল্লী। ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের বক্তব্য পর্যালোচনা করে দেখা যাচ্ছে, তার বক্তব্যে দুই ধরনের কথা রয়েছে। একবার তিনি বলেছেন, সন্ত্রাসবাদ দমনে বাংলাদেশ ও ভারত একসঙ্গে কাজ করবে। অন্যদিকে বলছেন,এ ইস্যুতে দুই দেশ একে অন্যের সঙ্গে কাজ করছে। এই ‘করব’ আর ‘করছি’-এর মধ্যে বিস্তর ব্যবধান ও স্ববিরোধিতা রয়েছে। এ নিয়ে বাংলাদেশের জনগণের মধ্যে দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। ফলে বিষয়টি জনগণের সামনে পরিষ্কার হওয়া দরকার। এদিকে ভারতের প্রভাবশালী পত্রিকা দ্য হিন্দুতে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে যে, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ইস্যুতে ভারত-মার্কিন জোটবদ্ধ হয়ে কাজ করবে। সম্প্রতি নিরাপত্তা ইস্যুতে বাংলাদেশ সফরে এসে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য ও দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই বিসওয়াল বলেছিলেন, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে বাংলাদেশ, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র একসঙ্গে কাজ করবে। এ নিয়েও দ্বিধা-দ্বন্দ্বের সৃষ্টি হয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্র সচিব অবশ্য প্রশ্ন রেখেছেন, বাংলাদেশের নিরাপত্তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ভারত কীভাবে কাজ করবে? তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র বলেছে, আমরা তো বলিনি। ঢাকাস্থ যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূত মার্শা ব্লুম বার্নিকাট বলেছেন, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র সব কিছুতেই একপথে জোটবদ্ধ হয়ে চিন্তা করেÑ এটা কখনোই নয়। বাংলাদেশের নিরাপত্তা পরিস্থিতি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের অতি উৎসাহী মনোভাব এবং সহযোগিতার নামে অতি তৎপরতা বাংলাদেশের মানুষকে ঘোর সংশয়ে ফেলে দিয়েছে। তাদের মনে প্রশ্ন জেগেছে, বাংলাদেশে কী এমন ঘটছে যে এ নিয়ে বৃহৎ দুই দেশকে একেবারে উঠেপড়ে লাগতে হবে! তাদের কথাবর্তায় মনে হচ্ছে, বাংলাদেশকে নিয়ে তাদের দরদের শেষ নেই।
পর্যবেক্ষকরা বহুদিন ধরে বলে আসছেন, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো বাংলাদেশকে একটি জঙ্গী রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করার জন্য বক্তব্য-বিবৃতির মাধ্যমে চেষ্টা করে আসছে। তাদের সাথে পার্শ্ববর্তী ভারতও সুর মেলাচ্ছে। এখন শোনা যাচ্ছে, তারা একসাথে কাজ করার চিন্তা করছে। অর্থাৎ বাংলাদেশে জঙ্গী আছে এবং তা দমনে একটি কুরুক্ষেত্র বানানোর প্রক্রিয়া তাদের কথাবার্তায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। নিরাপত্তা ইস্যুতে নিশা দেশাইয়ের সফর শেষ হতে না হতে জয়শঙ্করের সফর যেন এই ইঙ্গিত দেয়। অথচ দেশের জনগণ জানে, যে অর্থে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশ এবং ভারত জঙ্গী উত্থানের কথা এমনকি আইএস-এর অস্তিত্বের কথা বলছে, সে অর্থে কোনো জঙ্গীর উত্থান এ দেশে ঘটেনি। ভারত, পাকিস্তান, আফগানিস্তানসহ মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে সন্ত্রাসী ও জঙ্গী তৎপরতা যেভাবে লক্ষ্য করা যায়, বাংলাদেশে তা লক্ষ্যযোগ্য নয়। যে কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে, বাংলাদেশ সরকার বরাবরই সেগুলোকে বিচ্ছিন্ন ঘটনা বলে অভিহিত করেছে। কাজেই এসব বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ জঙ্গী রাষ্ট্রে পরিণত হয়েছে বা হচ্ছে বলে যেসব দেশ মনে করছে, তারা একেবারেই অমূলক ও ভিত্তিহীন দাবি করছে। পর্যবেক্ষকরাও মনে করছেন, বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ জাতীয় ইস্যুতে পরিণত হয়েছে, এমনটা মনে করার কোনো কারণ নেই। বরং এটাই প্রতীয়মান হচ্ছে, যেসব রাষ্ট্র সন্ত্রাসবাদ ইস্যুতে বাংলাদেশ নিয়ে অযাচিত উদ্বেগ প্রকাশ করছে, তারাই অনেকটা জোর করে জঙ্গী রাষ্ট্রের তকমা এঁটে দিতে চাইছে। এ উছিলায় যৌথভাবে কাজ করার কথা বলে বাংলাদেশে তাদের অনুপ্রবেশ ঘটাতে চাইছে। আমরা দেখেছি, বিশ্বের যে অঞ্চলেই যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র রাষ্ট্রগুলো জঙ্গীবাদ দমনের নামে অনুপ্রবেশ ও হামলা চালিয়েছে, সেখানেই জঙ্গীবাদ নামক সংকট বৃদ্ধি পেয়েছে। কখনোই শান্তি ফিরে আসেনি। উল্টো জনপদের পর জনপদ ধ্বংস এবং লাখ লাখ মুসলমানকে হত্যা করা হয়েছে। দেখা গেছে, যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্র দেশগুলো জঙ্গী বলতে কেবল মুসলমানদেরই চিহ্নিত করছে এবং মুসলমান নিশ্চিহ্ন করার মিশন চালিয়ে যাচ্ছে। এ কথাও বলা হচ্ছে, মুসলমানদের মধ্য থেকে বিপথগামী কিছু মানুষকে নিয়ে তারাই সন্ত্রাসী গোষ্ঠী সৃষ্টি করে জঙ্গী আখ্যা দিচ্ছে এবং দমনের নামে মুসলমান অধ্যুষিত দেশগুলোতে হামলা চালাচ্ছে। এটা অনেকটা ‘সাপ হয়ে দংশন করা ওঝা হয়ে ঝাড়া’র মতো হয়ে দাঁড়িয়েছে। এটা এখন স্পষ্ট আইএস কাদের সৃষ্টি। সেই আইএস-এর প্রপঞ্চ এখন বাংলাদেশেও তারা ছড়িয়ে দিতে চাইছে। তাদের এই মিশন যে মুসলমান ধ্বংসের নীতি ছাড়া কিছুই নয়, তা বোধকরি ব্যাখ্যা করে বলার অবকাশ নেই। মুসলমান নিধনের এই সুর এখন যুক্তরাষ্ট্রের রিপাবলিকান পার্টির প্রেসিডেন্ট পদপ্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথায়ও ধ্বনিত হচ্ছে। আসলে গভীর ষড়যন্ত্র ও হামলার মাধ্যমে দুনিয়ার বুক থেকে মুসলমান উচ্ছেদে যুক্তরাষ্ট্রের যে নীতি, তাই ট্রাম্পের নির্বাচনী প্রচারণায় প্রতিফলিত হচ্ছে। জঙ্গীবাদ বলতে ভারত যা প্রচার করে তাও মূলত মুসলিম বিদ্বেষজাত। ভারতের দৃষ্টিতে মুসলমানরাই জঙ্গীবাদী। অথচ ভারতে হিন্দুত্ববাদী, মাওবাদী সন্ত্রাসীরাও রয়েছে। তাদের কথা বলা হয়না। বলাবাহুল্য, বাংলাদেশের নিরাপত্তা ইস্যু নিয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সাম্প্রতিক যে দৌড়ঝাঁপ তা অনেকটা বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে নাক গলানোর পর্যায়ে পড়ে। বাংলাদেশে জঙ্গীবাদের উত্থান ও আইএস-এর অস্তিত্বের বিষয়টি এতদিন যুক্তরাষ্ট্র পরোক্ষভাবে বলে আসছিল। এখন দেখা যাচ্ছে, তারা আর পরোক্ষে কথা বলতে রাজী নয়, অনেকটা সরাসরিই বলছে, বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদের উত্থান হতে যাচ্ছে। এর সাথে তাল মিলিয়ে ভারতও যেন একই কথা বলতে চাইছে। তা নাহলে বাংলাদেশে সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় যৌথ সহযোগিতার কথা আসবে কেন? আমরা মনে করি, কোনো দেশে আভ্যন্তরীণভাবে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গী গোষ্ঠীর উত্থান হওয়ার আশঙ্কা থাকলে যে কোনো বন্ধুপ্রতিম রাষ্ট্র তার তথ্য সংশ্লিষ্ট দেশের সরকারকে জানাতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নিউজিল্যান্ডসহ পাঁচটি দেশ ‘ফাইভ আইজ’ বা পঞ্চ চক্ষু গঠন করা হয়েছে এই কারণে, যাতে দেশগুলোতে কোনো ধরনের নিরাপত্তা বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা থাকলে আগেভাগে তথ্য আদান-প্রদান করতে পারে। আমরা মনে করি, বন্ধুপ্রতিম দেশ হিসেবে বাংলাদেশকেও অন্যান্য দেশ এ ধরনের তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করতে পারে। দুঃখের বিষয়, যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধিদের সফর ও তাদের কথাবার্তায় প্রতীয়মান হচ্ছে, তারা যেন স্বশরীরে উপস্থিত থেকে কাজটি করতে পারলে স্বস্তি পাবে। এ ধরনের অভিপ্রায় অনভিপ্রেত ও অগ্রহণযোগ্য।
আমরা দ্ব্যর্থহীনভাবে বলতে চাই, বাংলাদেশে জঙ্গীবাদ ও সন্ত্রাসবাদ জাতীয় কোনো সমস্যায় পরিণত হয়নি। আমাদের দেশের ধর্মপ্রাণ মানুষ কোনো দিনই এ ধরনের চিন্তা ঠাঁই দেয়নি এবং কোনোরূপ উগ্র পন্থাকে সমর্থন করেনি, করবেও না। তারা কিছু বিচ্ছিন্ন ঘটনাকে কেন্দ্র করে মোড়ল রাষ্ট্র কর্তৃক জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদের মতো ভয়ংকর অপবাদ চাপিয়ে দেয়াও মেনে নেবে না। কাজেই যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সহযোগিতার নামে যৌথভাবে কাজ করা এবং করা হচ্ছে বলে যে কথা শোনা যাচ্ছে, এ ব্যাপারে সরকারের তরফ থেকে জনগণকে স্পষ্টভাবে জানাতে হবে। একইভাবে জঙ্গী ও সন্ত্রাসবাদ দমনের বিষয়টি সরকারের তরফ থেকে অহরহ বলার ক্ষেত্রেও সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। আমরা দেখেছি, এক সময় সরকারের তরফ থেকে আইএস আছে বলে ব্যাপক প্রচার করা হয়েছে। পরবর্তীতে তার সাথে সুর মিলিয়ে যুক্তরাষ্ট্রও আইএস আছে বলে দাবী করলে, সরকার ব্যাকফুটে গিয়ে বলতে শুরু করে এবং এখনও বলছে আইএস নেই। কাজেই যে কোনো স্পর্শকাতর বিষয় নিয়ে কথা বলা ও প্রচারণা যে মারাত্মক পরিস্থিতি সৃষ্টি ও অন্য দেশকে নাক গলানোর সুযোগ করে দেয়, তা এ ঘটনা থেকে সহজেই বোঝা যায়। কাজেই কি বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও ভারতের সঙ্গে কথাবার্তা হয়েছে তা সরকারকে জনগণের কাছে অবিলম্বে খোলাসা করে বলতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।