চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
যে ব্যক্তি মহান আল্লাহ তায়ালা, তাঁর প্রেরিত সকল নবী-রাসুল (আ.), ফেরেশতা, আসমানি কিতাব, পরকাল ও তকদিরের ওপর পূর্ণ আন্তরিকতার সাথে বিশ্বাস স্থাপন করে আর ইমান গ্রহণের পর যে
ব্যক্তি ইমান থেকে বিন্দুমাত্র বিচ্যুত হননি তিনিই প্রকৃত মুমিন। কোরআনুল কারীম ও পবিত্র হাদিস শরীফে মুমিনের অসংখ্য গুণাবলি উলেখ করা রয়েছে। তন্মধ্যে যেসব গুণে একজন মুমিনকে সর্বাধিক
শ্রেষ্ঠ করে তুলে তা সংক্ষেপে আলোচনা করলাম।
দ্বীনের ইলম অর্জন করা: মুমিনের অন্যতম গুণ হল, সে দ্বীনের জ্ঞানার্জনে উদগ্রীব থাকে। কেননা, ইলম ছাড়া যথার্থ শক্তিশালী মুমিন হওয়া সম্ভব নয়। আল্লাহ তাআলা বলেন, “বলুন! যারা জানে এবং যারা জানে না; তারা কি সমান হতে পারে?” (সূরা যুমার: ৯) উত্তর হল, কখনও নয়। বরং আল্লাহ তাআলা যাকে ঈমানের পাশাপাশি ইলম দান করেছেন সে নি:সন্দেহে মর্যাদার দিক দিয়ে উন্নত। যেমন আলাহ তাআলা বলেন, “তোমাদের মধ্যে যারা ঈমান এনেছে ও যাদেরকে ইলম দেওয়া হয়েছে আল্লাহ তাদের স্তরে স্তরে মর্যাদায় উন্নীত করবেন।” (সূরা মুজাদিলা: ১১)
সবর বা ধৈর্য ধারণ: মুমিনদের অন্যতম গুণ হলো, তারা হন প্রচন্ড ধৈর্যশীল। প্রকৃতপক্ষে দৃঢ় সংকল্প আর মানসিকভাবে শক্তিশালী লোকেরাই কেবল এ বৈশিষ্ট্যের অধিকারী হয়। যেমন আলাহ তাআলা বলেন: “বিপদাপদে ধৈর্যধারণ কর। নিশ্চয় এটা দৃঢ় সংকল্পের বিষয়।” (সূরা লোকমান: ১৭) পক্ষান্তরে দুর্বলরা হয় ধৈর্যহীন ও অস্থির। তারা বিপদে পড়লেই ধৈর্য হারিয়ে ফেলে। তাই ধৈর্যধারণকারী মুমিনদের প্রতিদান উল্লেখ করে দিয়ে রাসূল (সা.) বলেন: “যে মুমিন মানুষের সাথে উঠা-বসা করে এবং তারা কষ্ট দিলে তাতে ধৈর্য ধারণ করে সে অধিক প্রতিদানের অধিকারী হবে।” (ইবনে মাজাহ)
রাগ নিয়ন্ত্রণ: মুমিন তার রাগ নিয়ন্ত্রণ করে। সে কখনও ব্যক্তি স্বার্থে রাগ করে না। কেউ তার প্রতি অবিচার করলে প্রতিশোধ নেওয়ার ক্ষমতা থাকার পরও সে ক্ষমা করে দেয়। তাই রাগ নিয়ন্ত্রণকারী মুমিন ব্যক্তিকে নবী (সা.) ‘প্রকৃত বীর’ হিসেবে আখ্যায়িত করেছেন। যেমন তিনি বলেন, “প্রকৃত বীর সে ব্যক্তি নয়, যে কাউকে কুস্তিতে হারিয়ে দেয়। বরং সেই প্রকৃত বীর, যে রাগের সময় নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করে।” (বুখারী ও মুসলিম) তবে আল্লাহর বিধান লঙ্ঘিত হলে বা অন্যায়-অপকর্ম দেখে মনে রাগ সৃষ্টি হওয়া অবশ্যই প্রশংসনীয় গুণ। অন্যায়, দুর্নীতি ও পাপাচারের পথ রোধ করতে এ রাগ অত্যন্ত জরুরি। যা রাসূল (সা.)-এর মধ্যে বিদ্যমান ছিল।
উচ্চাকাঙ্খা থাকা: মুমিন হৃদয়ে জান্নাত ও মাওলা পাকের দিদারের উচ্চাকাঙ্খা লালন করে। তার স্বপ্ন হয় অনেক উঁচু। তার অভীষ্ট লক্ষ্য হয় বহু দূর। সে আখিরাতের প্রতিযোগিতায় বিজয় মুকুট পরিধান করতে চায়। তাই সে দুর্দান্ত বেগে ছুটে যায় আল্লাহর ক্ষমা ও জান্নাত লাভের আহবানে। আল্লাহ তাআলা বলেন, “তোমরা তোমাদের পালনকর্তার ক্ষমা এবং জান্নাতের দিকে ছুটে যাও যার সীমানা হচ্ছে আসমান ও জমিন। যা তৈরী করা হয়েছে পরহেজগারদের জন্য।” (সূরা আলে ইমরান: ১৩৩)
দৃঢ় ঈমান ছাড়া এই প্রতিযোগিতায় বিজয়ী হওয়ার সম্ভব নয়। এ জন্য অনেক ত্যাগ শিকার করতে হয়। অনেক পরিশ্রম আর কষ্ট করতে হয়। যেমন শীতের রাতেও ওযু করে ফজর সালাতে যাওয়া, রাত জেগে কুরআন তিলাওয়াত, তাহাজ্জুদের সালাত, নফল রোযা, নিজের অভাব থাকা সত্যেও অসহায় মানুষের সাহায্য, কুপ্রবৃত্তিকে দমন করে দ্বীনের পথে টিকে। উচ্চাকাঙ্খার একটি উদাহরণ হলো,আল্লাহর নিকট সবচেয়ে উঁচু জান্নাতের জন্য দুআ করা। রাসুল (সা.) শিক্ষা দিয়েছেন “তোমরা যখন আল্লাহ নিকট জান্নাত কামনা করবে তখন জান্নাতুল ফিরদউস কামনা করবে। কারণ, তা হলো উৎকৃষ্ট ও উন্নতর জান্নাত। এ জান্নাতের উপর রয়েছে পরম করুণাময় আল্লাহ আরশ। তা হতে জান্নাতের নহর সমূহ প্রবাহিত হয়”। (বুখারী)
উদ্যমী হওয়া: মুমিনের অন্যতম সেরা গুণ হলো, তার অন্তরে প্রচন্ড উদ্যম ও স্পৃহা কাজ করে। সে কখনও অলসতাকে সুযোগ দেয় না। কেননা অলসতাকে আশ্রয় দেয়া মানে শয়তানের নিকট নিজেকে সঁপে দেয়া। যে নিজেকে শয়তানের কাছে সঁপে দেয় তার ধ্বংস অনিবার্য। হজরত আনাস ইবনে মালেক (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূলুলাহ (সা.) এ দুআ করতেন: “হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে আশ্রয় চাই বিষন্নতা ও দুশ্চিন্তা থেকে, অক্ষমতা ও অলসতা থেকে, ভীরুতা ও কার্পণ্যতা থেকে, ঋণের বোঝা ও মানুষের প্রাবল্য (এর শিকার হওয়া) থেকে।” (বুখারী, হাদীস)
নিজের সংশোধনের পাশাপাশি অন্যের সংশোধনের প্রচেষ্টায় থাকা: মুমিন কেবল নিজের সংশোধনকেই যথেষ্ট মনে করে না। বরং আল্লাহ তাকে যে শক্তি ও সামর্থ্য দিয়েছেন তা পরিপূর্ণভাবে ব্যবহার করে অন্যকেও সংশোধনের কাজে ব্রতি হয়। যার প্রমাণ হাদীসে পাওয়া যায়। হজরত আবু সাঈদ খুদরী (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, আমি রাসূলুলাহ (সা.) কে বলতে শুনেছি, “তোমাদের কেউ যখন কোন খারাপ কাজ হতে দেখবে তখন সে যেন তা হাত দ্বারা পরিবর্তন করে দেয়। যদি সে এ সামর্থ্য না রাখে তাহলে যেন মুখ দিয়ে পরিবর্তন করে (মুখে প্রতিবাদ করে)। যদি এ সামর্থ্যও না থাকে তাহলে অন্তরে (ঘৃণা করে এবং পরিবর্তনের পরিকল্পনা আঁটতে থাকে)। আর এটি হচ্ছে ঈমানের দুর্বল স্তর।” (মুসলিম)
মানুষের উপকার করা: মানুষের উপকার বা পরোপকারও মুমিনের শ্রেষ্ঠ গুণ। হাদীসে পাওয়া যায় হজরত আবু হুরায়রা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন: “সে ব্যক্তি শ্রেষ্ঠ যে সবচেয়ে বেশি মানুষের উপকার করে।” (সিলসিলা সহীহাহ, হাসান)।
মজবুত চিন্তাভাবনা ও সুনিপুণ পরিকল্পনা: মজবুত ঈমানদারের একটি গুণ হলো, তার চিন্তা-চেতনা, কথা-বার্তা, বক্তব্য, সিদ্ধান্ত, যুক্তি, বিচার-বিবেচনা ইত্যাদি সব কিছুই হয় মজবুত এবং সূ²। সে ইবাদত-বন্দেগী, কাজ-কর্ম সকল ক্ষেত্রেই হয় সুদৃঢ়, সুনিপুণ এবং যত্মশীল। আল্লাহ তাআলা বলেন: “যখন তুমি দৃঢ়ভাবে ইচ্ছা করবে, তখন আল্লাহর উপর ভরসা করবে। নিশ্চয়ই আল্লাহ ভরসাকারীদের ভালবাসেন।” (সূরা আল ইমরান: ১৫৯) মজবুত কাজকে আলাহ তাআলাও পছন্দ করেন যা হাদীস দ্বারাও প্রমাণিত। উম্মুল মুমিনীন হজরত আয়েশা (রা.) হতে বর্ণিত। রাসূল (সা.) বলেন, “নিশ্চয়ই আল্লাহ এটা পছন্দ করেন যে, তোমাদের কেউ কোন কাজ করলে তা যেন মজবুতভাবে করে।” (সহীহুল জামে, হাসান)
আত্মমর্যাদা ও পরিচ্ছন্ন অন্তর: শক্তিশালী মুমিন হয় আত্মমর্যাদা সম্পন্ন ও পরিচ্ছন্ন অন্তরের অধিকারী। সে অহঙ্কার করে না বরং বিনয় ও নম্রতা তার চরিত্রের ভূষণ। সে অর্থলিপ্সু বা লোভাতুর হয় না। সে হীন চরিত্রের অধিকারী নয়। অর্থের প্রয়োজন হলেও তার আত্মমর্যাদা তাকে অর্থলিপ্সু বানায় না। তাদের গুণাবলি প্রকাশপূর্বক আল্লাহ তাআলা বলেন, “যাদেরকে মনের লিপ্সা থেকে মুক্ত রাখা হয়েছে তারাই সফলকাম।” (সূরা আল হাশর: ৯)
ভুল স্বীকার: সর্বোপরি শক্তিশালী ঈমানদারের অন্যতম একটি গুণ হলো, ভুল হলে সে নির্দ্বিধায় স্বীকার করে। ভুল সংশোধন করে। সে আল্লাহর নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করে না। এটি সম্মানিত ব্যক্তিদের গুণ।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।