পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দিন বদলের অপরিমেয় প্রত্যাশায় সূচনা হচ্ছে আরো একটি খ্রিস্টীয় নববর্ষ। উৎসব আর আয়োজনের মধ্য দিয়ে মানুষ অভিবাদন জানাবে গ্রেগরিয়ান ক্যালেন্ডারের নতুন বছর ২০১৯ সালকে। পৃথিবীর বয়স বাড়ল আরও এক বছর। নতুন আশায় বুক বেঁধে আরো একটি নতুন বছরে পা দিলো গোটা বিশ্ব। কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেল একটি বছর। নতুন স্বপ্ন বুনে অভিলাষী মন উড়ছে, স্বপ্ন ডানা মেলেছে আকাশ ছোঁয়ার দীপ্ত অঙ্গীকারে। তমসা কেটে পূর্ব দিগন্তে আবহমান সূর্য আবার শুরু করেছে চিরন্তনী নতুন যাত্রা। পৃথিবীর তাবৎ মানুষ নতুন বছরের নতুন সূর্যের জন্যই যেন প্রতীক্ষায় থাকে। সোনালি স্বপ্নের হাতছানি নিয়ে উদিত হলো নতুন বছরের নতুন সুর্য। পৌষের কুয়াশার চাদর ভেদ করে উদ্ভাসিত হলো সোনালি আলোর সকাল। বর্ষ পরিক্রমায় নতুন খ্রিস্টাব্দ আমাদের নতুন ভাবনায়, নতুন সাধনায় অজেয়-অমিত শক্তিতে সামনে এগিয়ে যাবার পথের দিক নির্দেশনা দেয়। তাই নববর্ষের সূর্যরাঙা এ দিন একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যৎ নির্মাণের জন্য দৃপ্ত পায়ে এগিয়ে যাবার দিন। অতীতের সমস্ত ভুল-ভ্রান্তি থেকে শিক্ষা নিয়েই আমরা এগিয়ে যেতে পারি আলোকিত ভবিষ্যতের দিকে। আত্মবিশ্লেষণ, নির্মোহ সমালোচনার মাধ্যমে স্বচ্ছতা, দায়বদ্ধতা ও ঐকান্তিকতায় বাস্তবতাকে স্বীকার করে অতীতের ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে সংশোধন করে ভবিষ্যৎ চলার পথকে প্রশস্ত করার এবং শপথ নেয়ার দিন এটি। এ দিনে মানুষ নতুন নতুন আশা-আকাক্সক্ষা আর চাওয়া-পাওয়ার প্রত্যাশা নিয়ে পথ চলা শুরু করবে-নতুন উদ্যমে। জীবনের খেরোখাতায় সৃষ্টি করবে আনন্দ-বেদনার কাব্যে পাওয়া-না পাওয়ার স্মৃতি-বিস্মৃতির হিসাব-নিকাশের নতুন ধারাপাত। ধূসর ক্যানভাসে আঁকবে জীবনের প্রাপ্তি-প্রত্যাশার চিন্ময় চিত্রপট। নতুন সূর্যের হীরকদ্যুতিতে জেগে উঠবে নব নব প্রাণ।
বিশ্বজুড়ে নতুন বছরকে স্বাগত জানাতে শুরু হয় আতশবাজি, আলোকসজ্জা, নাচ-গান, খাবারের উৎসব আর আনন্দ। বহুমাত্রিক ও বর্ণিল আলোড়ন তোলা নতুনের আবাহনে জেগে ওঠে প্রাণমন। নববর্ষ উৎসবকে কেন্দ্র করে বিশ্বব্যাপী আতশবাজির ঝলমলে রঙে রাঙা হয়ে ওঠে রাতের আকাশ। কয়েক দশক আগেও নববর্ষকে এমন জাঁকজমকভাবে উদযাপন করা হত না। উদযাপনের সংস্কৃতি শুরু হয়েছে সাম্প্রতিক সময়ে। খ্রিস্টীয় নববর্ষকে উৎসব হিসাবে পালন শুরু করার পিছনে রয়েছে এক দীর্ঘ ইতিহাস। বৈশ্বিক পটভূমিতে খ্রিস্টীয় নববর্ষের গুরুত্ব এবং তাৎপর্য অপরসীম।
সর্বপ্রথম নববর্ষ উদযাপন শুরু হয় খ্রিস্টের জন্মেরও দুই হাজার বছর আগে। সে সময় ২০ মার্চ তারিখের দিকে নববর্ষ উদযাপন করা হত। পরবর্তীতে কালের পরিক্রমায় বিভিন্ন দিন-পঞ্জিকাকে অনুসরণ করে এসেছে আজকের খ্রিস্টীয় পঞ্জিকা। আদি রোমান দিন-পঞ্জিকা অনুযায়ী, প্রতি বছর ১ মার্চ নববর্ষ উদযাপন করা হতো। ওই সময় বছর গণনা করা হত ১০ মাসে। মার্চ মাস থেকে শুরু হত নতুন বছর। খ্রিস্টের জন্মের ১৫৩ বছর আগে রোমে প্রথমবারের মতো ১ জানুয়ারিতে নববর্ষ উদযাপন শুরু করা হয়। খ্রিস্টের জন্মের ৪৬ বছর আগে রোমান স¤্রাট জুলিয়াস সিজার প্রাচীন রোমান দিন পঞ্জিকায় বড় ধরনের পরিবর্তন এনে নতুন দিন-পঞ্জিকা চালু করেন। এই দিন-পঞ্জিকায় ১ জানুয়ারিকে বছরের প্রথম দিন হিসাবে ঘোষণা করা হয়। সেই থেকে বছরের প্রথম দিন হিসাবে ১ জানুয়ারি নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। এই দিন-পঞ্জিকাকে বলা হত জুলিয়ান দিন পঞ্জিকা। ৫৬৭ খ্রিস্টাব্দের দিকে এসে ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে নববর্ষ হিসাবে ১ জানুয়ারিকে বাদ দিয়ে দেয়া হয়। এরপর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন দিনে নববর্ষ উদযাপন শুরু হয়। ১৫৮২ সালে গ্রেগরিয়ান দিন-পঞ্জিকার সূচনা হয়। নতুন এই দিন পঞ্জিকা অনুযায়ী ১ জানুয়ারিকে আবার নতুন বছরের প্রথম দিন হিসাবে উদযাপন করা হয়। গ্রেগরিয়ান দিন-পঞ্জিকার যাত্রা শুরু হলেও প্রথম দিকে উৎসব মুখর নববর্ষ উদযাপন করা হত না। অষ্টাদশ শতাব্দির প্রথম দিকে এসে ধীরে ধীরে বিভিন্ন দেশে নববর্ষ পালন করা শুরু হয়। এরপর ১ জানুয়ারি নববর্ষ হিসাবে আস্তে আস্তে জনপ্রিয় হতে শুরু করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ। ১৭৫২ সাল থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্য ১ জানুয়ারি নববর্ষ পালন করা শুরু করে। বিংশ শতাব্দির মাঝামাঝি সময়ে এসে ১ জানুয়ারি ঘটা করে উৎসব মুখর পরিবেশে বিশ্বের সকল দেশে নববর্ষ পালন শুরু করা হয়। ইউরোপের অনেক দেশে এই দিনটি সরকারি ছুটির দিন হিসাবে পালন করা হয়। বিশ্বের সকল দেশে গ্রেগরিয়ান নববর্ষ উদযাপিত হলেও সকল দেশে এটি প্রধান নববর্ষ উৎসব নয়। মধ্যপ্রাচ্যের দেশসমূহে আরবি নববর্ষ বাংলাদেশে বাংলা নববর্ষ এবং চীনে চীনা নববর্ষের পঞ্জিকা অনুসারে নববর্ষ পালন করা হয়।
খ্রিস্টীয় নববর্ষের আলো-ঝলমল সূচনা মুহূর্ত নিয়ে উচ্ছাস-উল্লাস বাঙালি সংস্কৃতির নিজস্ব কোন সম্পৃক্ততা না থাকলেও পাশ্চাত্য-প্রভাব শহরাঞ্চলে এর ব্যপ্তি ঘটেই চলেছে। বিশেষ করে তরুণ সমাজ নববর্ষ উদযাপনে উদ্দীপিত। বৃহত্তর জনগোষ্ঠির যারা জীবিকার কঠোর সংগ্রামে, সমস্যার ভারে ভারাক্রান্ত, এসব নিয়ে বিন্দুমাত্র মাথা ঘামানোর কোনো অবকাশ নেই তাদের জীবনে। তবুও জীবন চলে জীবনের টানে।
বাঙালি সংস্কৃতির বলয়ের বাইরে হলেও অনেক স্বপ্ন ও সম্ভাবনা নিয়ে প্রতি বছর পহেলা জানুয়ারি আমাদের মাঝে আসে স্বপ্ন-সাহসে উল্লাসে। আমরা দিনটিকে বরণ করে নেই বিশ্বায়নের গতিময় ও ছন্দময় জীবন সাজানোর তাগিদে। তারপরও আবহমান বাংলার চিরায়ত ঐতিহ্য ও সংস্কৃতিতে ধারণ করে বাঙালি হৃদয়ে আবর্তিত হয় বাঙালির পহেলা বৈশাখ বাংলা নববর্ষ। রাঙায় জীবন এবং অঙ্গীকার করি নতুন বছরে নতুনভাবে জীবনের স্বপ্নগুলোকে শাণিত চেতনায় বাস্তবে রূপ দিতে।
সময়ের স্রোতে এক একটি বছর গত হলেও ২০১৮ ছিল অনন্য। জাতীয় চেতনার সঠিক প্রতিফলন এবং পুনর্জাগরণের নতুন সম্ভাবনা জাতি প্রত্যক্ষ করেছে। অপশক্তির বিরুদ্ধে জাতি ঐক্যবদ্ধ হয়ে দাঁড়িয়েছে ইতিহাসের এক মহাসড়কে। সূচিত হয়েছে নবযাত্রা। পর্বত সমান প্রতিকূলতা ডিঙিয়ে এবং সহিংসতা মোকাবেলা করে দেশের মানুষ সাহসিক অভিযানে দেশের অগ্রযাত্রার মিছিলে শামিল হয়েছে। বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র দেশের কলঙ্ক মুছে বাংলাদেশ আজ পরিচিত পাচ্ছে অমিত সম্ভাবনার দেশ হিসাবে। বিশ্বের দরবারে বাংলাদেশ উন্নয়নের রোল মডেল হিসাবে পরিচিত লাভ করেছে।
যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ শূন্য থেকে মানুষের অক্লান্ত পরিশ্রম, সংগ্রাম আর নিষ্ঠার মাধ্যমে আজকের অবস্থানে উঠে এঠে এসেছে। স্বনির্ভর অর্থনীতির মানদন্ডে বাংলাদেশ এখন নিজস্ব শক্তি ও প্রেরণায় বিরাজমান সমস্যাগুলো দূর করে ভিশন ২০২১-এর সফল বাস্তবায়নে অঙ্গীকারবদ্ধ। লাখো শহীদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত এ দেশকে একটি মধ্যম আয়ের দেশে এবং ক্রমান্বয়ে উন্নত দেশে পরিণত করার প্রয়াস অব্যাহত রয়েছে।
নতুন বছরের সূচনায় আমরা প্রত্যাশা করছি উন্নয়নের স্বার্থে রাজনৈতিক দলগুলো তাঁদের ভিন্ন মতের ব্যবধান কমিয়ে একটি স্থিতিশীল পরিবেশ গঠনের মাধ্যমে অর্থনীতির গতিপ্রবাহকে বেগবান করবেন। কেননা স্থিতিশীল রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কর্মপরিবেশ এবং চলমান উন্নয়ন কার্যক্রমের ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে পারলেই দেশ এগিয়ে যাবে। মধ্যম আয়ের দেশ হিসাবে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিতে আমাদের ঐক্যবদ্ধ উন্নয়ন পরিকল্পনার অংশগ্রহণ জরুরি। উন্নয়নের মহাসড়ক ধরে বাংলাদেশকে নিয়ে যেতে হবে উন্নত দেশের কাতারে। বিজয়ের সাড়ে চার দশকে ঐকান্তিক চেষ্টায় সহাস্রাব্দের উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনসহ অনেক চ্যালেঞ্জ জয় করেছে বাংলাদেশ। বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নিয়ে কাজ করছে। বিশ্ব মন্দার দুর্যোগের বিরূপ প্রভাব ছুতে পারেনি দেশের অর্থনীতিকে। অর্থনীতি ও আর্থসামাজিক বেশির ভাগ সূচকে বাংলাদেশ ছাড়িয়ে গেছে দক্ষিণ এশিয়াকে এবং বিশ্বের তাবৎ দেশকে পিছনে ফেলে দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক দেশ হয়েছে বাংলাদেশ। অবকাঠামো, বিদ্যুৎ উৎপাদন, যোগাযোগ ও বন্দরের উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য বিপুল অগ্রগতি অর্জিত হয়েছে। সমৃদ্ধি অর্জনের অভিযাত্রায় আমাদের যেতে হবে আরও অনেক দূর।
দারিদ্র্যকে নির্মূল করে মানসম্মত শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মসংস্থান, বিদ্যুৎ, জ্বালানি, পরিবহন ও যোগাযোগ, প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ করে সমাজের সব ক্ষেত্রে সুশাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে। সমৃদ্ধশালী বিশ্বব্যবস্থার জন্য জনগণের জীবনকে রূপান্তর করতে উন্নয়নকে ধ্রুব নক্ষত্র করে উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যেতে হবে। হিসাবের খাতায় ব্যর্থতার গ্লানি মুছে সামনে এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয়ে নতুন বছরে নতুন শপথে বলীয়ান হবে দেশের মানুষ। শান্তিকামী মানুষ সহিংসতা, হত্যা-খুন কিংবা হানাহানির রাজনীতি পরিহার সমৃদ্ধিশালী বাংলাদেশ গড়ার স্বপ্ন দেখছে। নব চেতনার নববর্ষে নতুন দিনের নতুন সূর্যালোকে অগ্নিশপথে উদ্দীপিত হবে জাতি। বিগত বছরের সব কালিমা ধূয়ে-মুছে এগিয়ে যাবে সময়, সভ্যতা, হিংসা-বিদ্বেষ-হানাহানিমুক্ত রাজনীতি, অর্থনীতি আর সংস্কৃতির পথ ধরে অনাবিল স্বপ্ন আর অফুরন্ত প্রণোন্মদনায়।
আমাদের প্রত্যাশা একটি স্থিতিশীল ও উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন। আর তা নতুন বছরের সামগ্রিক উন্নয়নের মধ্য দিয়ে আরও কয়েক ধাপ এগিয়ে যাবে । নতুন সম্ভাবনার দ্বার খুলে দেবে আমাদের জীবনে। আগামীর একটি সমৃদ্ধ ভবিষ্যতকে সামনে রেখে যাত্রা শুরু হোক সবার। আগামী পৃথিবী হোক অহিংসার বাতাবরণে যুদ্ধ-সংঘর্ষহীন এবং সবার জীবন হোক নবতর চেতনায় ঋদ্ধ।
লেখক: সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।