পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নদী রক্ষায় হাইকোর্ট এক ঐতিহাসিক রায় ও নির্দেশনা ঘোষণা করেছেন। তুরাগ নদ সংক্রান্ত একটি রিট আবেদনের প্রেক্ষিতে বিচারপতি মইনুল ইসলাম চৌধুরী ও বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের বেঞ্চ টানা তিনদিন এ রায় ও নির্দেশনা প্রদান করেন। রায়ে কোর্ট তুরাগ নদকে জীবন্ত সত্ত্বা হিসাবে ঘোষণা করেছেন। আইন বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ঘোষণায় শুধু তুরাগ নয়, দেশের সব নদীই জীবন্ত সত্ত্বা হিসাবে পরিগনিত হবে। নদীর ক্ষতি জীবন্ত মানুষের যে কোনো ক্ষতির মতোই অপরাধ হিসাবে গণ্য হবে। কোর্টের মতে, দেশে শত শত নদী রয়েছে। এর মধ্যে ৪৫০টি নদ-নদী অবৈধ দলখদারদের দ্বারা আক্রান্ত। এসব নদী দখলকে কেন্দ্র করে পৃথক পৃথক মামলা হয়, পৃথক পৃথক আদেশ হয়। দখলদাররা ফের গিয়ে দখল করে। এমনটি চলতে দেয়া যায় না। নদনদী নিয়ে এসব কানামাছি খেলা বন্ধ হওয়া উচিৎ। প্রদত্ত রায়ে বলা হয়েছে, নদী দখলকারী ব্যক্তি ইউনিয়ন, উপজেলা, পৌরসভা ও জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য হবেন। এ ধরনের অপরাধে জড়িত ব্যক্তি ব্যাংক ঋণ পাবেন না। রায়ে আরও একটি গুরুত্ব দিক উঠে এসেছে, যেখানে তুরাগসহ সকল নদনদী রক্ষায় জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে আইনগত অভিভাবক নির্ধারণ করা হয়েছে এবং কমিশন আইন সংশোধন করে তাকে স্বাধীন ও কার্যকর প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। কোর্ট রায়ে বলেছেন, যেহেতু জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনকে অভিভাবক ঘোষণা করা হলো, সেহেতু আজ থেকে দেশের সব নদনদী সুরক্ষা, সংরক্ষণ ও শ্রীবৃদ্ধিসহ যাবতীয় সব ধরনের বহুমুখী উন্নয়নে কমিশন বাধ্য থাকবে। এই সঙ্গে জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের পক্ষ থেকে যেসব সংশোধন প্রস্তাব দেয়া হয়েছে, রায়ে তা বিবেচনা করে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে বলা হয়েছে। রায়ের নির্দেশনায় দেশের সব নদী খাল, বিল জলাশায়ের ভৌগোলিক অবস্থান নির্ণয় ও জীব-বৈচিত্রের তথ্যাদি সংগ্রহ করে ইউনিয়ন, পৌরসভা, জেলা-উপজেলার উন্মুক্ত স্থানে রাখতে বলা হয়েছে। নাগরিক সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য নির্দিষ্ট কিছু পদক্ষেপ নিতেও বলা হয়েছে।
বাংলাদেশকে বলা হয় নদীপ্রধান দেশ। শত শত নদী এই ক্ষুদ্র ভূখণ্ড দিয়ে প্রবাহিত হয়। এদেশের মানুষের জীবনযাত্রা, জীববৈচিত্র্য, উৎপাদন ব্যবস্থা, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, সভ্যতা ইত্যাদি সব কিছুর সঙ্গে নদীর ওতপ্রোত সম্পর্ক বিদ্যমান। নদী বাংলাদেশের প্রাণ। নদী না বাঁচলে বাংলাদেশও বাঁচবে না। অথচ গভীর উদ্বেগের বিষয়, কয়েকশ নদী ইতোমধ্যেই মানচিত্র থেকে বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এর একাধিক কারণ থাকলেও প্রধান কারণ, অভিন্ন নদী থেকে ভারতের নির্বিচার পানি প্রত্যাহার। পানি শূণ্যতার কারণে এসব নদী শুকিয়ে মরে গেছে। যেসব নদী এখনো টিকে আছে, তাদেরও অধিকাংশ মরো মরো। এর বিরূপ প্রতিক্রিয়া জনজীবন, উৎপাদন ব্যবস্থা, প্রকৃতি ও পরিবেশে মারাত্মকভাবে প্রতিফলিত হচ্ছে। টিকে থাকা নদীগুলোর আর একটি বড় বিপদ হলো, এগুলো নির্বিচারে দখল হয়ে যাচ্ছে। ভয়াবহ দূষণের শিকার এসব নদী। দখল ও দূষণের কারণে তাদের অস্তিত্ব ও জীববৈচিত্র্য মারাত্মক হুমকির সম্মুখীন। দখল ও দূষণ থেকে নদীগুলোর সুরক্ষা ও প্রবাহমান করা সম্ভব না হলে দেশের পরিস্থিতি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, তা সহজেই অনুমেয়। যে কোনো মূল্যে নদী রক্ষা করতে হবে। এর কোনো বিকল্প নেই। এমতাবস্থায়, হাইকোর্ট যে রায় ও নির্দেশনা দিয়েছেন তাতে নদী রক্ষায় নতুন দিগন্তের উন্মোচন হবে বলেই পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন। তাদের অভিমত, এই রায় ও নির্দেশনাকে সংবিধানের মতোই মূল্যবান দলিল হিসাবে গ্রহণ করতে হবে এবং তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে। নদী রাস্তাঘাট বা যে কোনো সম্পদের তুলনায় অধিক গুরুত্বপূর্ণ। তাই নদী রক্ষায় হেলাফেলা করার কোনো সুযোগ নেই।
অবৈধ দখল থেকে নদী উদ্ধার, সীমানা নির্ধারণ ও সংরক্ষণ, দূষণ প্রতিরোধ এবং খনন ও সংস্কারের মাধ্যমে প্রবাহবান করা বা রাখার কাজটি মোটেই সহজ নয়। এজন্য উপযুক্ত আইনী ব্যবস্থা, প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং সকল পর্যায়ের মানুষের সচেতনতা অপরিহার্য। সরকার ইতোমধ্যে শতবর্ষী ডেল্টা প্লান বাস্তবায়নের উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। এই প্লানে নদী রক্ষার কমূর্সচী আছে, যাতে ৬৪টি জেলায় ৮৮টি নদী এবং ৩৫২টি খাল খননের কথা আছে। দেশের তাবৎ নদীর যা হাল, তাতে ডেল্টা প্লানের কর্মসূচীকে আরো সাম্প্রসারণ করা উচিৎ বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন। জাতীয় নদী রক্ষা কমিশনের কার্যপরিকল্পনার সঙ্গে ডেল্টা প্লানের নদী রক্ষা কর্মসূচী সমন্বিত করে বাস্তবায়ন করা গেলে অধিক কার্যকর ও তরিৎ সুফল পাওয়া যাবে বলে তাদের দৃঢ় বিশ্বাস। কথা হলো, প্লান বা কর্মসূচী নেয়াই বড় নয়, এর অনুপুংখ ও সুচারু বাস্তবায়নের ওপরই প্রকৃত সাফল্যে নির্ভর করে। হাইকোর্ট তার রায়ে বলেছেন, সংবিধান অনুসারে পরিবেশগত সম্পদের, বনের, নদীর, সমুদ্রসৈকতের সব মালিকানা রাষ্ট্রকে প্রদান করা হয়নি। এখানে রাষ্ট্রের অবস্থান হলো ট্রাস্টি। রাষ্ট্রের অবশ্যই কর্তব্য হলো জনগণের পক্ষে সব সম্পদ রক্ষা করা। কোর্ট রায়ের একটি অনুলিপি প্রধানমন্ত্রীকে পাঠাতে বলেছেন, যাতে তিনি জরুরি ভিত্তিতে পদক্ষেপ নিতে পারেন। আমরা আশা করি, কোর্টের রায় ও নির্দেশনা বাস্তবায়নে সরকার দ্রুত উদ্যোগ ও পদক্ষেপ নেবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।