পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ঢাকার চারপাশ দিয়ে প্রবাহিত নদীগুলোই হচ্ছে ঢাকার লাইফ লাইন। ঐতিহাসিক, রাজনৈতিক ধারাবাহিকতায় ঢাকার জনপদকে সুজলা-সুফলা এবং সুরক্ষিত নাগরিক সভ্যতা গড়ে ওঠার মূলে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর প্রবাহই প্রধান ভূমিকা রেখেছে। এসব নদীর সুপেয় স্বচ্ছ পানি কৃষির সেচ, বাণিজ্যিক পরিবহন এবং মৎস্যের উৎস হিসেবে যুগ যুগ ধরে মানুষের চাহিদা পূরণ করে এসেছে। অথচ মাত্র কয়েক দশকের ব্যবধানে ঢাকার চারপাশের নদীগুলো সব উপযোগিতাই হারিয়ে ফেলেছে। অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নে এসব নদীর পানি স্বাভাবিক গুণাগুণ হারিয়ে ফেলেছে। সেই সাথে অবাধে চলেছে নদী ভরাট, অপদখল এবং নদী বিনাশী নানান তৎপরতা। অনেক দেরিতে হলেও দেশের সর্বোচ্চ আদালত সরকারকে ঢাকার নদীগুলোকে রক্ষা ও উদ্ধারের নির্দেশ জারি করেছিলেন ২০০৯ সালে। এরপর বুড়িগঙ্গা পুনরুদ্ধার ও রক্ষায় সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনেক হম্বিতম্বি, হাঁক-ডাক শোনা গেছে, টাস্কফোর্স গঠন এবং হাজার কোটি টাকার প্রকল্পও গ্রহণ করতে দেখা গেছে। প্রকল্পের টাকা পানিতে খরচ করা হলেও নদীর মরণদশা কখনো ঘোচেনি। দখল দূষণ রোধ এবং বিষাক্ত শোধনে কোনো অগ্রগতি নেই।
গতকাল প্রকাশিত একটি রিপোর্টে জানা যায়, হাইকোর্টের নির্দেশনার আলোকে ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর সীমানা নির্ধারণ, দখলমুক্তকরণ, সংরক্ষণ এবং দূষণ রোধে গঠিত বিশেষ টাস্কফোর্স নামকাওয়াস্তে তার কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। অনেক হাঁক-ডাকের মধ্য দিয়ে নদীর অপদখলীয় ভূমি উদ্ধার ও অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদ অভিযান শুরু হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। শুরুতেই নদীর সীমানা নির্ধারনের পদ্ধতি নিয়ে নানা প্রশ্ন উঠেছিল সে সব প্রশ্ন অগ্রাহ্য করেই বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদীর সীমানা নির্ধারণে ৪.০৬৩টি পিলার বসানো হয়েছিল। নদী উদ্ধারে টাস্কফোর্স নদীগুলোর হালনাগাদ অবস্থা সরজমিন পরিদর্শন শেষে তার ৩০তম সভায় যে রিপোর্ট দিয়েছিল তাতে দেখা গেছে, স্থাপিত সীমানা পিলারগুলোর মধ্যে ৪২২টি পিলার সঠিক স্থানে স্থাপন করা হয়নি, ২৬৪টি পিলার ক্ষতিগ্রস্ত ১৪৮টি পিলার দৃশ্যমান ছিল না এবং ৩৬টি পিলারের অস্তিত্বই খুঁজে পাওয়া যায়নি। অন্যদিকে নদীর পানির গুণগতমান পর্যবেক্ষণ সম্পর্কিত জাতীয় পরিবেশ অধিদফতরের এক রিপোর্টে, শুষ্ক মৌসুমে (জানুয়ারী-মে) বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ ও বালু নদী থেকে সংগৃহিত নমুনা পরীক্ষা করে দেখা যায়, এসব নদীর পানিতে অক্সিজেনের উপস্থিতির হার শূন্য। পানির এই অবস্থা জলজপ্রাণী ও মৎস্য চারণের অযোগ্য। এটি ছিল ২০১০ সালের রিপোর্ট। এরপর বুড়িগঙ্গা বাঁচাতে সরকার বহু কোটি টাকার প্রকল্প গ্রহণ করেছে, কিছুদিন বুড়িগঙ্গা থেকে বর্জ্য অপসারণ করতেও দেখা গেছে, কোটি কোটি মিটার মাটি অপসারণ ও যমুনা নদী থেকে চ্যানেল করে পানি প্রবাহ বৃদ্ধি করেও বুড়িগঙ্গাকে দূষণমুক্ত করার কথা শোনানো হয়েছে। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হলেও কাজের কাজ কিছুই হয়নি। ঢাকা শহরের পানি সরবরাহ পানি নিরাপত্তা সম্পর্কিত ইউএনডিপি’র রিপোর্টেও ঢাকার চারপাশের নদীগুলোর ভয়াবহ দূষণকে নদীর অস্তিত্ব ও পানি নিরাপত্তার জন্য বড় ধরনের হুমকি হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়েছে।
উজানে ভারতের বাঁধ নির্মাণ ও পানি প্রত্যাহারের কারণে এমনিতেই বাংলাদেশের নদী-নদীগুলোর অস্তিত্ব চরম হুমকির মুখে পড়েছে। এহেন বাস্তবতায় নদীগুলো নাব্য এবং সেচ প্রকল্পগুলো বাঁচিয়ে রাখতে দেশের প্রায় সবগুলো প্রধান নদীতে ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের উদ্যোগ অব্যাহত রাখা প্রয়োজন। বিশেষত: ঢাকা নগরীর বাসযোগ্যতা পুনরুদ্ধার, পরিবেশগত জীববৈচিত্র্য ও খাদ্যনিরাপত্তা এবং জনস্বাস্থ্য রক্ষায় ঢাকার চারপশের প্রধান চারটি নদী ভরাট ও দূষণ স্থায়ীভাবে বন্ধ করে পানির স্বাভাবিক গুণাগুণ ও প্রবাহ ফিরিয়ে আনার কার্যকর উদ্যোগ নিতে হবে। দেশের অবকাঠামো উন্নয়ন এবং ঢাকার যানজট নিরসনে হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বড় বড় মেগা প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। ডিজিটাল উন্নয়ন ও মধ্য আয়ের দেশে পরিণত করার রাজনৈতিক শ্লোগানও চলছে সমান তালে। কিন্তু ঢাকা শহরকে বিশ্বের অন্যতম নিকৃষ্ট, অনিরাপদ ও বসবাসের অযোগ্য নগরীতে পরিণত করার নেপথ্য কুশীলবদের বিরুদ্ধে কোন ব্যবস্থাই নেয়া হচ্ছে না। হাজারিবাগের ট্যানারি থেকে প্রতিদিন শত শত টন তরল রাসায়নিক বর্জ্য সরাসরি বুড়িগঙ্গা নদীতে মিশে দূষণ ঘটাচ্ছে। দশকের পর দশক ধরে এ অবস্থা চললেও সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতর ও বিভাগগুলো কিছুই করছে না। ঢাকা শহরের বাসযোগ্যতা এবং চারটি নদীকে তিলে তিলে হত্যার দায়ে দখল ও দূষণকারীদের বিচার হতে পারে। সেই সাথে পরিবেশ, পানিসম্পদ এবং নগর ব্যবস্থাপনার দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারী কর্মকর্তারাও তাদের সীমাহীন ব্যর্থতার দায় এড়াতে পারেন না। ঢাকার চারপাশের নদী, খাল, হাউজিং প্রকল্পের নামে নিম্ন ভূমি দখলকারীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের পাশাপাশি নদী দূষণ ও দখলবাজি বন্ধের কাগুজে তৎপরতার বদলে নগরবাসী সত্যিকারের ও ফলপ্রসূ উদ্যোগ দেখতে চায়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।