পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শঙ্খ ঘোষ পশ্চিম বঙ্গের একজন বিখ্যাত কবি। সুভাষ মুখোপাধ্যায়, জয় গোস্বামী প্রমুখের সাথে এক কাতারে যার নাম। সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ও একজন কবি। তবে বাংলাদেশে তিনি ঔপন্যাসিক হিসাবেই সমধিক পরিচিত। সেই শঙ্খ ঘোষ সেদিন ঢাকায় এসেছিলেন। ১ ফেব্রুয়ারি বই মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানের অন্যতম অতিথি হিসাবে এ ধরণের উঁচু মাপের কবি সাহিত্যিকদের সম্মান দেওয়ার মধ্যে বাংলাদেশিদের চিত্তের উদারতা প্রকাশ পায়। সেই শঙ্খ ঘোষ বইমেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে একটি সংক্ষিপ্ত ভাষণ দিয়েছেন। সেখানে তিনি বলেছেন, ‘মেঘনা নদীর কুলে চাঁদপুর আমার জন্মভূমি। সন্ধ্যা নদীর কূলে বানারীপাড়ায় আমার পিতৃপিতামহের ভিটে, কীর্তনখোলা নদীর ধারে বরিশাল শহরে লালিত হয়েছি সাড়ে তিন বছর বয়স পর্যন্ত। আর গোটা স্কুল জীবনটা আমার কেটেছে পদ্মা নদীর পারে হার্ডিঞ্জ ব্রিজ সংলগ্ন পাকশী নামের এক আশ্চর্য কলোনিতে।
১৫ বছর বয়সের পর জীবনে আরও ৭২ বছর আমার কাটল গঙ্গার কূলে যে কলকাতা শহরে- সেখান থেকে বুড়িগঙ্গার তীরে ঢাকায় এসেছি আমি, আপনাদের আহূত এক অতিথি হিসাবে। সম্মানবোধ করছি আমি তাই, কিন্তু সেই সঙ্গে একটা সংকোচও ছেয়ে যাচ্ছে মনে। যে দেশের হাওয়ায় মাটিতে জলে গোটা কৈশোরে কেটেছে, সেই দেশই তো আমার। ৭২ বছর ধরে প্রায় প্রতিমুহূর্তে সেই ১৫ বছরকেই তো ধারণ করে আছি আমি। তাই এটা আমারও দেশ। এখানে কি আমার অতিথি হয়ে আসা সাজে?’
শঙ্খ ঘোষের এই জবানি থেকেই আমরা দেখতে পাচ্ছি যে, তার জন্ম হয়েছে বাংলাদেশের চাঁদপুর জেলায়। এখানেই কেটেছে তার শৈশব। ১৫ বছর কেটেছে তার ঈশ্বরদীর পাকশীতে। তারপর তিনি চলে গেলেন ইন্ডিয়ায়, সম্ভবত তার অভিভাবকদের সাথে। কেন চলে গেলেন? এখানে থাকলে কি হতো? শঙ্খ ঘোষ আধুনিক কবিদের মধ্যে অত্যন্ত বড় মাপের কবি। আমি ব্যক্তিগতভাবে তার কবিতা পছন্দ করি এবং পড়ি। সুভাষ মুখোপাধ্যায় এবং জয় গোস্বামীর কবিতাও আমি খুব আগ্রহ নিয়ে পড়ি। ওদের দু তিনটা কবিতার বই আমার ব্যক্তিগত লাইব্রেরিতে রয়েছে। সুভাষ এবং জয় গোস্বামী পশ্চিমবঙ্গ অর্থাৎ ভারতীয় বাংলায় জন্ম নিয়েছেন। সুভাষ সেখানকার আবহাওয়ায় বড় হয়েছেন এবং সেখানেই দেহত্যাগ করেছেন। জয় গোস্বামী সেখানেই আছেন এবং এখনও বুড়িয়ে যাননি।
কিন্তু সুনীল বাবুর বিষয়টা কি? অত্যন্ত বড় মাপের কথা সাহিত্যিক। বাংলাদেশে ‘প্রথম আলো’ নামে যে দৈনিক পত্রিকাটি রয়েছে সেটির নামও তো নেওয়া হয়েছে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের উপন্যাস প্রথম আলো নাম থেকে। তিনিও জন্ম নিয়েছেন বাংলাদেশের ফরিদপুরে। অত্যন্ত উঁচুমানের কথা সাহিত্যিক। তার উপন্যাস এদেশে প্রচুর চলে। কিন্তু তিনি দেশ বিভাগের পর ভারতীয় বাংলায় চলে গেলেন। কেন গেলেন? এখানে থাকলে কি হতো? এখানে কি ঐ সব উপন্যাস লিখতে পারতেন না? আমাদের দেশে অনেক তথাকথিত প্রগতিবাদী বন্ধুর গর্ব করে বলতে শুনি, শঙ্খ ঘোষ, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় আমাদেরই লোক। তো আমাদেরই লোক হলে আমাদের এখানে থেকে গেলেন না কেন?
বাংলাদেশে এক সময় শরৎচন্দ্রের উপন্যাস ঘরে ঘরে পঠিত হতো। আমার কাছেও শরৎ সমগ্র রয়েছে। তার পর আর একজনের বই তেমনি গ্রাম গঞ্জের ঘরে ঘরে দেখেছি। তিনি হলেন নজিবর রহমান সাহিত্য রত্ন। তার উপন্যাসের নাম ‘আনোয়ারা’। শরৎচন্দ্রের মতো অথবা তার চেয়েও বেশি জনপ্রিয় হয়ে উঠেছিলেন বাংলাদেশের আরেক জন কথা সাহিত্যিক। তিনি হলেন হুমায়ুন আহমেদ। হুমায়ুন আহমেদের অন্তত ২ শ বই আমি কিনে পড়েছি। তবে এখন শ খানেক বই ঘরে রয়েছে। বাকিগুলো বন্ধুবান্ধব আত্মীয়স্বজন পড়ার নামে সেলফ থেকে সেই যে নিয়ে গেছে, আর ফেরত দেয়নি।
দুই
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, আমার মূল্যায়ন মতে, পশ্চিমবঙ্গের শ্রেষ্ঠ তিন কথাশিল্পীর অন্যতম। অপর দুই জন হলেন, সমরেশ মজুমদার ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়। তিনিও জন্ম নিয়েছেন এই বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। তারপর থাকলেন না। অন্যদের মতোই ইন্ডিয়াতে চলে গেলেন। কেন গেলেন? এখানে থাকলে কি হতো? এখানে বসে কি তার সেই বিপুল সাহিত্যকর্ম রচনা করা সম্ভব হতো না? নিশ্চয়ই হতো। বাংলাদেশে ‘মানব জমিন’ বলে ট্যাবলয়েড সাইজের যে একটি দৈনিক পত্রিকা রয়েছে সেই পত্রিকারটির নামও শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের উপন্যাস থেকে নেওয়া হয়েছে। সেই উপন্যাসটি তো এদেশেও লেখা যেতো। সুভাষ মুখোপাধ্যায় যখন পশ্চিমবঙ্গে দাঁড়িয়ে বলেন এপার বাংলা আর ওপার বাংলা, তখন তিনি এপার বাংলা বলতে পশ্চিমবঙ্গকে বোঝান, আর ওপার বাংলা বলতে বাংলাদেশকে বোঝান। শঙ্খ ঘোষ সেদিন অর্থাৎ ১লা ফেব্রুয়ারি ঢাকার বই মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে সুভাষ মুখোপাধ্যায়কে উদ্ধৃত করেছেন। তিনি বলেছেন, যেহেতু আমি এই মুহূর্তে বাংলাদেশে দাঁড়িয়ে আছি তাই সুভাষের মতো আমিও বলবো, এপার বাংলা আর ওপার বাংলা। তবে পশ্চিমবঙ্গের লোক হয়েও আমি এই মুহূর্তে যখন ঢাকায় আছি তখন বলবো, এপার বাংলা আর ওপার বাংলা। তবে এখানে আছি বলে আমি এপার বাংলা বলতে বুঝবো বাংলাদেশ, আর ওপার বাংলা বলতে বুঝবো পশ্চিমবঙ্গ।
কার কথা বলবো, আর কার কথা বলবো না। এই যে মহানায়িকা সুচিত্রা সেন, তার জন্মও তো বাংলাদেশের পাবনায়। এই সেন পরিবার চৌদ্দ পুরুষ ধরে ঢাকায় বসবাস করেছেন। গেন্ডারিয়ায় ১৭ বিঘা জমি কিনে দীননাথ সেন একটি বাড়ি করেন। সেখানেই তিনি বাস করতেন। এখনও ঢাকার গেন্ডারিয়াতে দীননাথ সেনের নামে একটি রাস্তা রয়েছে। দীননাথ সেনের পুত্রের নাম আদিনাথ সেন। আদিনাথ সেন ছিলেন একজন স্কুল শিক্ষক। সুচিত্রা সেন হলেন আদিনাথ সেনের পুত্রবধু। সেই সুবাদে ঢাকায় যে রাস্তাটির নাম দীননাথ সেন রোড সেই দীননাথ সেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেনের দাদা শ্বশুর। ভূবন মোহিনী রূপের অধিকারীনী সুচিত্রা সেন। রূপের ঝলকে বিয়ে করেন ধনাঢ্য ব্যক্তি ব্যারিষ্টার দীবানাথ সেনকে। সেই সুচিত্রা সেনও চলে গেলেন ইন্ডিয়াতে। এখানে থাকলেন না কেন? থাকলে কি হতো? অথচ আমরা অর্থাৎ বাংলাদেশিরা সুচিত্রা সেনকে নিয়ে গর্ব করি। পাবনাতে আজও যে বাড়িটি সুচিত্রা সেনদের ছিল, সরকার সেটি সযতে্ন রক্ষা করছেন। বাংলায় একটি প্রবাদ আছে। সেটি হলো, ‘জন্ম হোক যথা তথা, কর্ম হোক ভাল’। ওপরে যাদের নাম আমি করলাম এদের সকলেরই জন্ম বাংলাদেশে। অথচ কর্ম কিন্তু সব পশ্চিমবঙ্গ তথা ভারতে। তাহলে কোন দেশের নাম তারা উজ্জল করলেন? ভারতের নয় কি? অথচ, ওদের জন্ম বাংলাদেশে হয়েছিল বলে আমরা ওদেরকে নিয়ে নাচানাচি করি। এগুলো দেখে মনে পড়ে একটি ভারতীয় হিন্দি ছবির গানের একটি কলি, ‘বেগানা শাদি মে আব্দুল্লা দিওয়ানা’। আমাদের এই আদেখলাপনা আর মনে হয় কোনো দিন যাবে না।
তিন
আমরা কণ্ঠশিল্পী মিতালি মুখার্জিকে নিয়ে খুব নাচানাচি করি, গর্ববোধ করি। মিতালি মুখার্জির বিষয়টি কিন্তু সম্পূর্ণ আলাদা। এই ভদ্রমহিলা জন্ম নিয়েছেন বাংলাদেশের ময়মনসিংহে। বড় হয়েছেন এদেশে। এই দেশে গান করে তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন। এদেশের একটি সিনেমার নাম ‘দুই পয়সার আলতা’। ঐ সিনেমায় তার কন্ঠে একটি গান রয়েছে। গানটির প্রথম লাইন, ‘এই দুনিয়া এখন তো আর সেই দুনিয়া নাই’। এই গানটি গেয়ে তিনি জাতীয় পুরস্কার পেয়েছেন। বাংলাদেশের সঙ্গীত ও সাংস্কৃতিক জগতে মিতালি মুখার্জি ছিলেন এক সন্মানীয়া ও শ্রদ্ধেয়া ব্যক্তিত্ব। বাংলাদেশ তাকে সব দিয়েছে। অথচ, তিনি বিয়ে করলেন এক অবাঙ্গালী ভারতীয় হিন্দুকে। নাম ভুপেন্দর সিং। এখন তিনি স্বামীর সাথে ভারতের বোম্বাইয়ে বসবাস করছেন এবং সেখানে স্থায়ী হয়েছেন। তিনি ভারতীয় নাগরিকত্বও গ্রহণ করেছেন। খ্যাতি, অর্থ ও যশ সবকিছু পাওয়ার পরেও মিতালী কেন ভারতে গেলেন? কিসের টানে? কেন এখানে থাকলেন না? বাংলাদেশের ১ কোটি ৩৬ লক্ষ হিন্দুর মধ্যে বিয়ে করার মতো একজন হিন্দুকেও কি তিনি পেলেন না? পেলেন ভারতের এক গুজরাটি হিন্দুকে?
ওপরে যাদের নাম বললাম তারা ছাড়াও রয়েছেন আরও অনেকে যাদের জন্ম বাংলাদেশে কিন্তু পাড়ি জমিয়েছেন ভারতে। পশ্চিমবঙ্গ কমিউনিস্ট পার্টির শ্রেষ্ঠ নেতা জ্যোতিবসুর জন্মও এই ঢাকার সোনার গায়ের। তাই বলে তিনি কি বাংলাদেশের মুখ উজ্জল করেছেন? নাকি ভারতের?
প্রগতিবাদীতা ভালো। অসাম্প্রদায়িকতা ভালো। তাই বলে প্রগতিবাদী আর অসাম্প্রদায়িক সাজার জন্য তথ্য এবং ইতিহাসের বিকৃতি ঘটানো রীতিমতো অপরাধ। সেই কাজটিই এখন চলছে। কেন এরা বাংলাদেশে জন্ম নিয়েও ভারতে গেছেন, সেটি আমাদের নিঃসংকোচে বলতে হবে। কোদাল কে কোদাল বলতে হবে।
চার
ইতিহাসকে কি রকম নিজের মতো করে সাজানো হচ্ছে সেটা দেখুন কলকাতার এক টেলিভিশন সিরিয়ালে। সিরিয়ালটির নাম ‘নেতাজি’। সিরিয়ালে দেখানো হচ্ছে বঙ্গভঙ্গ। আর সমগ্র সিরিয়ালটির ব্যাকগ্রাউন্ডে গাওয়া হচ্ছে ‘বন্দেমাতরম’ গানটি। অনেক জায়গাতেই বলা হয়েছে ব্রিটিশরা তাদের ভেদ নীতির স্বার্থে বঙ্গভঙ্গ করছে। তাই তার বিরুদ্ধে অনুশীলন সমিতির স্লোগান হলো বন্দেমাতরম। এখানে ইতিহাসের ফাঁকটি দেখুন। বঙ্কিচন্দ্রের আনন্দমঠ উপন্যাসটি মুদ্রিত হয় ১৮৯২ সালে। ঐ বইয়ে বন্দেমাতরম স্লোগানটি উচ্চারিত হয়। অথচ বঙ্গভঙ্গ হয় এই বইটি রচনার ১৩ বছর পর ১৯০৫ সালে। নেতাজি সুভাষচন্দ্র বসুর জন্ম হয় ১৮৯৭ সালে। তার মাত্র ৮ বছর পর বঙ্গভঙ্গ হয়। বঙ্গভঙ্গের বিরুদ্ধে আন্দোলন করার বয়স তখনও সুভাষচন্দ্রের হয়নি। অথচ এক শ্রেনীর ইন্ডিয়ান রাইটার এই সব প্রচারণা চালাচ্ছেন।
বাংলাদেশেরও ঘুম ভাঙার সময় হয়েছে। আমাদের ইতিহাসও সঠিকভাবে লেখা হচ্ছে না। হাজার বছরের বাঙালী যদি আমাদের ঐতিহ্য হয় তাহলে তেমনি দেড় হাজার বছরের ইসলাম ও আমাদের ঐতিহ্য। বাংলাদেশের ইতিহাস কিন্তু ৫২ থেকে ৭১ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। সঠিক ইতিহাস লিখতে হবে। অখন্ড বাংলার প্রতি যদি তাদের এতই দরদ থেকে থাকে তাহলে তারাই আবার ৪৭ সালে বাংলাকে দুই টুকরো করেছেন কেন? এসব অনেক কথাই আসবে। ভারত বিভক্তির জন্য মুসলমানদের দায়ী করা হয়। কিন্তু কংগ্রেস কেন ক্যাবিনেট মিশন প্ল্যান প্রত্যাখ্যান করলো? এসব কথা উঠবে। আমাদের দেশে আগামী ৫ বছর সক্রিয় রাজনীতি কিছুটা ছাই চাপা থাকবে। কিন্তু ১৯৪৭ এর আগে থেকে বাংলাদেশ বা বাংলার ইতিহাস প্রত্নতাত্বিক খননের মতো খুঁড়ে বের করার কাজ চলবে।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।