পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে সরকারি ঘরনার লোকদের প্রশংসার অন্ত নেই। বিদেশ থেকেও অভিনন্দন আসছে। কেন্দ্রে ভোটারের পরিমাণ, কাস্টিং ভোট, বিজয়ী প্রার্থীর ভোট ও বিজিত প্রার্থীর ভোট, ব্যালট পেপারে ভোট দাতার স্বাক্ষর আছে কি নেই বা ভোটার আদৌ ভোট দিতে পেরেছে কিনা, এসব বিষয়ে কোনো বক্তব্য নেই। বক্তব্য রয়েছে নির্বাচনের সুষ্ঠুতা, গ্রহণযোগ্যতা, নিরপেক্ষতা ইত্যাদি নিয়ে। তবে ভিন্ন মতামত দিয়েছে জাতিসংঘ, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয়ান ইউনিয়নসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংগঠন। তাদের অভিমত নিম্নরূপ:
‘৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের ব্যাপক অনিয়ম তদন্তের দাবি জানিয়েছে যুক্তরাজ্য, ইইউ ও যুক্তরাষ্ট্র। তারা অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য ও স্বচ্ছ সমাধানের আহবান জানিয়েছে। ১০ বছর পর জাতীয় নির্বাচনে বড় বিরোধী দলগুলোর অংশগ্রহণকে স্বাগত জানিয়েছে জাতিসংঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। একই সঙ্গে তারা বাংলাদেশের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষগুলোর কাছে নির্বাচনে অনিয়মের অভিযোগগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত প্রত্যাশা করেছে।’ জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজারিক গত ৩১ ডিসেম্বর রাতে এক বিবৃতিতে সহিংসতার বিরুদ্ধে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেন, ‘লোকজন ও সম্পদের ওপর হামলা এবং সহিংসতা গ্রহণযোগ্য নয়’। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে জাতিসংঘ মহাসচিবের মুখপাত্র বলেন, ‘নির্বাচনে অনিয়মের খবর ও সহিংসতার বিষয়ে জাতিসংঘ অবগত। নির্বাচনী প্রচারণা এবং ভোটের দিনে প্রার্থী ও ভোটারদের হতাহত হওয়ার খবরে আমরা দুঃখিত। বিরোধীদের অংশগ্রহণকে আমরা স্বাগত জানাই। জনগণের মতপ্রকাশ ও সমবেত হওয়ার স্বার্থে আমরা সব পক্ষকে সংযত শান্তিপূর্ণ পরিবেশ করার আহবান জানাই।’ ইইউর মুখপাত্র গত ১ জানুয়ারি সন্ধ্যায় এক বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশের নির্বাচন কমিশন নির্বাচনের প্রাথমিক ফলাফল তাদের অবহিত করেছে। সহিংসতা নির্বাচনের দিনকে নষ্ট করেছে। পুরো প্রক্রিয়ায় লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড (সবার জন্য সমান সুযোগ) নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য প্রতিবন্ধকতা ছিল। এটি নির্বাচনি প্রচারণা ও ভোট প্রভাব ফেলেছে।’ ইইউ মুখপাত্র বলেন, ‘অনিয়মের অভিযোগগুলোর বিষয়ে এখন সংশ্লিষ্ট জাতীয় কর্তৃপক্ষগুলোর সুষ্ঠু তদন্ত নিশ্চিত করা এবং পূর্ণ স্বচ্ছতার সঙ্গে তাদের দায়িত্ব পালন করা উচিত।’ তিনি বলেন, ইইউ বাংলাদেশে গণতন্ত্র, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান ও মৌলিক স্বাধীনতার ক্ষেত্রে অগ্রযাত্রা দেখতে চায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জনগণের স্বার্থে ইইউ তার সহযোগিতা অব্যাহত রাখবে। বাংলাদেশে নির্বাচনের দিন ভোটারদের ভোটদানে বিরত রাখার অনিয়মের অভিযোগে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। বলা হয়েছে, এতে নির্বাচনী প্রক্রিয়ার ওপর যে আস্থা, তা খর্ব হয়েছে। এসব অনিয়মের বিষয়ে সব পক্ষকে নিয়ে গঠনমূলকভাবে সমাধান করতে নির্বাচন কমিশনের প্রতি জোরালো আবহান জানিয়েছে দেশটি। মন্ত্রণালয়ের ডেপুটি মুখপাত্র রবার্ট পালাদিনো ‘বাংলাদেশ ইলেকশন’ শীর্ষক বিবৃতিতে আরো বলেছেন, এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা নির্বাচন পূর্ববর্তী সময়ের হয়রানি, ভীতি প্রদর্শন ও সহিংসতার বিশ্বাসযোগ্য রিপোর্টের বিষয়ে উদ্বেগের সঙ্গে নোট নিচ্ছি। ওইসব কারণে বিরোধী দলীয় বহু প্রার্থী ও তাদের সমর্থকরা মুক্তভাবে সভা, র্যালি ও নির্বাচনী প্রচারণা চালাতে পারেননি। নির্বাচনের দিন কিছু মানুষকে ভোট দিতে দেয়া হয়নি। এটা নির্বাচনী প্রক্রিয়ার প্রতি যে আস্থা আছে তাকে খর্ব করেছে। নির্বাচনের দিনের এ অনিয়মের বিষয়ে আমরা উদ্বিগ্ন। বিবৃতিতে আরো বলা হয়েছে, সব দলকে আমরা সহিংসতা থেকে বিরত থাকার জন্য জোরালোভাবে উৎসাহিত করছি। নির্বাচন কমিশনের প্রতি অনুরোধ করছি অনিয়মের বিষয়ে সমাধান করতে সব পক্ষকে নিয়ে গঠনমূলকভাবে কাজ করতে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এশিয়া ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় বিষয়ক প্রতিমন্ত্রী মার্ক ফিল্ড বাংলাদেশের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তার বিবৃতিতে গভীর উদ্বেগ ফুটে উঠেছে। তিনি বলেছেন, গ্রেফতারসহ সব রকম বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবন্ধকতার বিষয়ে আমি অবহিত। এমন গ্রেফতারের কারণে বিরোধী দলগুলোতে বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। তাদের প্রচারণায় বিরত রাখা হয়েছে। নির্বাচনের দিনে নির্বাচন পরিচালনায় যেসব অনিয়ম হয়েছে, অনেক মানুষকে ভোট দিতে দেয়া হয়নি, এসব অনিয়মের বিষয়ে আমরা অবহিত। মার্ক ফিল্ড তার বিবৃতিতে আরো বলেন, নির্বাচনী প্রচারণার সময়ে যেসব ভীতি প্রদর্শন করা হয়েছে, অন্যায়ভাবে সহিংসতা করা হয়েছে তার জন্য আমি হতাশা প্রকাশ করছি। নির্বাচনের দিনে এত মানুষের মৃত্যুতে আমি গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। যারা প্রাণ হারিয়েছেন তাদের পরিবার ও বন্ধুবান্ধবদের প্রতি আমার সহমর্মিতা। (সূত্র: বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা)।
নির্বাচনের গ্রহণযোগ্যতা এবং ভবিষ্যত নির্বাচন কোন পদ্ধতিতে হবে তা নিয়েও আওয়ামী লীগের নির্বাচনী প্রচার কমিটির কো-চেয়ারম্যান জাতীয় নির্বাচন কমিশনকে পরামর্শ দিয়েছেন। এ মর্মে পত্রিকায় যে খবর প্রকাশিত হয়েছে, তা নিম্নরূপ:
‘প্রধামন্ত্রীর রাজনৈতিক উপদেষ্টা এইচ টি ইমাম বলেছেন, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতো সুন্দর সমন্বয়, শৃঙ্খলা আগে কখনো হয়নি। ভবিষ্যতে যেন এই শৃঙ্খলা ধরে রাখা যায়, সেই চেষ্টা থাকবে। ৬ জানুয়ারি রাজধানীর আগারগাঁওয়ে এইচ টি ইমাম এর নেতৃত্বে নয় সদস্যের একটি দল একাদশ জাতীয় নির্বাচনে সাংবিধানিক দায়িত্ব অত্যন্ত সুন্দরভাবে পালন করায় নির্বাচন কমিশনকে ধন্যবাদ ও অভিনন্দন জানাতে আসেন। এইচ টি ইমাম বলেন, এবারের নির্বাচনের মতো এত বড় আকারের নির্বাচন বাংলাদেশে আর কখনো হয়নি। এত বিশাল সংখ্যক মানুষকে একত্র করে সমন্বয় করা, এবারের মতো এত সুন্দর সমন্বয় আগে কখনো হয়নি। এটি আমাদের সবচেয়ে গর্বের বিষয়। তিনি বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে কমিশনকে সহায়তা করার যে বিষয়গুলো ছিল, প্রত্যেকটি কাজ সরকার করেছে। ছোট থেকে বড়, উঁচু পর্যায় থেকে নিচু পর্যায় পর্যন্ত, সামরিক-বেসামরিক, বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সবাই যে কাজ করেছেন, এগুলো নিয়েই মূলত আমরা আলোচনা করেছি। এই শৃঙ্খলাকে কীভাবে ধরে রাখা যায়, সমন্বয়টাকে কীভাবে ধরে রাখা যায়, ভবিষ্যতে অনেকগুলো নির্বাচন আসছে, সেই নির্বাচনগুলো যাতে সুষ্ঠুভাবে, গ্রহণযোগ্যভাবে করা যায়, সেগুলো নিয়ে আমরা আলোচনা করেছি।’ (সূত্র: জাতীয় পত্রিকা)। সরকার দলীয় প্রচার কমিটির কো-চেয়ারম্যানের বক্তব্যে এটাই প্রকাশিত হয়েছে যে, আগামীতেও এর চেয়ে শান্তিপূর্ণ তথা সুষ্ঠু নির্বাচন হবে। সব কিছুই ঠিক থাকবে, শুধু গায়েবি মামলায় সরকার বিরোধীরা থাকবে হয় জেলখানায় নতুবা বাড়িঘর ছাড়া পলাতক অবস্থায়।
নির্বাচনে ব্যাপক কারচুপি ও কমিশনের বিরুদ্ধে নির্বাচনী ট্রাইবুনালে মামলা করার জন্য বিএনপি মহাসচিব প্রার্থীদের নির্দেশ দিয়েছেন। অর্থাৎ ঘুরে ফিরে বিএনপি বিচার বিভাগের দ্বারস্থ হতে চলছে। রাষ্ট্র যখন কতৃত্ববাদের কবলে পড়ে তখন রাষ্ট্রের সকল অঙ্গ অনেকাংশে কার্যকারিতা হারিয়ে ব্যক্তিনির্ভর হয়ে পড়ে, যেমনটি ঘটেছিল ভেনেজুয়েলায়।
জাতীয় পত্রিকান্তরে প্রকাশ, ভেনেজুয়েলার সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি ক্রিশ্চিয়ান জেরপা দেশ ছেড়ে যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে গেছেন। এক সময়ে দেশটির প্রেসিডেন্ট নিকোলাস মাদুরোর ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত জেরপা একতরফা নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয়বার ক্ষমতায় আসার বিরোধিতা করে তিনি দেশে ছেড়েছেন। বিবিসির এক প্রতিবেদনে জানানো হয়েছে, গত বছর নির্বাচনের মাধ্যমে দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় আরোহন করেন নিকোলাস মাদুরো। কিন্তু বিচারপতি ক্রিশ্চিয়ান জেরপা যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডা রেডিও স্টেশনকে বলেন, ভেনেজুয়েলার সেই নির্বাচন অবাধ ও প্রতিদ্ব›িদ্বতাপূর্ণ ছিল না। ক্রিশ্চিয়ান জেরপা আরও অভিযোগ করেন, নিকোলাস মাদুরো পদ্ধতিগতভাবে সুপ্রিমকোর্টের বিচারপ্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করছেন। অবশ্য জেরপার দেশ ছেড়ে পালানোর ঘটনায় সুপ্রিমকোর্ট বলেছেন, যৌন হয়রানির অভিযোগে দেশ ছেড়ে পালিয়েছেন জেরপা। তাছাড়া ২০১৮ সালে দেশটির নির্বাচন বর্জন করেছিল বিরোধীদলগুলো। সেই নির্বাচনকে জালিয়াতি হিসেবে অভিহিত করে তারা। ২০১৬ সালে কংগ্রেসে প্রেসিডেন্টের ক্ষমতা নিরঙ্কুশ করতে আইনি বিষয়গুলো লেখার ক্ষেত্রে আদালতে মাদুরোর পক্ষে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি ছিলেন জেরপা। জেরপা সে সময় প্রেসিডেন্টের হয়ে কংগ্রেসের ক্ষমতা খর্বের পক্ষে মত দিয়েছিলেন। গত বছরের নির্বাচনে বিজয়ী মাদুরো দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় বসতে যাচ্ছেন। ২০১৮-র মে মাসে অনুষ্ঠিত ওই ভোটের প্রতিবাদে ১৪টি দেশ কারাকাস থেকে তাদের রাষ্ট্রদূতদের ফিরিয়ে এনেছিল। যুক্তরাষ্ট্র দেশটির ওপর দিয়েছিল নতুন অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা। অনুরূপ ঘটনা থেকে বাংলাদেশের বিচার বিভাগ ব্যতিক্রম নয়। বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার শেষ বিদায়ের করুণ চিত্রই প্রমাণ করে বাংলাদেশের সুষ্ঠুতা, নিরপেক্ষতা, সুশাসন বা আইনের শাসন আজ কোথায় আছে। ভবিষ্যৎ কোথায় যাচ্ছে তাও পর্যালোচনার বিষয়।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।