পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
জাতীয় সংসদের ১১তম নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়ে গেলো। দেশি-বিদেশি রাজনৈতিক জ্যোতিষীদের মতামত তো বটেই, সরকারের পূর্বাভাষ ডিঙ্গিয়ে মোট ২৯৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামীলীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট ২৮৮টি আসনে জয় লাভ করেছে। এর মধ্যে শরীকদল জাতীয় পার্টির আসন সংখ্যা ২২। বিএনপির ৫, গণফোরামের ২ আসন নিয়ে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন ঐক্যফ্রন্টের আসন সংখ্যা ৭ এ দাঁড়িয়েছে। সকল প্রকার ভবিষ্যতবাণীকে ছাপিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট এখন একাকার। ফলে যারা আওয়ামী লীগ শাসনামলের সমালোচনা করতো এখন তারা প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ২০১৪ সালে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছাড়া বিএনপি নির্বাচনে যাবে না বলে নির্বাচন বয়কট করেছিল। পক্ষান্তরে ২০১৮ সালে বলেছে, যে কোনো প্রতিকূল অবস্থায় নির্বাচনের মাঠ থেকে সরে দাঁড়াবে না। দুটো কথাই বিএনপি রেখেছে। সাংগঠনিক বিষয়সহ দলীয় নেতাকর্মীর সঠিক মূল্যায়নের প্রশ্নে বিএনপি’র অনেক সিদ্ধান্ত নিয়ে কথা রয়েছে বা দলটির শাসনামল সম্পর্কে অনেক কথা থাকতে পারে, কিন্তু জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নে ২০১৪ ও ২০১৮ সালে জাতির নিকট দেয়া প্রতিশ্রুতির প্রশ্নে বিএনপি বিচ্যুতি ঘটায়নি।
নির্বাচনের প্রাক্কালে বিএনপি তথা ঐক্যফ্রন্ট ৭ দফা দাবি নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর সাথে বৈঠক করেছে যার একটিও প্রধানমন্ত্রী গ্রহণ করেননি। প্রধানমন্ত্রীর সাথে আলোচনার মুখ্য বিষয় হওয়া উচিৎ ছিল গায়েবি মামলার সমাধান। সংলাপের টেবিলে প্রশ্নটি উপস্থাপিত হলে বিএনপি মহাসচিব নিকট প্রধানমন্ত্রী কৌশলে মামলার তালিকা চেয়েছিলেন। বিএনপি মহাসচিবের কৌশল অবলম্বন করে বলা উচিৎ ছিল যে, তালিকা তো সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরেই আছে। কারণ, সরকারের দায়িত্বশীলদের সম্মতি বা নির্দেশ ছাড়া পুলিশ একক সিদ্ধান্তে থানায় থানায় বিএনপি’র বিরুদ্ধে একই ধরনের একই ধারায় অসংখ্য মামলা দেবে, তা বিশ্বাস করা যায় না। কৌশলকে কৌশল দিয়ে আটকাতে হয়। গায়েবি মামলার প্রশ্নে বিরোধীদল কৌশল ব্যবহার করতে ব্যর্থ হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মীকে জেলে, লক্ষ লক্ষ নেতাকর্মী গায়েবি মামলার আসামী ও বাড়িছাড়া অবস্থায় ঐক্যফ্রন্ট আশায় ছিল যে, জনগণ মাঠে নামবে এবং কাক্সিক্ষত ফসল ঘরে আসবে। প্রধান নির্বাচন কমিশনার খুবই জোর গলায় বলেছিলেন যে, তফসিল ঘোষণার পর কোনো মামলা হবে না বা গ্রেফতার হবে না। তারপরও প্রতিদিনই মামলা হয়েছে এবং গ্রেফতার হয়েছে। কিন্তু নির্বাচনের পূর্ব মুহূর্তে প্রধান নির্বাচন কমিশনার গায়েবি মামলাকে জায়েজ করার জন্য বলেছিলেন যে, ফৌজদারী মামলা ছাড়া কাউকে গ্রেফতার না করার জন্য পুলিশকে কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সিইসির নির্দেশকে পাকাপোক্ত করেন পুলিশ প্রধান এই কথা বলে যে, ফৌজদারী মামলার আসামীদের গ্রেফতার করা হবে। ফলে কথাটি এই দাঁড়ালো যে, গায়েবি মামলার আসামীদের গ্রেফতার করা যাবে। উল্লেখ্য, বিএনপি নেতাকর্মী-সমর্থকদের ইতোমধ্যে গায়েবি মামলার আসামী করা হয়েছে এবং যাদের আসামী করা হয় নাই নির্বাচনের পূর্বে সাদা পোশাক ও পোশাকী পুলিশ বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি করেছে এবং আওয়ামী ক্যাডারগণ পুলিশী ছত্রছায়ায় বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি ও ভাংচুর করেছে। বিএনপি’র প্রার্থীদের নিরাপত্তার জন্য নির্বাচন কমিশন কার্যতঃ কোনো ভ‚মিকা গ্রহণ করে নাই। বিএনপি’র ভোটার দেখলে তাদের ভোট দিতে দেয় নাই, ব্যালট পেপার রেখে নিজেরাই নৌকার মার্কায় সিল মেরেছে। পূর্ব রাত্রেই ব্যালটে সিল মারার অভিযোগ নির্বাচন কমিশনে করা হয়েছিল। বিএনপি প্রার্থীদের উপর সরকারি দলের হামলার বিষয়ে নির্বাচন কমিশন কোনো প্রতিকার করে নাই, বরং উৎসাহিত করেছে ‘বিচ্ছিন্ন’ ঘটনা বলে। ‘বিচ্ছিন্ন’ শব্দটি নির্বাচন কমিশনের সৃষ্টি শুধুমাত্র সরকারি দল ও সরকারি বাহিনীর তাণ্ডবকে হালাল করার জন্য। এ জন্যই কবির ভাষায় বলতে হয় যে, ‘অন্ধ যারা আজ চোখে বেশি দেখে তারা’। অর্থাৎ ১১তম জাতীয় নির্বাচন নাকি সুষ্ঠু হয়েছে!
পশ্চিমবঙ্গে কেউ কারো প্রতি অভিশাপ দিলে বলা হয় যে, ‘তোর ঘরে মামলা ঢুকুক’। ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে বিএনপি’র ঘরে সফলতার সাথে সরকার মামলা ঢুকিয়ে দিয়েছে এবং হাজার হাজার নেতাকর্মীকে আসামী করে কারাগার ভর্তি করেছে। মামলা গায়েবি অর্থাৎ সাজানো জেনেও ম্যাজিস্ট্রেট ও জেলা জজ জামিন না দিয়ে গায়েবি মামলাকে জায়েজ করেছে। এমতাবস্থায় পুলিশ প্রধান ও প্রধান নির্বাচন কমিশনের বক্তব্য যথাক্রমে ফৌজদারী মামলার আসামীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে (পুলিশ প্রধান) এবং ফৌজদারী মোকদ্দমার আসামী ব্যতীত কাউকে গ্রেফতার না করার জন্য কঠোর নির্দেশ দেয়া হয়েছে (সিইসি) প্রভৃতি বক্তব্যে একদিকে গায়েবি মোকদ্দমাকে জায়েজ করা হয়েছে, অন্যদিকে বিএনপি সমর্থকদের গ্রেফতার করার জন্য অফিসিয়ালী উৎসাহিত ও নির্দেশ করা হয়েছে।
বিএনপি মুক্তিযোদ্ধাদের দল হয়েও সরকারি প্রচারযন্ত্রের বদৌলতে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী দল হিসেবে অভিহিত হয়েছে। অথচ বিপরীতে বিএনপির লোকদের মালিকানাধীন মিডিয়া এ মর্মে কার্যতঃ কোনো ভুমিকা রাখে নাই। বিএনপি ঘরনার বুদ্ধিজীবিরাও বিষয়টি গুরুত্ব দেন নাই, মুষ্টিমেয় কয়েকজন ছাড়া। কোলকাতা মনস্ক বুদ্ধিজীবীরা শহীদ জিয়ার নামে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কিত নানা কলঙ্ক দিয়েছে, অথচ জিয়াই যুদ্ধের ঘোষণা দিয়ে বলেছিলেন, আমি মেজর জিয়া বলছি এবং We Revolt. চুড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত লড়াই চালিয়ে যাওয়ার আহবান দেশবাসী জিয়ার কণ্ঠ থেকেই শুনেছিল। অথচ সরকারি প্রচার-প্রচারণায় কথিত বুদ্ধিজীবিদের মতে, জিয়ার প্রতিষ্ঠিত দল বিএনপি হয়ে উঠলো স্বাধীনতা বিরোধী, এটাই ভাগ্যের নির্মম পরিহাস। জোট করে বিএনপি ভোট ও আন্দোলন-সংগ্রামে কতটুকু সহযোগিতা পেয়েছে তাও ভেবে দেখতে হবে।
৪৭ বছর হলো দেশ স্বাধীন হয়েছে। এখন যারা জামায়াত-শিবির করে তাদের অধিকাংশের বয়স ৪৭ এর নিচে বলে আমার ধারণা। ইতোমধ্যেও স্বাধীনতা যুদ্ধে জামায়াতের ভ‚মিকা নিয়ে জাতির নিকট তাদের অবস্থান ব্যাখ্যা করতে জামায়াত সক্ষম হয় নাই। তাদের অনেক নেতা ফাঁসিতে ঝুলেছেন, অনেকে পলাতক রয়েছেন, অনেকেই জেলে আছেন, অনেকেই হয়েছেন দেশান্তরী। কষ্ট তারা কম করছেন না। কিন্তু জাতির সামনে তাদের অবস্থান গ্রহণযোগ্য করার উপায় খুঁজে বের না করতে পারলে তাদের সাংগঠনিক ও আর্থিক অবস্থা যতই সবল থাকুক না কেন সামগ্রিকভাবে ভোটের রাজ্যে বা সার্বিক গ্রহণযোগ্যতার প্রশ্নে তারা রাজনৈতিক মাঠে উত্তরণ হতে পারবেন কি?
বাংলাদেশে বাম ও ইসলামী দলগুলি ঐক্যমতে আসতে পারে না। বাম দলগুলি যদিও কদাচিৎ কোনো কোনো প্রশ্নে ঐক্যমতে আসে কিন্তু ইসলামী দলগুলি ঐক্যের প্রশ্নে একেবারেই বিমুখ। ইসলামী দলগুলি যদি একক নেতৃত্বে ঐক্যবদ্ধ হতে পারতো তবে বড় বড় রাজনৈতিক দলের কাছে তাদের ধর্না দিতে হতো না। ইসলামী দলগুলোর ঐক্যহীনতার কারণে বড় বড় রাজনৈতিক দল কর্তৃত্ব দেখানোর সুযোগ পাচ্ছে।
স্মরণ রাখা দরকার যে, বাংলাদেশে রাজনীতিতে তিনটি বিষয় জনগণের সমর্থন পাবে না। যথা: (১) মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার বিরোধিতা, (২) সাম্প্রদায়িকতা ও (৩) ধর্ম বিরোধী বা ধর্মহীনতা। কারণ, এ দেশের মানুষ ধর্ম ভীরু। একইসঙ্গে তারা সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মহীনতা, ধর্মের বিরোধিতা এবং নাস্তিকতাকে খুবই অপছন্দ করে। ফলে এ তিনটি বিষয় মাথায় রেখেই বিএনপিকে এগুতে হবে। তারপরও ভারতীয় পত্রিকায় জামায়াতে ইসলামের প্রতিনিধিকে ধানের শীষের প্রার্থী করার বিষয়ে ফ্রন্ট প্রধান ড. কামাল হোসেনের বক্তব্য নির্বাচনের প্রাক্কালে বুমেরাং হয়েছে কি না তাও বিএনপি’কে খতিয়ে দেখতে হবে। বাংলাদেশে ৯২% মানুষ মুসলমান। তারা সাম্প্রদায়িকতাকে প্রশ্রয় দেয় না। ফলে বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িকতা তথাকথিত বুদ্ধিজীবিদের মুখে আছে, বাস্তবে নাই। যেমনটি রয়েছে পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত ও মিয়ানমারে। পার্শ্ববর্তী এ দুটি রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতা প্রকটভাবে দেখা যায়। আশ্চর্যের বিষয় যে, কাগজে-কলমে ভারত একটি অসাম্প্রদায়িক রাষ্ট্র(!) অথচ ভারত সমর্থিত বুদ্ধিজীবিদের নিকট থেকে শিখতে হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা কী ও কত প্রকার?
বিএনপি ও ঐক্যফ্রন্টের ধারণা ছিল যে, পক্ষপাতিত্বমূলক নির্বাচন কমিশন ও মারমুখী পুলিশ বাহিনীকে উপেক্ষা করেই জনগণ ভোট কেন্দ্রে উপস্থিত হয়ে সরকারি বাহিনীর সাথে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়াবে। কিন্তু কাক্সিক্ষত অবস্থা অর্থাৎ গণবিষ্ফোরণ কেন সৃষ্টি হলো না তাও খুঁজতে বিএনপি’কে আরো গভীরে যেতে হবে। এ কারণটি খুঁজে বের করতে না পারলে বিএনপিকে হাঁটতে হবে অনেক দূর পর্যন্ত, সে হাঁটা নোনা পানির বালু চরে নয় বরং কাটা বিছানো পথে।
প্রধান নির্বাচন কমিশনার বলেছেন যে, ৮০% ভোটার ভোটে অংশ গ্রহণ করেছে বিধায় নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে, অন্যদিকে অন্যতম কমিশনার মাহবুব তালুকদার বলেছেন যে, নিজের বিবেককে জিজ্ঞাসা করুন নির্বাচন কতটুকু সুষ্ঠু হয়েছে? বিবেক কি আছে, না বাংলাদেশ থেকে হারিয়ে গেছে তা এখন প্রধান ইস্যু হিসেবে দেখা দিয়েছে। প্রধান নির্বাচন কমিশনারের বিবেক কতটুকু কাজ করছে তা তিনি নিজেই বলতে পারবেন কি না সন্দেহ। তবে তিনি যদি ছদ্মবেশে গ্রামেগঞ্জে হেঁটে হেঁটে গণমানুষের সাথে আলাপ করেন তবে ভোটের পূর্ব রাত্রসহ ভোটের দিনে পুলিশ, কমিশন, সরকারি দলের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে জানতে পারবেন। কল্পনাতিতভাবে পরাজয়সহ শত প্রতিকূলতার মাঝেও ২০১৮ সালের নির্বাচনে দুটি বিষয়ে বিএনপি লাভবান হয়েছে যথা: (১) প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধা যারা এক সময় সরকারি ঘরনার নেতৃত্ব দিয়েছে তারা এখন গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য ধানের শীষের পতাকা তলে ঐক্যবদ্ধ হয়েছে এবং (২) দলীয় সরকারের অধীনে ২০১৪ সালের নির্বাচন বর্জন সঠিক সিদ্ধান্ত ছিল।
যে কোনো উপায়ে জয়ী হতে পারলে কোনো দোষ নাই। কিন্তু রাজনীতিতে হেরে যাওয়া বা পরাজয় বরণ করাটাই ভুল। নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন থেকে সরে সহায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন সরকারের দাবি বা রূপরেখা প্রদানের ভিন্ন ধারার বক্তব্য বিএনপি’র অন্যতম ভুল ছিল। সবকিছু পর্যালোচনান্তে এটাই সত্য যে, কোনো দলীয় সরকারের অধীনে ঔপনিবেশিক শিক্ষায় দীক্ষিত পুলিশ/প্রশাসনের মাধ্যমে একটি সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ, গ্রহণযোগ্য নির্বাচন সম্ভব নয়। মিথ্যা যেখানে সত্যের সম্পূরক সেখানে ক্ষমতা রদবদলের প্রশ্নে পুলিশ/প্রশাসনের নিকট থেকে এর চেয়ে বেশি কিছু আশা করা কি যুক্তিসংগত?
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।