Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন

মোহাম্মদ আবদুল গফুর | প্রকাশের সময় : ৩ জানুয়ারি, ২০১৯, ১২:০৩ এএম

একাদশ সংসদ নির্বাচন গত ৩০ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত হয়ে গেছে। সারা দেশে আওয়ামী লীগের অস্বাভাবিক বিজয় নিয়ে এখন চলছে তুমূল আলোচনা। নিজের ভোট কেন্দ্রে ভোট প্রদানের পর প্রধান মন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বলেছিলেন, নৌকার জয় হবেই, তাঁর সেই আগাম আশাবাদ সাফল্যমন্ডিত হওয়ায় এখন সকলে বলতে পারেন প্রধান মন্ত্রীর দৃঢ় আশাবাদের ভিত্তি অত্যন্ত বাস্তববাদী ছিল। কি সেই নির্মম বাস্তবতা যা আগে থেকেই বুঝতে পারার ফলে প্রধান মন্ত্রী নিজের ব্যক্তিগত ভোট প্রদানের পর পরই জোর দিয়ে বলতে পেরেছিলেন নৌকার জয় হবেই?
নির্বাচনে আশাতীত অস্বাভাবিক জয় লাভের পর প্রধান মন্ত্রী যে বলেছেন, বিএনপি নিজের দোষে হেরেছে, সেখানে তিনি তাঁর এই বক্তব্যের সমর্থনে আর কি বলেছেন? তিনি বিএনপির অস্বাভাবিক পরাজয়ের মূলে যেসব কারণ দেখিয়েছেন, যেমন বিএনপির নেতৃত্ব না থাকা, প্রধানমন্ত্রী কে হবে তা স্পষ্ট না করা, ড. কামালের মত নির্বাচন অনভিজ্ঞ লোকের দ্বারা পরিচালিত হওয়া, উইনেবল ক্যান্ডিডেটদের মনোনয়ন না দেয়া ইত্যাদি কারণ দেখিয়েছেন।
কিন্তুু বাস্তবে কি দেখেছে জনগণ? জনগণ দেখেছে বেগম খালেদা জিয়াকে নির্বাচন চলাকালীন সময়ে আটক করে বিএনপিকে নেতৃত্বশূণ্য করে রাখা হয়েছে। শুধু তাই নয়, নির্বাচনের বেশ আগের থেকেই বিএনপিকে মফস্বলসহ সর্বত্র গ্রেপ্তার মারফৎ নেতৃত্বশূণ্য করে রেখেছে আওয়ামী লীগ সরকার। এর ফল যা হবার তাই হয়েছে। শুধু রাজধানী ঢাকায় নয়, মফস্বলেও বিএনপি ছিল নেতৃত্বশূণ্য। কোথাও বিএনপির নেতৃত্ব না থাকায় বিএনপি নির্বাচনকালে তার যথার্থ ভূমিকা পালন করতে পারেনি।
প্রধানমন্ত্রী আওয়ামী লীগের অস্বাভাবিক বিজয়ের পেছনে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়নমূলক কাজের যে খতিয়ান দিয়েছেন, এটা বাস্তব ক্ষেত্রে কোন কাজে আসেনি। যার ফলে নির্বাচন কালীন সময়ে জনমত ছিল আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে। নির্বাচনে জনমতের সঠিক প্রতিফলন ঘটলে বিএনপি প্রার্থীরা বিপুল ব্যবধানে বিজয়ী হতেন। এটাই ছিল নির্বাচন সম্পর্কে জনগণের স্বাভাবিক প্রত্যাশা। কিন্তু নির্বাচনে জনগণের স্বাভাবিক প্রত্যাশার প্রতিফলন ঘটেনি ভোট গ্রহণ কর্তৃপক্ষের সুপরিকল্পিত ভূমিকার কারণে। ভোটারদের পদে পদে ভোট কেন্দ্রে যেতে বাধা দেয়া হয়। সরকার বিরোধী নেতাকর্মীদের তো গ্রেপ্তার প্রভৃতির মাধ্যমে আগের থেকেই ভীতিজনক পরিস্থিতির মধ্যে রাখা হয়। এ পরিস্থিতি অব্যাহত থাকে ভোট দানের নির্ধারিত সময় পার হয়ে যাওয়া পর্যন্ত। তাছাড়া অতি উৎসাহী সরকার-বিরোধী নেতাকর্মীদের কোন কোন ক্ষেত্রে মারধরের ব্যবস্থাও করা হয়।
ফলে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের সকল রকমের অবৈধ ও অনৈতিক ভূমিকাই পুরো মাত্রায় পালন করে সরকার পক্ষীয় নেতা কর্মীরা। এর ফল দাঁড়িয়েছে এই যে, শুধু সরকার বিরোধী রাজনৈতিক নেতাকর্মীরা নয়, সরকার পক্ষীয় নেতাকর্মীরা তাদের যে নোংরা ভূমিকা পালন করতে হয়েছে দলের বিজয় নিশ্চিত করতে, তাতে তারাও খুশী হতে পারেনি। কারণ স্বাভাবিকভাবে প্রতিদ্ব›িদ্বতামূলক নির্বাচনে তাদের বিজয়ের আনন্দ লাভ যেরকম হতো, তার কিছুই লাভ করতে পারেননি তৃণমূল পর্যায়ের সরকার দলীয় নেতাকর্মীরা। দলের উচ্চ পর্যায়ের নেতাকর্মীদের মত তারা শহরে বাস করেন না। বাস করেন গ্রামে। বরং বলতে হয়, তারা বাস করেন গ্রামে পাশাপাশি সারা বছর বাস করার ফলে তাদের মধ্যকার সৌহার্দ্য রাজনৈতিক বিশ্বাসের পার্থক্যের কারণে কখনও নষ্ট হয় না। এবার সেই সৌহার্দ্য বজায় রাখা তাদের জন্য কষ্টকর হয়ে উঠবে অস্বাভাবিকভাবে নোংরা ভূমিকা পালনে বাধ্য হওয়ার কারণে।
সুতরাং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যে বলেছেন বিএনপি নিজের দোষে হেরেছে একথা আদৌ সঠিক নয়। বিএনপিকে সুপরিকল্পিত নোংরা পন্থার মাধ্যমে এক অকল্পনীয় অস্বাভাবিক নির্বাচনী প্রহসনের মাধ্যমে হারানো হয়েছে। ঐক্যফ্রণ্টের নেতা ড. কামাল হোসেন যে নির্বাচনী প্রহসনের ফলাফল প্রত্যাখান করে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন দাবী করেছেন, তার সমর্থনে চ্যালেঞ্জ দিয়ে বলা যায়, সেরকম নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগ কিছুতেই বিজয় লাভ করতে পারত না। এতদিনে বুঝা গেল আওয়ামী লীগ দলীয় সরকারের অধীনে এত অধীর হয়েছিল কেন এবং কেনই বা তারা নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিবর্তে দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন অনুষ্ঠানের লক্ষ্যে সংবিধান সংশোধনের জন্য এত অস্থির হয়ে উঠেছিল কেন?
আসলে আওয়ামী লীগ যে আদৌ গণতন্ত্রে বিশ্বাস করে না, তার অসংখ্য প্রমাণ রয়েছে। স্বাধীন বাংলাদেশে প্রথম সরকারের আমলে আওয়ামী লীগই সর্বপ্রথম গণতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে সকল রাজনৈতিক দল নিষিদ্ধ ঘোষণা করে একটি মাত্র সরকারী দল রেখে দেশে এক দলীয় বাকশালী শাসন ব্যবস্থা কায়েম করে। এরপর কিছু দু:খজনক ঘটনার মাধ্যমে দেশে বহুদলীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা পুন:প্রতিষ্ঠিত হলেও এক পর্যায়ে একটি নির্বাচিত সরকারকে সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত করে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা দখল করে বসেন তদানীন্তন সেনা প্রধান জেনারেল হুসেইন মোহাম্মদ এরশাদ। তখন সারা দুনিয়াকে অবাক করে দিয়ে সেই সামরিক ক্যুর প্রতি সমর্থন জানিয়ে বসেন দেশের প্রাচীনতম রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগের নেত্রী শেখ হাসিনা। এই অকল্পনীয় পদক্ষেপের পক্ষে একমাত্র সম্ভাব্য কারণ ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনৈতিক ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ ছিল সামরিক ক্যুর মাধ্যমে উৎখাত হওয়া ঐ নির্বাচিত সরকারের নেতৃত্বে ছিল নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতির ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিপক্ষ বিএনপি
এরপর শুরু হয় জেনারেল এরশাদের একটানা দীর্ঘ দিনের স্বৈর শাসনের পালা। পাশাপাশি চলে বিএনপি ও অন্যান্য রাজনৈতিক দলের এরশাদ বিরোধী আন্দোলন। আওয়ামী লীগ প্রথম দিকে অনেক দিন এসব আন্দোলন থেকে দূরে থাকে। ফলে বিএনপি চেয়ারপাসন রাজনীতি ক্ষেত্রে অপেক্ষাকৃত নবাগতা বেগম খালেদা জিয়া এরশাদ বিরোধী আন্দোলনে একটানা নেতৃত্ব দিয়ে আপোষহীন নেত্রী হিসাবে অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তার প্রমাণ মেলে পরবর্তী নির্বাচনে।
এদিকে এরশাদ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হয়ে উঠলে এক পর্যায়ে আওয়ামী লীগ সে আন্দোলনে যোগ দেয়। আরো পরে জেনারেল এরশাদের শাসনের অবসান ঘটিয়ে দেশে পুনরায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনতে একটি নতুন নির্বাচন দেওয়ার প্রশ্নে একমত হন আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনাবিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়া। উভয়ে এ প্রশ্নেও একমত হন যে নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ করতে নির্বাচনকালীন সরকারে নেতৃত্ব দেবেন বাংলাদেশ সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি শাহাবুদ্দিন আহমদ।
যেমনটা আশা করা গিয়েছিল নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়। নির্বাচন চলাকালে আওয়ামী লীগ নেত্রী শেখ হাসিনা সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপচারিতাকালে এক পর্যায়ে বলেন, আমি সকল জেলার খবর নিয়েছি। নির্বাচন অত্যন্ত সুষ্ঠু হয়েছে। আপনারা লক্ষ্য রাখবেন ভোটে হেরে গিয়ে এর মধ্যে কেউ যেন আবার কারচুপি আবিষ্কার না করে। ভোট গণনা শেষে যখন জানা গেল, আওয়ামী লীগ নয়, নির্বাচনে বিজয়ী হয়েছে বিএনপি, শেখ হাসিনা অবলীলাক্রমে বলে ফেললেন, নির্বাচনে সু² কারচুপি হয়েছে। কিন্তু সংশ্লিষ্ট কেউ তাঁর এই অবান্তর কথায় গুরুত্ব না দেয়ায় স্বাভাবিক নিয়ম মোতাবেক বিএনপি চেয়ারপার্সন বেগম খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে নতুন সরকার গঠিত হয় এবং শেখ হাসিনা হন সংসদে বিরোধী দলীয় নেত্রী।
বেগম খালেদা জিয়ার প্রধান মন্ত্রীত্বের মেয়াদ শেষ হলে প্রধানত বিরোধী দলীয় নেত্রী শেখ হাসিনার দাবীর মুখেই দেশের সকল জাতীয় নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে এই মর্মে ব্যবস্থা রেখে সংবিধান সংশোধন করা হয়। বাংলাদেশের বিশেষ রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে এই ব্যবস্থা অত্যন্ত বাস্তব প্রমাণিত হয়। এই ব্যবস্থাধীনে বেশ কয়েকটি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় এবং তাতে পর পর পালাক্রমে বেগম খালেদা জিয়া ও শেখ হাসিনা প্রধান মন্ত্রী নির্বাচিত হয়ে দেশ পরিচালনার সুযোগ লাভ করেন।
দু:খের বিষয়, কিছু রাজনীতিকের মাত্রাতিরিক্ত ক্ষমতা ক্ষুধা এই সুন্দর ব্যবস্থাটিকেও পচিয়ে ফেলে এবং শেখ হাসিনার প্রধান মন্ত্রীত্বের আমলে ‘নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সকল জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ এর পরিবর্তে ‘নির্বাচিত দলীয় সরকারের অধীনে নতুন নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে’ এই বিধানসহ সংবিধান নতুন করে সংশোধন করা হয়।
নির্বাচন ব্যবস্থায় দলীয় সরকার যে ক্ষতিকর প্রভাব রাখে তার সর্বশেষ দৃশ্য দেখার দুর্ভাগ্য হয়েছে আমাদের গত ৩০ ডিসেম্বর। গত ৩০ ডিসেম্বর যা হয়েছে তাকে এক কথায় বলা যায় নির্বাচনী তামাশা। নির্বাচনের আগে দেশে যে পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়েছিল তাতে জনগণ আশা করেছিল দেশে একটা পরিবর্তন আসবে যা দেশকে গণতান্ত্রিক পথে আর এক ধাপ এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে। কিন্তু নির্বাচনের যে ফলাফল জানা গেছে, তাতে জনগণের সকল আশা ধূলিসাৎ হয়ে গেছে। দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপির পক্ষ থেকে যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হোসেন ২২১ আসনে অনিয়মের চিত্র তুলে ধরে ইসিকে (নির্বাচন কমিশনে) সঠিক ভাবেই বলেছেন, নির্বাচনের নামে এই ধরনের তামাশার কোনো প্রয়োজন ছিল না।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন