পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রথম থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত এমনকি স্নাতক (পাস), স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকত্তোর পর্যায়ের অধিকাংশ বিষয়ের শিক্ষার্থীরা গাইড, নোটের ওপর নির্ভরশীল। শিক্ষার্থীদের এ নির্ভরশীলতা শিক্ষার গুণগত মানকে ক্রমাবনতির দিকে নিয়ে যাচ্ছে। আমি মনে করি, পাঠ্যবই ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নের মধ্যে অসামঞ্জ্যতাই এর কারণ।
যেমন: (১) পঞ্চম শ্রেণিতে প্রাথমিক সমাপনী পরীক্ষায় ইংরেজি বিষয়ের প্রশ্নপত্রে ৫-৮নং পর্যন্ত প্রশ্ন পাঠ্যবই বহির্ভুত Passage-কে কেন্দ্র করে তৈরি এবং ৯-১৩ নং পর্যন্ত প্রশ্নসমূহ নমুনা হিসেবে পাঠ্যবই-এর দু’এক জায়গায় দেয়া থাকলেও একেবারে অপর্যাপ্ত। (২) ৭ম শ্রেণির গণিত পাঠ্যবইয়ের ৩২ পৃষ্ঠায় ১২ নং প্রশ্নে উল্লেখ করা হলো, ‘একটি ঘড়ি ৬২৫ টাকায় বিক্রয় করলে ১০% ক্ষতি হয়। কত টাকায় বিক্রয় করলে ১০% লাভ হবে?’ অথচ পরীক্ষায় গণিত প্রশ্নপত্রে দেয়া থাকে, ‘একটি দ্রব্য ৭৭০ টাকায় বিক্রয় করায় ১২% ক্ষতি হয়। প্রশ্ন- (ক) দ্রব্যটির ক্রয়মূল্য কত? (খ) দ্রব্যটি ৮৫০ টাকায় বিক্রয় করলে শতকরা কত লাভ বা ক্ষতি হবে? (গ) দ্রব্যটি কত টাকায় বিক্রয় করলে ১৫% লাভ হবে?’ অর্থাৎ, পাঠ্যবইয়ের প্রশ্নে গতানুগতিক ধারায় একটি উত্তর, আর পরীক্ষার প্রশ্নে সৃজনশীল ধারায় ৩টি উত্তর বের করতে হয়। পুরো প্রশ্নপত্র এ ধরনের সৃজনশীল প্রশ্নে তৈরি। তাই একজন শিক্ষার্থীকে ইংরেজি ও গণিত বিষয়ে নিজেকে পরীক্ষার প্রশ্নপত্রের আলোকে তৈরি করতে হলে পাঠ্যবই নয়, একাধিক প্রকাশনীর গাইড বই কিনতে হবে, যেখানে প্রণীত প্রশ্নপত্রের আলোকে ৩০-৪০টি মডেল প্রশ্ন দেয়া থাকে। এ চিত্র চতুর্থ থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত সকল বিষয়ের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য। উল্লেখ্য, যে যৎসামান্য দু’ একটি সৃজনশীল প্রশ্ন পাঠ্যবইয়ে দেয়া থাকে, তা পরীক্ষার প্রশ্নপত্রে সরবরাহ করা আইনত নিষিদ্ধ। কাজেই একজন শিক্ষককে একটি বা দুইটি প্রকাশনীর গাইড বইকে পাঠ্য করে শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করতে হয়। অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিভিন্ন প্রকাশনী থেকে Donation নিয়ে অথবা সংশ্লিষ্ট বিষয়ের শিক্ষকরা অনৈতিকভাবে উপঢৌকন নিয়ে নিম্নমানের গাইড বই পাঠ্য করে থাকেন। ফলে NCTB কর্তৃক অনুমোদিত পাঠ্যবই বাক্সবন্দি হয়ে পড়ে থাকে। এমনকি শিক্ষকদেরকেও নিজেদের দক্ষতা বৃদ্ধি এবং পরীক্ষার প্রশ্নপত্র তৈরি করার জন্য চার-পাঁচটি প্রকাশনীর গাইড বই সংগ্রহ করতে হয়- এখন শিক্ষা যেন গাইডময়, জ্ঞানময় নয়।
উপরন্তু, সংখ্যাতিরিক্ত পাঠ্যবইয়ের পাশাপশি বিশাল সিলেবাস শিক্ষার্থীদের ওপর চাপের সৃষ্টি করছে। যেমন: ষষ্ঠ- অষ্টম শেণি পর্যন্ত প্রতি শেণিতে ১৩/১৪টি বিষয়, পঞ্চম শ্রেণির বাংলা বইয়ে গদ্য ও পদ্যের সংখ্যা ২৪টি এবং একাদশ- দ্বাদশ শ্রেণির ইংরেজি পাঠ্যবইয়ে ১৫টি Unit-এর মধ্যে ৫৭টি Lesson ইত্যাদি। এছাড়া, বিভিন্ন উপলক্ষে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সরকারি ছুটি থাকে মোট ৮৫ দিন, সাপ্তাহিক ছুটি ৫২ দিন, অন্তঃপরীক্ষা ৩০ দিন, পাবলিক পরীক্ষা ৩০ দিন, অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন অনুষ্ঠান ১০ দিন ও সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে অংশগ্রহণ ৫ দিন সর্বমোট ২১২ দিন অর্থাৎ ৫৮% দিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান থেকে বিরত থাকতে হয়। সুতরাং, বছরের ৪২% দিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদান করে ১৩/১৪টি পাঠ্যবইয়ের বিশাল সিলেবাস সম্পন্ন করা কখনও সম্ভব নয়। অতএব, শিক্ষার্থীদের সিলেবাস স¤পন্ন করতে হলে গাইড বইয়ের পাশাপাশি প্রাইভেট বা কোচিংয়ে দৌড়াতে হয়।
তাছাড়া পাঠ্যবইয়ে ছাপার ভুল এবং গাণিতিক সমস্যায় ভুল প্রশ্ন ও ভুল উত্তর প্রায়ই দেখা যায়। এতে শিক্ষার্থীরা confidence হারিয়ে ফেলে। আবার একই topic একই শ্রেণির দু’ তিন পাঠ্যবইয়ে পুনরাবৃত্তি ঘটে। যেমন: ৭ম শ্রেণিতে জলবায়ু পরিবর্তন ‘ইংরেজি ১ম পত্র’, ‘বাংলাদেশ ও বিশ্বপরিচয়’ ও ‘সাধারণ বিজ্ঞান’ পাঠ্যবইয়ে পরিলক্ষিত হয়; যা NCTB এবং প্রকাশনার দায়িত্বহীনতার পরিচয় ছাড়া কিছুই নয়। একইভাবে, একাদশ-দ্বাদশ শ্রেণিতে রসায়ন বিষয়ের প্রত্যেক পত্রে অনুমোদিত বইয়ের সংখ্যা ১৪টিরও বেশি এবং প্রত্যেক প্রকাশনার বইয়ের লেখকগণ ১টি নির্দিষ্ট topic-এর ভিন্ন ভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করায় একজন শিক্ষার্থীকে ১৪টি বই-ই অধ্যয়ন করতে হচ্ছে, যা দুরূহ ব্যাপার। এছাড়া, HSC পরীক্ষা যেহেতু প্রতিবছর ১ এপ্রিল মাসে শুরু হয়, তাই একজন HSC পরীক্ষার্থীর এ দুই বছরে অধ্যয়নকাল: ৩৬৫+২৭৩=৬৩৮ দিন। অর্থাৎ, তাদের ১৩টি বিষয়ে অধ্যয়নের গড় সময় ৬৩৮/১৩=৪৯.০৭ দিন। সুতরাং, পাঠ্যবই ও প্রশ্নপত্র প্রণয়নের মধ্যে অসামঞ্জ্যতা, সংখ্যাতিরিক্ত পাঠ্যবইয়ের পাশাপাশি বিশাল সিলেবাস অথচ বছরের ৪২% দিন শ্রেণিকক্ষে পাঠদানে সম্ভাবনা ইত্যাদির কারণেই গাইড, নোট, প্রাইভেট ও কোচিংয়ের রমরমা ব্যবসা চলছে। অতএব, শুধু আইন করে এসব বন্ধ করা সম্ভব নয়- বাস্তব পদক্ষেপ অবশ্যম্ভাবী। এ লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিকট আমার কিছু সুপারিশ:
১. প্রশ্নপত্র প্রণয়ণে পাঠ্যবইয়ের অধ্যায়ভিত্তিক অনুশীলনী থেকে সরাসরি ৬০%, পাঠ (Lesson) থেকে ৩০% এবং পাঠ্যবইয়ের সামঞ্জস্য রেখে বর্হিভূত হিসেবে ১০% ব্যবহার করা যেতে পারে ।
২. সৃজনশীল প্রশ্নের ক্ষেত্রে বিষয়ভিত্তিক প্রশ্নব্যাংক তৈরি করে সরবরাহ করা যেতে পারে।
৩. পাঠ্যপুস্তকে অধ্যায়/Unit সংখ্যা কমিয়ে শ্রেণি কক্ষে পাঠদান পদ্ধতি প্রাণবন্ত করা অপরিহার্য ।
৪. পাঠ্যবইয়ের সহযোগী হিসেবে NCTB কর্তৃক অনুমোদিত একটি বা দুইটি পাঠ সহায়িকা শিক্ষক ও শিক্ষার্থীর জন্য সরবরাহ করা যেতে পারে।
৫. প্রকাশকদের কথা বিবেচনা করে বিষয় বা শ্রেণিভিত্তিক পাঠ্যবই ও পাঠসহায়িকা প্রকাশনার জন্য একটি বা দুইটি প্রকাশনা সংস্থাকে দায়িত্ব দেয়া যেতে পারে।
৬. সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের গুরুত্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে অন্ততঃ পক্ষে প্রাক-প্রাথমিক থেকে দ্বাদশ শ্রেণি পর্যন্ত প্রাইভেট শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ করা যেতে পারে। এতে ধনী-গরীব, আমলা, এমপি, মন্ত্রি সকল শ্রেণির লোকদের সন্তান একই সিস্টেমে একই টেবিলে বসে শিক্ষা লাভ করার সুযোগ পাবে এবং দেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপট উন্নয়ন ঘটবে। গাইড, নোট, প্রাইভেট ও কোচিং বাণিজ্য নিয়ন্ত্রণে সরকারের পক্ষে সহজতর হবে।
৭. জাতীয় দিবস ছাড়া সরকারি বিভিন্ন কর্মসূচিতে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানকে জড়ানো উচিত নয় বলে আমি মনে করি। এমনকি জাতীয় পর্যায়ে সকল সহশিক্ষা কার্যক্রম বছরের শুরুতেই সম্পন্ন করা যেতে পারে।।
৮. নৈতিক গুণসম্পন্ন ও মেধাবীদেরকে ‘শিক্ষকতা পেশায়’ আকৃষ্ট করতে এবং এ পেশাকে মর্যাদাবান করার লক্ষ্যে সকল স্তরের শিক্ষকদের জন্য স্বতন্ত্র ও উন্নততর স্কেল প্রদানসহ বেসরকারি স্কুল, কলেজ ও মাদরাসা জাতীয়করণ করা যেতে পারে। এর ফলে শিক্ষকদের ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি থাকবে না।
লেখক: উপাধ্যক্ষ, চান্দিনা রেদোয়ান আহ্মেদ বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।