চরিত্র মানুষের শ্রেষ্ঠতম অলঙ্কার
সৃষ্টির সেরা জীব আশরাফুল মাখলুকাত- মানবজাতি। এ শ্রেষ্ঠত্ব মানুষ তার চরিত্র দিয়ে অর্জন করে নেয়।
আজকের এই যুগের চিত্র এবং মুসলমানদের অবস্থা পর্যালোচনা করলে সোনালী সেই যুগ আমাদের কাছে আকাশকুসুম মনে হবে। তবে সেই যুগ আর সেই সোনালী যুগের মানুষের ব্যক্তিগত জীবন, সামাজিক জীবন, রাষ্ট্রীয় জীবন, দাম্পত্য জীবন সবই আমাদের জন্য প্রেরণার বাতিঘর।
এই বাতিঘর থেকে কিছু আলো সঞ্চয় করতে পারলেই আমাদের জীবন, আমাদের সমাজ, আমাদের রাষ্ট্র সবই সেই সোনালী যুগের আলোর ধারায় প্রবাহমান হবে।
বিশ্বনবী হযরত মুহাম্মদ (সা.) ছিলেন পরশপাথর তুল্য। তিনি তখনকার জীর্ণ-শীর্ণ, গুনে ধরা সমাজকে সমাজকে আল্লাহ তালার সাজেশন অনুযায়ি সংস্কার করে ক্বোরআনি সমাজ গড়ে তুলেছিলেন ।
বিশ্বের শ্রেষ্ট সমাজ সংস্কারক ছিলেন মহামানব মহানবী হযরত মুহাম্মদ মুস্তফা (সা.)। যার পরশে বর্বর আরব জাতি পেয়েছিল একটি আদর্শ সমাজ ও আদর্শ রাষ্ট্র। আর এ দিকে লক্ষ্য করেই ঐতিহাসিক বেমন্ডলাজ বলেনঃ- “প্রকৃতপক্ষে ইতিহাসে উল্লেখযোগ্য প্রথম সামাজিক বিপ্লবের সূচনাকারি হলেন ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক হযরত মুহাম্মদ (সা.)’’।
অসাম্য দূরিকরণঃ মহানবী (সা.) আভিজাত্যের গৌরব, বংশ মর্যাদার মূলে কুঠারাঘাত ও মানুষে মানুষে ভেদাভেদ দূর করে শুধুমাত্র মানবতার ভিত্তিতে সমাজের বন্ধন সুদৃঢ় করেন। এভাবে তিনি আরব জাতির ছোট-বড়, ধনি-গরিব, সাদা-কালোর পার্থক্য দূর করে একটি সাম্যের সমাজ গড়ে তুলেন।
জোর যার মুলুক তার এর বিলুপ্তিঃ নবী (সা.) এর আগমনের পূর্বে বর্ণ বৈষম্য ও গোত্রিয় বৈষম্য ছিল আরবের একটি জঘন্যতম কালচার । গোত্রে গোত্রে সংঘাত ও কলহ দ্বন্ধ সবসময় লেগেই থাকত। তুচ্ছ কারণে কোন বিবাদ সৃষ্টি হলে দুই-তিন বংশ পর্যন্ত তা ছড়িয়ে পড়ত। মানুষ ব্যক্তিগত স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য যেসব সামাজিক বৈষম্যের পাহাড় গড়ে ছিল, মহানবি (সা.) তা পরিবর্তন করে পরিপূর্ণভাবে বিলুপ্ত করে দেন।
ভ্রাতৃত্ব স্থাপনঃ প্রিয়নবী (সা.) সকলের সাথে ভ্রাতৃত্ববোধের মাধ্যমে একটি মডেল সমাজ গড়ে তুলেন। এবং তিনি “আল্-মুসলিমু আখুল মুসলিম” এর মাধ্যমে মুসলমান পরস্পর ভাই ভাই বলে ঘোষনা দেন। ঐতিহাসিক হিট্রির ভাষায়ঃ ‘আরবের ইতিহাসে রক্তের পরিবর্তে শুধু ধর্মের ভিত্তিতে সমাজ গঠনের জন্য এটিই ছিল প্রথম প্রচেষ্টা’।
কুসংস্কারের অবসানঃ বর্বর আরবজাতি,জাহিলিয়্যাতে ছেয়ে গেছে সারা আরবভূমি,কুসংস্কারে নিমজ্জিত সমস্ত মানবজাতি। ঠিক সেই মুহুর্তে মহানবি (সা.) স্বীয় প্রজ্ঞার মাধ্যমে সমাজ থেকে চিরতরে কুসংস্কারের মূলোৎপাটন করেন। ফলে তাদের মধ্যে একটি আদর্শ সমাজের সৃষ্টি হয়।
মদ-জোয়া নিষিদ্ধ করণঃ মদ-জোয়া ছিল আরবজাতির জন্মগত বৈশিষ্ট্য। হাল যামানায় আমাদের সমাজে যেভাবে চা পান স্বাভাবিক ব্যাপার। আরবের এই জন্মগত বৈশিষ্ট্যকে এক দফায় নয় পর্যায়ক্রমে তিনটি আয়াত নাযিলের মাধ্যমে এটাকে হারাম ঘোষনা করা হয়। ফলে আরবসমাজে শান্তি ও স্বস্তি ফিরে আসে।
সুদ প্রথার মূলোৎপাটনঃ আরবের অশিক্ষিত (জাহিল) লোকেরা সমাজের গরীবের ঘামঝড়ানো অর্থ-সম্পদ, সহায়-সম্বল যখন চোষে খেতে লাগল। ঠিক সেই পরিস্থিতিতে আল্লাহপাক হযরত জিব্রাইল (আ.)’র মারফতে “আহাল্লাল্লাহুল বাইআ ওয়া হাররামার রিবা” অর্থাৎ আল্লাহ ব্যবসাকে হালাল আর সুদকে করেছেন হারাম এই ঐশীবাণির মাধ্যমে মহানবি (সা.) জঘন্যতম কুপ্রথাকে চিরতরে সমাজ থেকে দূরিভূত করেন। এবং এর পরিবর্তে ‘ক্বারজে হাসানা’ দানে সকলকে উৎসাহিত করেন।
নারী জাতির মর্যাদা প্রতিষ্টাঃ আরবের বর্বর লোকেরা নারীজাতিকে পণ্য হিসেবে মনে করত। তাই তারা নারীজাতিকে ভোগ-বিলাসের বস্তুু ছাড়া আর কিছুই ভাবতনা। মনুষত্বহীন জাযাবররা নিজ কণ্যা সন্তানকে জিবন্ত পুঁতে ফেলতেও দ্বিধাবোধ করতনা।
মহানবী (সা.) জীবন্ত প্রোমিত নারীজাতিকে মর্যাদার উচ্চাসনে সমাসীন করে ঘোষনা করেনঃ ‘মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেস্ত’। তিনিই সর্বপ্রথম নারীদেরকে পৈত্যৃক সম্পদের উত্তরাধিকারি বলে ঘোষনা দেন।
দাস প্রথার বিলুপ্তিঃ আরবের জাহেলি যুগের লোকেরা নারী-পুরুষ, শিশু-বৃদ্ধসহ সবাইকে বাজারে পণ্য হিসেবে ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য ডিসপ্লে করে রাখতো। এই জঘন্যতম কুপ্রতাকে চিরতরে বন্ধ করে মহানবী (সা.) ঘোষনা করেনঃ ‘আল্লাহর কাছে দাস মুক্তির চেয়ে উত্তম আমল আর কিছুই হতে পারেনা’।
গোলামের মর্যাদা দানঃ তিনি দাস যায়েদকে পুত্র রুপে গ্রহণ করে এবং বিলাল হাবশীকে ইসলামের সর্বপ্রথম মোয়াজ্জিন নিযুক্ত করে গোলামদের মর্যাদার সুউচ্চ আসনে অধিষ্টিত করেন।
নৈতিকতার উন্নয়নঃ তৎকালিন সমাজে পরিচালিত বিভিন্ন ধরনের নিষ্টুরতাকে আরবের জমিন থেকে বিদায় করে নৈতিকতার শান্তির ধারা চালু করেন।
আল্লাহর জমিনে আল্লাহর আইন প্রতিষ্টাঃ পবিত্র ক্বোরআনের অমিয় বাণি ‘যারা আল্লাহর বিধানানুযায়ী বিচারকার্য সম্পাদন না করবে তারা জালিম। রাসূল (সা.) মহান আল্লাহ প্রদত্ত¡ আইন ও শুধুমাত্র তারই সার্বভৌমত্বের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গড়ে তোলেন। প্রচলিত রাজতন্ত্রের বিপরীতে তিনি ঘোষনা দেন অর্থাৎ‘‘সৃষ্টি যার আইন ও চলবে তার।”
আল-ক্বোরআনকে সংবিধান ঘোষনাঃ মহানবি (সা.) মহাগ্রন্থ আল্-ক্বোরআনকে রাষ্ট্রিয় সংবিধান ঘোষনা দেন। ক্বোরআন-সুন্নাহর ভিত্তিতে রাষ্ট্রের সার্বিক শাষন ও বিচার সংক্রান্ত কার্য পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।
ন্যায় বিচার প্রতিষ্টাঃ ইসলামের চতুর্থ খলিফা হযরত আলি (রা.) বলেন,‘মহানবি (সা.) সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে ন্যায় বিচার ও ইনসাফ প্রতিষ্টা করে সমাজের সব ধরনের অন্যায়-অবিচার, জুলুম-অত্যাচার বিলুপ্ত করে সাম্যের সমাজ গড়েন।
জিম্মিদের অধিকার প্রতিষ্টাঃ ঐতিহাসিক অবনল্ড বলেন, “মহানবি (সা.) জিম্মিদের জান-মাল, ইজ্জত,আব্র“ ইত্যাদি মৌলিক অধিকার সুনিশ্চিত করেন।
শুরা-ই- নিযাম প্রতিষ্টাঃ মহানবি (সা.) ক্বোরআনের বিধান, নিজস্ব বিবেক, এবং সাহাবাদের মতামত ও সুপরামর্শ তথা শুরা-ই-নিযাম মোতাবেক রাষ্ট্রের যাবতিয় কার্য সম্পাদন করতেন।
সনদ প্রণয়নঃ মহানবি (সা.) পবিত্র ক্বোরআনের নীতিমালার উপর ভিত্তি করে মদিনার সকল গোত্রের সমন্বয়ে “মদিনা” নামে একটি সনদ প্রণয়ন করেন যা পৃথিবীর ইতিহাসে সর্বপ্রথম লিখিত শাষনতন্ত্র নামে পরিচিত।
পররাষ্ট্রনীতিঃ ঐতিহাসিক ওয়াট বলেন, ‘মহানবি (সা.) প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সাথে শান্তিতে বসবাস
করার লক্ষ্যে সম্পূর্ণ সৎ ও নিরপেক্ষনীতি গ্রহণ করেন। তার পররাষ্ট্রনীতি ছিল যুদ্ধ নয়, শান্তি ও নিরাপত্তা জোরদার করা।
প্রদেশ বিভক্তিকরণঃ শাষন কার্যের সুবিধার জন্য মহানবি (সা.) আরব দেশকে কয়েকটি প্রদেশে বিভক্ত করে উপযুক্ত প্রাদেশিক শাষনকর্তা ও বিচারক নিযুক্ত করেন।
উপসংহারঃ পরিশেষে বলা যায় যে, মহানবি (সা.) ছিলেন বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ট রাষ্ট্রনায়ক। ইসলামি রাজনীতি ও আদর্শ রাষ্ট্র গঠনের লক্ষ্যে যেসব যুগান্তকারি পদক্ষেপ গ্রহন করেছিলেন তা অনেক বিধর্মিরাও স্বাগত জানিয়েছিল।
আমি মহান প্রভূর দরবারে প্রার্থনা করি তিনি যেন আমাদের দেশের সকল এম.পি-মন্ত্রি, রাষ্ট্রপ্রধান-রাষ্টের নীতিনির্ধারক, জনপ্রতিনিধি, সমাজসেবিদের মহানবি (সা.) এর মহান আদর্শকে আকড়িয়ে ধরার তৌফিক দান করেন। আমিন।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।