Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

বড় জয়ে বড় দায়, সরকারকে একথা স্মরণ রাখতে হবে

অভিমত

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ১২ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে চোখ-ধাঁধানো, অভাবনীয় মহাবিজয় ও ধারাবাহিকভাবে ক্ষমতা অর্জনের পর সরকার গঠনের পথে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট। অবিশ্বাস্য ফলাফল, বিপরীতে শোচনীয় বিপর্যয়ে বিএনপিসহ বিরোধী দলের নেতাকর্মী-সমর্থককে নিদারুণ বিষাদগ্রস্ত করে তুলেছে, যা মোটেও অস্বাভাবিক নয়। গত সংসদের মতো নবগঠিত একাদশ জাতীয় সংসদও একজোটের সংসদ হলো। সংসদীয় ব্যবস্থায় দেশ পরিচালনায় বিরোধী দলের ভূমিকা রাখার যে সুযোগ, সেটি এবারও থাকলো না। বাংলাদেশের মানুষ বরাবরই গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল ও নিবেদিত। এজন্যই নির্বাচন আসলে দেশে এক উৎসবমূখর পরিবেশ তৈরি হয়। মানুষের এই গণতন্ত্র প্রীতি বারাবরই কলঙ্কিত ও আঘাতপ্রাপ্ত হয়েছে, অতি ক্ষমতালোভিদের কু-অভিলাশে।
নবনির্বাচিত সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণের পর নতুন মন্ত্রিসভাও শপথ নিয়ে দায়িত্বভার গ্রহণ করেছে। বড় বিজয়কে ধারণের পর সামনের চ্যালেঞ্জটা আরো কঠিন। কারণ, বড় জয় বড় দায়। ক্ষমতাসীনরা বলেও থাকেন, বাংলাদেশকে উন্নয়নের রাস্তায় তুলে এনেছে এই সরকার। এই উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রার রাস্তায় থাকতে হলে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থানে থাকতে হবে। নিজে অন্যায় করবো না, অন্যায়ের প্রশ্রয় ছাড়াও কাউকে অন্যায় করতে দেবো না; এই মন্ত্র, অঙ্গীকার ও শপথের কথা সর্বান্তকরণে দৃঢ়ভাবে ধারণ করতে হবে। চলমান তৃতীয় মেয়াদে আগের চেয়ে উন্নতপন্থায় ও প্রশংসনীয়ভাবে রাষ্ট্র চালাতে পারলে দেশ ও জাতির কল্যাণ নিশ্চিত হবে। অন্যথায়, ক্ষতিগ্রস্ত হবে সবাই। নিয়ন্ত্রিত নির্বাচনের পরিণতি যেন নিয়ন্ত্রিত গণতন্ত্র না হয়। অকল্পনীয়, জয়ে ক্ষমতাসীনরা সাধারণ মানুষকে এখন বেশি পরোয়া করবে, নাকি নেতাকর্মী-সমর্থক শান্তিপ্রিয় সর্বসাধারণের ওপর আরো বেপরোয়া হয়ে উঠবে, এটাই দেখার বিষয়।
সংসদে সরকারের প্রতিপক্ষের কোনো অবস্থান না থাকলে ক্ষমতাসীনদের আচার-আচরণে দাম্ভিকতার প্রকাশ ঘটতে পারে। দলীয় পদধারী, সংসদ সদস্য ও মন্ত্রীকে ঘিরে বরাবরই কিছু ফেরেববাজ, ধান্দাবাজ আর দুর্নীতিপরায়ণদের বলয়, পরিমন্ডল ও জগত সৃষ্টি হয়। এরা দল আর সরকারের সুনামের তেরোটা বাজায়; এমপি, মন্ত্রী ও দলের জন্য এটা বড় চ্যালেঞ্জ। এসব ক্ষেত্রে পরগাছা এবং দুর্নীতিগ্রস্ত দলীয় লোকদের প্রথম থেকেই যদি বিরত রাখা যায়, তাহলে জনমনে স্বস্তি ফিরবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠা যেকোনো সরকারের জন্যই একটা বড় চ্যালেঞ্জ। সে সুশাসন শুধু কথায় ও কাগজে নয়; হতে হবে গ্রাম, অজপাড়াগাঁও থেকে সংসদ তথা আইনসভা ও সর্ব প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ে।
মন্ত্রিসভায় এবার নতুন ও নবীনদের স্থান হয়েছে। এটা ভালো দিক। নবীনরা সৎ, যোগ্য, কর্মনিষ্ঠ, পরিশ্রমী এবং আধুনিক চিন্তা-চেতনা সহজে ধারণ করতে পারবে। নবীনদের হতে হবে, বিনয়ী, বিনম্র, সুশীল, অমায়িক এবং নিজের ওপর অর্পিত দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন। বড় বিজয় ও নবীনদের রাষ্ট্র পরিচালনার দায়িত্ব যেন বড় বিপদের কারণ না হয়। সাফল্য ও উন্নয়নের ধারা অব্যাহত রাখার পাশপাশি নবীনরা যদি দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান গ্রহণ করতে পারে, তবে দেশের উন্নয়ন ও সুশাসন নিশ্চিত হবে। সুশাসন প্রতিষ্ঠায় নবীনদের চ্যালেঞ্জ ও মানুষের প্রত্যাশা পূরণে অঙ্গীকারাবদ্ধ হতে হবে। পরপর তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসা এই সরকারের প্রতি দেশবাসীর প্রত্যাশা অনেক বেশি।
বর্তমান সরকারের মেগা উন্নয়ন কাজগুলো সম্পন্ন করার পাশাপাশি নির্বাচনী ইশতেহারে বর্ণিত সব দফা পর্যায়ক্রমে পূর্ণ করে জনগণের আস্থাভাজন হতে হবে। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম গত কয়েক বছরে দফায় দফায় লাগামহীনভাবে বাড়ার কারণে সাধারণ মানুষের মধ্যে নার্ভাস অবস্থা বিরাজ করছে। বেশীরভাগ মানুষের আয় বাড়েনি, কিন্তু ব্যয় বেড়েছে। নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে আনার জন্য মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা এবং ভ্রাম্যমাণ আদালতের সংখ্যা বাড়ানো ও কার্যকর করতে হবে। যারা কাজ করে না, তাদের কোনো ভুল হয় না। যারা কাজ করে, তাদের ভুল হয়, ত্রুটি হয়, দোষ হয়, সমালোচনা হয়। গত টার্মে সরকার যেসব কাজে ব্যর্থ হয়েছে কিংবা অসমাপ্ত কাজ যা রয়েছে তা শোধরানো এবং সমাপ্ত করা জরুরি। মনে রাখতে হবে, ক্ষমতা চিরস্থায়ী নয়। ক্ষমতায় আরোহণ করে প্রতিশ্রুতি যেন ভঙ্গ না হয়। সরকারকে সদা সতর্ক থাকতে হবে, যাতে অতি উৎসাহী কর্মীর দ্বারা এ নির্বাচনী বিজয় কলুষিত না হয়। সাধারণত দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে অতিআত্মবিশ্বাস বা বেপরোয়া মনোভাব থেকে কর্মী-সমর্থকরা ধরাকে সরাজ্ঞান করতে শুরু করে।
শপথ নেওয়ার পর দলের সংসদ সদস্যদের উদ্দেশে ভাষণ দিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘ক্ষমতাকে সম্পদ অর্জনের হাতিয়ার বানাবেন না। ক্ষমতা ব্যক্তিসম্পদ নয়।’ এ কথাগুলো দলীয় কর্মী-সমর্থক, নেতা, এমপি, মন্ত্রী সকলের জন্যই প্রযোজ্য। বিশেষত এবার যারা প্রথমবারের মতো সংসদ সদস্য হয়েছে, তাদের বেলায় সবচেয়ে বেশি প্রযোজ্য। কারণ তাদের সামনে রাজনীতির অনেক দীর্ঘপথ অপেক্ষা করছে। যখন কোনো দল প্রায় একচেটিয়া জয় পেয়ে যায় এবং সংসদে থাকে না কোনো শক্তিশালী বিরোধী দল, আর রাজপথে থাকে না বিরোধী দলের জোরালো আন্দোলন, তখন দৃশ্যত সব ঠিকঠাক মনে হলেও ভেতরে ভেতরে দায়িত্ববোধের ঘাটতি বেড়ে যায়। এক্ষেত্রে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়া আর অনিয়ম বৃদ্ধি পাবার সম্ভাবনা থাকে ব্যাপকভাবে। এজন্য সরকারের উচিত হবে প্রত্যেক জনপ্রতিনিধির ওপর তীক্ষ্নভাবে নজর রাখা। কারো বিরুদ্ধে কোনো অনিয়মের অভিযোগ উঠলে খতিয়ে ব্যবস্থা নেয়া। দুর্নীতিমুক্ত গণতান্ত্রিক ও পরিকল্পিত দেশ গড়ার লক্ষ্যে সরকারকে চোখ, কান খোলো রেখে এগিয়ে যেতে হবে। এবারের সরকার তার দায়বদ্ধতা অনুযায়ী কাজ করে দেশকে সমৃদ্ধির পথে এগিয়ে নেবে এবং ইশতেহার অনুযায়ী প্রতিটি কাজ বিশেষভাবে সম্পন্ন করবে, এটাই সর্বসাধারণের প্রত্যাশ্যা।
গণমাধ্যমকে সংবাদ সংগ্রহ, মতপ্রকাশ ও সরকারের দোষ-ত্রুটি নিয়ে কথা বলার স্বাধীনতা দিতে হবে। দুর্নীতি দমনে অবশ্যই আগামী পাঁচ বছর জিরো টলারেন্স প্রত্যেক নাগরিকের চাওয়া। দেশে দুর্নীতি বেড়েছে, একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই। ঘুষ না দিলে ফাইল নড়ে না। এসব বন্ধ করতে হবে। ব্যর্থতা থেকেই শিখতে হয়, ব্যর্থতার জায়গাগুলো চিহ্নিত করে যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে। জনগণের অসুবিধার কথাগুলো সবারই জানা। কাজেই সাময়িক নয়, সমস্যাগুলো সমাধানে স্থায়ী ব্যবস্থা নিতে হবে।
শিক্ষিত বেকার যুবকদের তালিকা সংগ্রহ করে কর্মসংস্থানের সুযোগ করে দেওয়া হলে সরকারের জনপ্রিয়তা আর কেউ কোনো দিনই ম্লান করতে পারবে না। ১ কোটি ৫০ লাখ তরুণের কর্মসংস্থান গঠনের দিকে বিশেষ দৃষ্টি প্রয়োজন। একটি তরুণের জীবনও যেন নষ্ট না হয়। দেশে কোটি তরুণ বেকারত্বের অভিশাপ নিয়ে জাতির বোঝা হয়ে আছে। তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে হবে। দেশ থেকে বেকারত্ব, বিশেষ করে তরুণদের বেকারত্ব দূর করার সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ সরকারকেই করতে হবে। অদক্ষ তরুণদের দক্ষ করে স্বনির্ভর বাংলাদেশ গড়ার জন্য আরো বেগবান হয়ে প্রশাসনকে কাজ করতে হবে। সরকারের চলমান উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি করে বেকার সমস্যার সমাধান করতে হবে। একটা দেশের মেরুদন্ড হলো যুবসমাজ। যুবসমাজের যোগ্যতা ও দক্ষতার ওপর দেশের ভবিষ্যৎ নির্ভর করে। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ করতে হবে। মাদক ও নেশামুক্ত সমাজ গড়তে হবে। মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলোর অগ্রাধিকার দিতে হবে। অফিস, আদালত, কল, কারখানাসহ বিভিন্ন সেক্টরে পর্যাপ্ত জনবল নিয়োগ করলে কর্মসংস্থান সৃষ্টির পাশাপাশি জাতীয় অর্থনীতি সমৃদ্ধিশালী হবে। নিয়োগের ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও স্বজনপ্রীতিমুক্ত হতে হবে। বাংলাদেশের মতো প্রতিটি উন্নয়নশীল দেশের জন্য একবিংশ শতাব্দীর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো কর্মসংস্থান সৃষ্টি।
দেশের সচেতন ও গণতন্ত্রকামী নাগরিকরদের প্রত্যাশা, বিজয়ী দল ও জোট এবং নতুন সরকারসহ ক্ষমতাসীন মহলের সবাই দেশের বাস্তবতা উপলব্ধি করে, জনগণের আকাক্সক্ষা পূরণে নিষ্ঠা ও যোগ্যতার প্রমাণ রাখবে। সরকার যদি গণতন্ত্রের প্রতি আস্থাশীল হয় এবং দেশকে স্বাভাবিকভাবে পরিচালিত করতে চায় তবে তাদের রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের সহযোগিতা কামনা করতে হবে। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর নেতা ও সমর্থকদের সঙ্গে প্রতিহিংসা ও প্রতিশোধের রাজনৈতিক চর্চা থেকে বিরত থাকতে হবে। রাজনৈতিক স্বার্থে আইনের অপব্যবহার আইনের শাসনের পরিপন্থী। এখন দেশের যে অবস্থা তা একদলীয় সরকারের মতো এবং এতে দলীয়করণ সর্বগ্রাসী হয়ে উঠতে পারে। ফলে ক্ষমতার ভারসাম্য বিনষ্ট হবে এবং গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোর জবাবদিহিতা ক্রমেই ক্ষয়প্রাপ্ত হবে। বিরোধী দলের উপর দমন-পীড়ন করে একটা ভারসাম্যমূলক সমাজব্যবস্থা গড়া ও সুন্দর সম্মিলিত দেশ উপহার দেওয়া সম্ভব নয়। জোর-জবরদস্তি নয়, একটি মানবিক ও সুশাসনভিত্তিক সমাজব্যবস্থা কায়েম এখন জনদাবী। প্রশাসনিক ও রাজনৈতিকভাবে কোনো ব্যক্তি যেন হয়রানির শিকার না হয়, সেদিকে লক্ষ রাখতে হবে। সরকারকে সহনশীলতার পরিচয় দিতে হবে।
সরকার তার প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপির প্রতি আগে থেকে যে হামলা-মামলার পথ অনুসরণ করে এসেছে, তা থেকে সরে আসতে হবে। সরকারকে মনে রাখা উচিত, নতুন সংসদে কার্যত কোনো বিরোধী দল নেই। এ ছাড়াও সরকারের ভুলত্রুটির সমালোচনার জন্য গত সংসদে কোনো প্রতিপক্ষ ছিল না। আইনসভায় বিরোধী পক্ষ না থাকলে জবাবদিহিতার যে সঙ্কট সৃষ্টি হয়, তার অন্যতম পরিণতি হচ্ছে দুর্নীতির প্রসার। নতুন সরকারকে এসব ব্যাপারে সতর্ক থেকে নির্বাচনী প্রতিশ্রুতিমাফিক একটি পূর্ণাঙ্গ গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র গড়ে তোলার লক্ষ্যে সার্বিক প্রয়াস চালিয়ে যেতে হবে। এ নির্বাচনই শেষ নয় এবং এ সরকারই শেষ সরকার নয়। এটা ভুলে আত্মপ্রসাদে ডুবে থাকলে চলবে না।
লেখক: গণমাধ্যমকর্মী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন