Inqilab Logo

শুক্রবার, ১০ মে ২০২৪, ২৭ বৈশাখ ১৪৩১, ০১ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

গণতান্ত্রিক সহাবস্থান ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করার কোনো বিকল্প নেই

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ৩০ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

বেশ কয়েক বছর ধরে দেশে উন্নয়নের কথা বলে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে অগ্রাহ্য ও অবজ্ঞা করা হয়েছে। প্রত্যাশা ছিল, ৩০ ডিসেম্বরের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ এক নতুন অভিযাত্রা শুরু করবে। যেখানে গণতন্ত্র, আইনের শাসন, সামাজিক-রাজনৈতিক ন্যায়বিচার এবং অর্থনৈতিক উন্নয়ন হাত ধরাধরি করে চলবে। উন্নয়ন একটি সামগ্রিক ধারণা এবং বাস্তবতা। শুধুমাত্র পরিসংখ্যানের জিডিপি প্রবৃদ্ধি এবং অবকাঠামো নির্মান পরিকল্পনা বাস্তবায়নের উদ্যোগকে উন্নয়ন বলা যায় কি না, এটা এখন অতিব গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। নাগরিকের জীবনের নিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা, রাজনৈতিক স্বাধীনতা, সভা-সমাবেশ, বাক স্বাধীনতা ও ভোটাধিকারের মত বিষয়গুলোর সাথে আধুনিক সভ্যতা, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা, মানবাধিকার, মানবিক মূল্যবোধ ও আইনের শাসনের অবিচ্ছেদ্য সর্ম্পক। এসব অবিচ্ছেদ্য বিষয়গুলোর কোনোটিকে বাদ দিয়ে আধুনিক রাষ্ট্রে উন্নয়নের ধারণা প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব নয়। উন্নয়নের খন্ডিতরূপের বিকাশ সামাজিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়িয়ে তোলে এবং ন্যায়বিচারের সম্ভাবনাকে বাঁধাগ্রস্ত করে। দুর্নীতি, সামাজিক অনাচার, অবক্ষয় ও বৈষম্য রোধে সরকারের যে উদ্যোগ সফল করতে হলে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের আস্থা, সমর্থন না থাকতে হবে। সুষ্ঠু স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচনের মধ্য দিয়েই কেবল সেই সমর্থন ও আস্থার প্রতিফলন ঘটে থাকে। জাতীয় নির্বাচন বিভিন্নভাবে প্রশ্নবিদ্ধ বা ত্রæটিপূর্ণ হলেও ক্ষমতাসীন সরকারের মহৎ লক্ষ্য ও রাজনৈতিক সদিচ্ছা থাকলে ত্রæটিপূর্ণ নির্বাচনের প্রতিবন্ধকতা অতিক্রম করা অসম্ভব নয়। এ ক্ষেত্রে নির্বাচন ও সরকারের গ্রহণযোগ্যতা সম্পর্কে পরাশক্তি ও আন্তর্জাতিক মহলের ঘোষণার চাইতে দেশের রাজনৈতিক দল, জোট ও সংখ্যাগরিষ্ঠ সাধারণ মানুষের আস্থা ও সমর্থনই হচ্ছে প্রধান বিবেচ্য বিষয়। বিএনপিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে প্রধানমন্ত্রী ও ক্ষমতাসীন দলের শীর্ষ নেতারা সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা হিসেবে গণ্য করে বিরোধী জোটের সাথে সংলাপের পর আরেকটি মধ্যবর্তী নির্বাচনের পূর্বাভাস দিলেও ৫ বছরের ক্ষমতার মেয়াদ শেষে একাদশ জাতীয় নির্বাচনের তফশিল ঘোষনার আগ পর্যন্ত তারা সংলাপ বা রাজনৈতিক সমঝোতার আহŸানকে প্রত্যাখ্যান করে এসেছে। একাদশ নির্বাচনের তফশিল ঘোষণার পর অকষ্মাৎ গণভবনের রাজনৈতিক সংলাপে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের কোনো শর্তই মানা হয়নি। কয়েকটি বিষয়ে প্রধানমন্ত্রীর মৌখিক আশ্বাসের উপর ভিত্তি করে বিএনপিসহ জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণের সিদ্ধান্ত নিলেও প্রধানমন্ত্রীর সে সব প্রতিশ্রæতি রক্ষিত হয়নি। উপরন্তু বিএনপি ও ২০ দলীয় জোটের নেতাকর্মীদের উপর দমন পীড়ন, গণগ্রেফতার এবং নির্বাচনী কার্যক্রমে অংশগ্রহণের সুযোগ পুলিশি শক্তিতে কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয়েছে। অবশেষে তিরিশ তারিখের নির্বাচনটি কেমন হয়েছে তা’ নতুন করে আলোচনা না করলেও চলবে। এমন একটি নির্বাচনের সাক্ষি হওয়া দেশের গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ সম্পন্ন মানুষের চেতনাকে আক্রান্ত করেছে। নির্বাচন কমিশন, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও জনপ্রশাসনের ব্যর্থতা, অক্ষমতা বা পক্ষপাতের বিষয়টি বাদ দিলে ব্যাপক জনসমর্থন থাকা সত্তে¡ও অবিন্যস্ত ও কার্যত কান্ডারী বিহিন বিরোধীদলের নেতৃত্ব ও রণকৌশলগত দুর্বলতাও এ ধরণের নির্বাচনের জন্য দায়ী করা যায়। নির্বাচনের কোনো ধাপেই তাঁরা নিজেদের প্রচার-প্রচারণা ও জনগনের ভোটের অধিকার প্রতিষ্ঠায় কোনো সক্ষমতার পরিচয় দিতে পারেনি। নির্বাচনের পর জাতির উদ্দেশ্যে দেয়া ভাষণে বিএনপির ভরাডুবির যে সব কারণ উল্লেখ করেছেন তার পাল্টা যুক্তি থাকলেও নেতৃত্বহীনতা ও রাজনৈতিক লক্ষ্য সম্পর্কে বিরোধীদলের সিদ্ধান্তহীনতা ও অস্বচ্ছতার অভিযোগ অমূলক নয়। তবে এসব দুর্বলতা ও অভিযোগকে পুঁজি করে একটি অস্বচ্ছ, ভ’য়া, জাল-জালিয়াতি ও নজিরবিহীন জবরদস্তিমূলক নির্বাচনের ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা করা যায় না।
এক দশক ধরে পরপর দুই মেয়াদে সরকারের ধারাবাহিকতা থাকা এবং রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা সত্তে¡ও দেশে তেমন কোনো আন্দোলন বা অস্থিতিশীলতা না থাকায় দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড নির্বিঘœ ছিল। দেশের সামগ্রিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও অবকাঠামো উন্নয়নের উপর এর একটি ইতিবাচক প্রভাব পড়েছে। সেই সাথে দেশের গণতন্ত্র এবং বিনিয়োগের ক্ষেত্রে শক্তিশালী বিরোধীদল না থাকা এবং একতরফা নির্বাচনের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়টিও অগ্রাহ্য করা যাবে না। বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানে প্রত্যাশিত গতি ফিরে আসার কোনো শুভ লক্ষণ এখনো দেখা যাচ্ছে না। গত ৫ বছর ধরে দেশের পুঁজি বাজার ও ব্যাংকিং খাতে যে অব্যবস্থাপনা, অস্বচ্ছতা, দুর্নীতি ও লুটপাট ও টাকা পাচারের ঘটনা ঘটেছে তা উত্তরণ ঘটানোর সামাজিক-রাজনৈতিক বাস্তবতা এখনো অনুপস্থিত। তৃতীয়বারের মত সরকার গঠনের পর প্রধানমন্ত্রী যে দুর্নীতি বিরোধী প্রত্যয় ঘোষণা করেছেন তা খুবই ইতিবাচক অগ্রগতি হিসেবে গণ্য হলেও দেশের বিনিয়োগ, কর্মসংস্থান, সামাজিক-রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা, নিরাপত্তা এবং সাধারণ মানুষের উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করার মত বিষয়গুলো শুধুমাত্র প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা বা সদিচ্ছাই যথেষ্ট নয়। দৃশ্যত দেশে সরকার বিরোধী আন্দোলন-সংগ্রাম বা অস্থিতিশীলতা না থাকলেও দেশের সামগ্রিক রাজনৈতিক বাস্তবতা, সরকারের মোরাল ও পলিটিক্যাল লিগ্যাসি এবং গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নিশ্চয়তা এখানে খুবই জরুরী বিষয়। গণতন্ত্র না থাকলেও অর্থনৈতিক ও অবকাঠামোগত উন্নয়ন হয়েছে, বিশ্বে এমন উদাহরণ অনেক আছে। চীন বা সিঙ্গাপুরের সাথে বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতার বিশাল ব্যবধান আছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক সংগ্রামের দীর্ঘ ইতিহাসের সাথে জড়িয়ে আছে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, মানবাধিকার ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার। সে অঙ্গিকার থেকে বিচ্যুত হয়ে শাসক গোষ্ঠির কোনো উন্নয়নের তকমা এ দেশের মানুষ কখনো গ্রহণ করেনি। পাকিস্তান আমলে আইয়ুব খান বা বাংলাদেশ আমলে জেনারেল এরশাদের উন্নয়নের বুলি এ জন্যই রাজনীতির হালে পানি পায়নি। চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্ট থেকে ২০১৮ সালের জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট পর্যন্ত প্রবল প্রতাপশালী শাসক ও সামরিক স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সব রাজনৈতিক ভেদাভেদ ভুলে পুরো জাতি ঐক্যবদ্ধ হওয়ার ঘটনা এ দেশে বার বার ঘটেছে। আন্দোলনের বিজয় ও তিন জোটের রূপরেখার আলোকে দেশে একটি স্বচ্ছ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনব্যবস্থা গড়ে তোলার লক্ষ্যে এড-হক ভিত্তিতে হলেও নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকার ব্যবস্থার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র যে নবযাত্রার সূচনা করেছিল, গণতন্ত্রের সেই নবযাত্রাই দেশকে নতুন অর্থনৈতিক সম্ভাবনার সোপানে তুলে দিয়েছিল। গণতন্ত্রকে আরো অর্থবহ এবং অধিক সংখ্যক মানুষের অংশগ্রহণমূলক করে তুলতেই ১৯৯১ সালে প্রেসিডেন্ট শাসিত ব্যবস্থা থেকে সংসদীয় গণতন্ত্রে উত্তরণে এক ধরনের রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। নির্বাচনকালীন তত্ত¡াবধায়ক সরকারব্যবস্থাকে প্রশ্নবিদ্ধ করার ক্ষেত্রে তৎকালীন বিএনপি সরকারের বিতর্কিত ভ’মিকা শেষ পর্যন্ত গণদাবী ও প্রত্যাশার কাছে তা পরাস্ত হয়েছিল। গণসমর্থনের কারণেই আওয়ামী লীগের দাবীর কাছে নতি স্বীকার করে ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রæয়ারীর একপাক্ষিক নির্বাচনে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতাসীন বিএনপি সরকার মাত্র দুই মাসের মধ্যে নতুন নির্বাচনের ঘোষণা দিতে বাধ্য হয়েছিল। ব্যাপক জনসমর্থন ও জাতীয় ঐক্যের মধ্য দিয়ে প্রতিষ্ঠিত নির্বাচনকালীন তত্ত¦াবধায়ক সরকার ব্যবস্থা অনেকটা একতরফাভাবে বাতিল করার মধ্য দিয়ে বাংলাদেশে বর্তমান রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি করা হয়েছিল। শুধুমাত্র উন্নয়ন ও জিডিপি প্রবৃদ্ধির পরিসংখ্যান দিয়ে সেই রাজনৈতিক সংকটকে পাশ কাটিয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই।
সাংবিধানিকভাবে দেশে একটি বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা থাকলেও গত এক দশকের বেশী সময় ধরে তা অকার্যকর। বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দা এবং পরিবর্তিত বিশ্ববাস্তবতায় বাংলাদেশের ভ’-রাজনৈতিক অবস্থান এবং বিনিয়োগ ও কর্মসংস্থানসহ ব্যাপক অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সত্তে¡ও তার খুব কমই কাজে লেগেছে। সুলভ ও সস্তা শ্রমশক্তি নির্ভর তৈরী পোশাক শিল্প এবং বৈদেশিক কর্মসংস্থান খাত থেকে প্রাপ্ত রেমিটেন্স এবং কৃষিখাতের প্রবৃদ্ধির উপর ভর করে চলা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি নিয়ে আত্মতুষ্টিতে ভোগার সুযোগ নেই। এখনো দেশের প্রায় অর্ধেক যুবশক্তি বেকারত্বের হতাশা নিয়ে দিন কাটাতে বাধ্য হচ্ছে। বিশেষত: শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। সরকারী বিভিন্ন সেক্টরে শুণ্যপদের সংখ্যা সাড়ে তিন লাখের বেশী হলেও মাত্র কয়েক হাজার পদের বিপরীতে ৩৮তম বিসিএস পরীক্ষার প্রিলিমিনারীতে অংশগ্রহণকারীর সংখ্যা ছিল প্রায় সাড়ে ৩ লাখ। এর আগের ৩৭তম বিসিএস প্রিলিমিনারী পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেছিল ২ লাখ ৪৩ হাজার ৫৫৭ জন। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা(আইএলও)র এক পরীসংখ্যান মতে ২০১৫ সালে বাংলাদেশে বেকারের সংখ্যা ছিল প্রায় ৩ কোটি। বর্তমানে এ সংখ্যা প্রায় সাড়ে ৪র কোটিতে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বব্যাংকের হিসাবে বাংলাদেশে বেকারত্বের হার ১৪.২ শতাংশ। আইএলও’র পরিসংখ্যানে বেকারত্ব সমস্যা প্রবণ দেশগুলোর তালিকায় বিশ্বের প্রথম ২০ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থা ১২তম। সামগ্রিকভাবে বেকারত্বের হার পনের ভাগের কাছাকাছি হলেও শিক্ষিত বেকারের হার আরো অনেব বেশী বলেই নানা পরিসংখ্যানে জানা যায়। একদিকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে, অন্যদিকে দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা বাড়ছে, কর্মহীন মানুষের সংখ্যা বাড়চ্ছে তার সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়ছে অতি ধনাঢ্য মানুষের সংখ্যা। এর মানে হচ্ছে সংখ্যা গরিষ্ঠ মানুষের সম্পদ শোষণ করে একশ্রেণীর মানুষ ধনী থেকে আরো ধনী হচ্ছে। সাম্প্রতিক আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে কোটিপতি মানুষের হার বৃদ্ধির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান চীন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বা চীনের মত বৃহদ দেশগুলোরও উপরে। অন্যদিকে অতি সাম্প্রতিক এক আন্তর্জাতিক জরিপে অতি দরিদ্র মানুষ বসবাসকারী দেশের তালিকায় বাংলাদেশ বিশ্বে ৫ম স্থান অধিকার করেছে। এসব তথ্য উপাত্ত দেশে অর্থনৈতিক বৈষম্যের চিত্রই ফুটে উঠেছে। শেয়ার বাজার ও আর্থিক খাতের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে লাখ লাখ ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীর পুঁজি, বিনিয়োগ, আমানত ও জনগনের রাজস্বের টাকা লুণ্ঠন করে কিছু সংখ্যক মানুষের হাজার হাজার কোটি টাকার মালিক হওয়ার চিত্র এটি। দেশের একশ্রেনীর পুলিশ কর্মকর্তা, সরকারের মন্ত্রী-এমপি ও আমলা ও তাদের আত্মীয় পরিজনদের নামে দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলার মধ্য দিয়ে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বৈষম্যমুক্ত সুষম উন্নয়নের সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা হয়েছে। মন্ত্রীসভায় অধিকাংশই নতুন মুখ এবং দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রধানমন্ত্রীর জিরো টলারেন্স নীতি এ কারণেই বিশেষ গুরুত্ব বহন করে। তার আগের মেয়াদে সংগঠিত হাজার হাজার কোটি টাকার দুর্নীতি ও ব্যাংক জালিয়াতির ঘটনাগুলো স্বচ্ছ তদন্তের আলোকে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড়াবে কিনা তার উপর অনেক কিছুই নির্ভর করছে। বিচার বর্হিভুত হত্যাকান্ড, গায়েবি মামলায় বিরোধীদলের হাজার হাজার নেতাকর্মী ধরপাকড়ের সাথেও কোটি কোটি টাকা লেনদেনের সম্পর্ক রয়েছে। রাজনৈতিক কারণে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ধরপাকড় এখন গ্রেফতার বাণিজ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। কোটি টাকার বিনিময়ে গুম-খুন, ক্রসফায়ারের ঘটনাও আাদালতে প্রমানীত হয়েছে। একটি দুর্নীতির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করতে গিয়ে দুর্নীতিগ্রস্ত প্রশাসন আরো বড় ধরনের দুর্নীতি ও অবিচারের সাথে জড়িয়ে পড়ার ঘটনাও ঘটেছে। একজনের দুর্নীতির অপরাধে আরেকজন নিরপরাধ ব্যক্তিকে গ্রেফতার করে জেলে ঢোকানোর ঘটনায় সম্প্রতি দুদক চেয়ারম্যানসহ সরকারের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষতে তলব করেছে হাইকোর্ট। দেশকে দুর্নীতিমুক্ত করতে হলে আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিচার বিভাগ এবং দুর্নীতি দমন কমিশনের মত রাষ্ট্রীয় সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে দুর্নীতিমুক্ত ও আইনানুগ নিরপেক্ষ ভূমিকা নিশ্চিত করার উদ্যোগ নিতে হবে।
দেশের মানুষের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রত্যাশা, নিরাপত্তা ও টেকসই উন্নয়নের মানদন্ড শুধুমাত্র জিডিপি প্রবৃদ্ধির দ্বারা অর্জন করা সম্ভব নয়। উপরন্তু রাজনৈতিক উদ্দেশ্য প্রণোদিত, জনতুষ্টিমূলক ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন কর্মকান্ড দেশ ও জনগনের জন্য বড় ধরনের বিপর্যয় ডেকে আনতে পারে। রাজধানী ঢাকাসহ বিভাগীয় ও জেলা শহরগুলোর অপরিকল্পিত উন্নয়ন এখন কী ধরনের বিপর্যয়ের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের মানুষ তার ভুক্তভোগী। দেশ যখন মধ্য আয়ের দেশে উত্তীর্ণ হতে চলেছে, তখন রাজধানী শহর ঢাকা বিশ্বে বসবাসের অযোগ্য শহরের তালিকায় প্রথম সারিতে জায়গা পাচ্ছে। অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্প, অপরিকল্পিত নগরায়ন ও শিল্পায়নের কারণে দেশের অধিকাংশ নদনদী দূষিত, বেদখল ও অস্তিত্বের সংকটে পড়ে যাচ্ছে। অ্যাকশন এইড বাংলাদেশ নামের একটি সংগঠনের আয়োজনে গত বছর অনুষ্ঠিত এক সম্মেলনে ভারত, বাংলাদেশ, নেপাল ও চীনা বিশেষজ্ঞরা এ অঞ্চলে অপরিকল্পিত নগর পরিকল্পনা, শিল্পায়ন ও অবকাঠামো নির্মানের চরম বিরূপ প্রভাবের বিষয়গুলো তুলে ধরেন। ফারাক্কা বাঁধ নির্মান থেকে শুরু করে বিশেষত নদনদী ও পানিব্যবস্থাপনার উপর অপরিকল্পিত উন্নয়নের বিরূপ প্রভাব পুরো গঙ্গা অববাহিকা অঞ্চলকে মারাত্মক ক্ষতির সম্মুখীন করে তুলেছে। অপরিকল্পিত শিল্পায়ন ও অবকাঠামো উন্নয়ন এখানকার প্রাণ-প্রকৃতি, জীববৈচিত্র্য, কৃষিব্যবস্থা ও খাদ্য নিরাপত্তার উপর বড় হুমকি সৃষ্টি করেছে। সেই সাথে এ অঞ্চলে চরম ধর্মীয় ও রাজনৈতিক গোষ্ঠির উত্থানের মধ্য দিয়ে সামাজিক-রাজনৈতিক সহাবস্থানমূলক গণতান্ত্রিক পরিবেশ নস্যাৎ হতে চলেছে। ভারতে হিন্দুত্ববাদ, গোরক্ষা, নাগরিকত্ব আইন ইত্যাদি রাজনৈতিক কর্মসূচি সেখানে হিন্দু-মুসলমানও বিভিন্ন ভাষাভাষি মানুষের হাজার বছর ধরে শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের ঐতিহ্য ধ্বংস করে দিতে শুরু করেছে। একইভাবে বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিভাজন এবং উন্নয়নের অগ্রযাত্রার দোহাই দিয়ে গণতান্ত্রিক নির্বাচন ও রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নিপীড়ন ও চরম অসহিষ্ণুতার কারণে সামাজিকম নিরাপত্তা ও রাষ্ট্রব্যবস্থার উপর মানুষের আস্থার সংকট সৃষ্টি হচ্ছে। যেনতেন প্রকারে জিডিপি প্রবৃদ্ধি বাড়ানোর চেয়ে আয়বৈষম্য দূর করে সম্পদের সুষম বন্টন নিশ্চিত করা, সুশাসন ও শান্তিপূর্ণ সামাজিক-রাজনৈতিক পরিবেশের মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রের স্থিতিশীল প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা অনেক বেশী গুরুত্বপূর্ণ। অপরিকল্পিত ও নিয়ন্ত্রণহীন উন্নয়নের ভয়াবহ দূষন, সড়কে নিরাপত্তাহীনতা, সমাজে মাদক ও অবৈধ আগ্নেয়াস্ত্রের আগ্রাসন, নারী ও শিশু ধর্ষণ ও অপমৃত্যুর শিকার, রাজনৈতিক কারণে নিরপরাধ মানুষ গ্রেফতার, হয়রানি ও মামলাবাজির সংস্কৃতি বন্ধ করে গণতান্ত্রিক সহাবস্থান ও জননিরাপত্তা নিশ্চিত করাই রাষ্ট্র ও সরকারের মূল দায়িত্ব।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: গণতান্ত্রিক


আরও
আরও পড়ুন