পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
ভোটকে বলা হয় পবিত্র আমানত। এটি নাগরিকের একটি অধিকারও বটে। একজন মুসলমান নাগরিক এ অধিকারের খেয়ানত করতে পারেন না। ভোটের মাধ্যমে নেতা নির্বাচিত হয়। গঠিত হয় জাতীয় সংসদ। সংসদ সদস্যরা আইন প্রণয়ন করেন এবং সে আইন অনুযায়ী দেশ পরিচালিত হয়। সুতরাং ভোট প্রদানের ক্ষেত্রে সকল নাগরিককে হতে হবে দায়িত্বশীল। বিশেষ করে একজন মুসলিম নাগরিককে আরোও বেশি সতর্ক থাকতে হবে। সৎ ও যোগ্য প্রার্থীকে প্রধান্য দিতে হবে। টাকার বিনিময়ে ভোট বিক্রয় করা যাবে না। অন্যান্য চুরির ন্যায় ভোট চুরি করাও একটি গুরুতর অপরাধ। জাল ভোট প্রদান ও অন্যকে ভোট প্রদানে বাধা প্রদানকারী হাক্কুল ইবাদ লঙ্ঘনের দায়ে অভিযুক্ত হবে। একজন মুসলমান নিজে অন্যায় করবেন না এবং অন্যকে অন্যায় করার সুযোগ দেবেন না।
মানুষ মূর্তির মতো নির্বোধ নয়। ফেরেশতার মতো নির্ভুল নয়। শতভাগ ভালো মানুষ পাওয়া দুষ্কর। তারপরেও ন্যায়-অন্যায়, ভালো-মন্দ, হক ও বাতিল, ঈমান ও কুফর, সুন্দর ও অসুন্দর এর পার্থক্য নির্ধারণের ক্ষেত্রে আপনার ভোট হতে পারে একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত। কল্যাণ ও অকল্যাণের এ মিশ্রিত সময়ে অপেক্ষাকৃত তুলনামূলক সৎ, ভালো ও ইসলামপন্থী মযলুম মানুষগুলো হতে পারে আপনার সমবেদনার আশ্রয়স্থল। ইসলামী সংগঠনসমূহ ঐক্যবদ্ধ থাকলে মুসলিম জনগণ আরো খুশি হতেন। এরপরেও একজন ঈমানদার মুসলিম নাগরিকদের দায়িত্ব ইসলাম ও মুসলমানদের প্রতি সহনশীল মানুষগুলোকে সমর্থন দেওয়া। আজ অমুসলিম বিশ্ব এগিয়ে গেছে। কারণ তারা যাই করুক নির্বাচনের ক্ষেত্রে তারা কারচুপির আশ্রয় নেয় না। আমাদের দেশে নির্বাচনের পরও অনেকে রোষানলের শিকার হয়। ভোটের মাধ্যমে ইসলাম যে কেবল দোয়া দুরূদের মন্ত্র নয়, ইসলামে যে একটি শাসনতন্ত্র ও তার রাষ্ট্রীয় দর্শন রয়েছে এটির প্রয়োগ ঘটাতে হবে। ভোটের ক্ষেত্রে কোরআন-সুন্নাহর আলোকে ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি নি্ম্নে উল্লেখ করা হলো:
১। ভোট হলো একটি সুপারিশ। এ প্রসঙ্গে কোরআনের বক্তব্য হচ্ছে, ‘কেউ কোনো ভালো কাজে সুপারিশ করলে তাতে তার অংশ রয়েছে, আর কেউ মন্দ কাজে সুপারিশ করলে তাতেও তার অংশ রয়েছে’ (সূরা নিসা আয়াত নং ৮৫)। সুতরাং আপনার সুপারিশটি যেন সুন্দর ও বাস্তবধর্মী হয়।
২। ভোট হলো একটি সাক্ষ্য। আল্লাহতায়ালা বলেছেন, ‘হে মুমিনগণ তোমরা ন্যায়বিচারে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠিত থাকো। আল্লাহর ওয়াসতে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্য প্রদর্শন করো, যদিও তা তোমাদের নিজেদের অথবা পিতামাতা এবং আত্মীয়-স্বজনের বিরুদ্ধে হয়, সে বিত্তবান হোক বা বিত্তহীন হোক আল্লাহ্ই শুভাকাক্সক্ষী তোমাদের চেয়ে। সুতরাং তোমরা বিচার করতে প্রবৃত্তির অনুগামী হয়ো না। যদি তোমরা প্যাঁচালো কথা বলো অথবা পাশ কেটে যাও তবে তোমরা যা করছ আল্লাহ্ তো তার সম্যক খবর রাখেন’ (সূরা নিসা, ৪: ১৩৫)। মহানবী (সা.) বলেছেন- মিথ্যা সাক্ষী দেওয়া কবিরা গোনাহ। সুতরাং একজন ভোটার হচ্ছে রাষ্ট্র পরিচালনার ক্ষেত্রে একজন সাক্ষীদাতা।
৩। ভোট অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি প্রতিবাদ। প্রিয় নবী (সা.) বলেছেন, তুমি অন্যায়ের বিরুদ্ধে হাতের অথবা মুখের অথবা অন্তরের সাহায্যে লড়াই কর। (মিশকাত, পৃষ্ঠা-৪৩৬)। হারজিত থাকবেই। এ লড়াইয়ে অংশগ্রহণ করা মুমিনের দায়িত্ব।
৪। ভোট যুলুমের বিরুদ্ধে মযলুমের রায়। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, তুমি সাহায্য কর, তোমার ভাইকে সে যদি যালিম কিংবা মযলুমও হয়। এর ব্যাখ্যায় মহানবী (সা.) নিজেই বলেন, যালিমকে সাহায্য দানের অর্থ হলো যুলুম থেকে নিবৃত্ত রাখা। তাই ভোট হতে পারে অন্যায়-অবিচারের বিরুদ্ধে একটি নিরব প্রতিবাদ।
৫। ভোট হলো একটি দাওয়াত। আল্লাহ্ তায়ালা বলেছেন, তোমরা এমন একটি দল, মানুষকে কল্যাণের দিকে আহবান করবে। মারুফ কাজের আদেশ করবে এবং মন্দ কাজ থেকে বারণ করবে। এতেই তোমরা সফল হতে পারবে। সুতরাং ইসলাম ও মুসলমানের দিকে আহবানের ক্ষেত্রে ভোট একটি কৌশলগত দাওয়াত।
৬। ভোট হলো ঐক্যের সোপান। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘ঐক্যবদ্ব্যভাবে আমার রুজ্জুকে ধরে রাখ এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না’ (সূরা আল- ইমরান)। অন্যৈক্যের কারণেই আজ মুসলমানদের বিপর্যয়। আমরা হতাশ হই যখন দেখি ইসলামি দলগুলোর মধ্যেও প্রবল বিরোধ। এক্ষেত্রে ইখতিলাফ মাআল ইত্বিহাদ নীতির ভিত্তিতে আমাদেরকেঐক্যবদ্ধ হতে হবে। দূরত্ব কমিয়ে আনতে হবে। নয়তো একসময় সকল ইসলামি শক্তিই অসহায় হয়ে যাবে।
৭। ভোট হলো একটি আমানত। কোরআনুল কারিমে আল্লাহ তায়ালা বলেন, আমানত তার হক্দারকে প্রত্যার্পণ করার জন্য আল্লাহ্ তোমাদেরকে নির্দেশ দিচ্ছেন। (সূরা নিসা), সুতরাং আপনি যাকে আপনার কাজের দায়িত্ব প্রদান করছেন তার ইচ্ছা ও যোগ্যতা উভয়ইটি দেখতে হবে।
৮। ভোট হলো নেতা/প্রতিনিধি নির্বাচনের কৌশল। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, ‘আর তাদের নবী তাদেরকে বলেছিল, আল্লাহ্ অবশ্যই তালুতকে তোমাদের রাজা করেছেন। তারা বললো, আমাদের উপর তার রাজত্ব কীরূপে হবে; যখন আমরা তার অপেক্ষা রাজত্বের অধিক হক্দার এবং তাকে প্রচুর ঐশ্বর্য্য দেয়া হয়নি। নবী বললেন, আল্লাহ্ অবশ্যই তাকে তোমাদের জন্য মনোনীত করেছেন এবং তিনি তাকে জ্ঞানে ও দেহে সমৃদ্ধ করেছেন, আল্লাহ্ যাকে ইচ্ছা স্বীয় রাজত্ব দান করেন। আল্লাহ্ প্রাচুর্যময়, প্রজ্ঞাবান।’ (সূরা বাকারা ২৪৭), সুতরাং জনগণের প্রতিনিধি কেমন হবে এবং আপনার প্রতিনিধি কেমন হবে। এটা ভোটের মাধ্যমে নির্ধারণের সুযোগ রয়েছে।
৯। ভোট হলো নাগরিকের সমর্থনের একটি মাধ্যম। আপনি কাকে সমর্থন করবেন? এটি ভোটের মাধ্যমে বহিঃপ্রকাশ ঘটবে। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, রোমানরা নিকটবর্তী নি¤œ ভূমিতে পরাজিত হয়েছিল। তাদের পরাজয়ের কয়েক বছরের মধ্যে আল্লাহ তায়ালার আদেশে আবার তারা বিজয়ী হবে। অগ্রপশ্চাত তারই হাতে। এতে মুমিনগণ আনন্দিত হবে। (সূরা রোম- ১-৪), এ আয়াতের শানে নুযুল হচ্ছে মক্কী জীবনে রোম ও পারস্য স¤্রাজ্যের মধ্যে যুদ্ধ হয়েছিল। রোমকরা কিছুটা আহলে কিতাবী হওয়ায় আবু বক্কর সিদ্দিক (রা.) এবং তার সতীর্থরা তাদের বিজয় কামনা করেছিলেন। অন্যদিকে আবু জাহেল গং পারসিকরা অগ্নী পুজারি হওয়ায় তাদের জয় আশা করছিলেন। কিন্তু দেখা গেল প্রথম দফা যুদ্ধে পারসিকরা জিতে গেল। এতে আবু জাহেল ও তার সমর্থকগণ উল্লাসিত হন এবং আবু বক্কর (রা.) ও তার বন্ধুরা ব্যথিত হন। পরবর্তীতে সূরা রোম এর প্রারম্ভিক আয়াতসমূহ নাযিল করে আল্লাহ তায়ালা নবী (সা.) ও সাহাবায়ে কেরামগণকে সান্ত¦না প্রদান করেন। এ থেকে আমরা কী শিক্ষা পেলাম। ভোটের ক্ষেত্রেও নিরবতা কাম্য নয়।
১০। ভোট হলো নাগরিকের মতামত বা পরামর্শ প্রদান। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, আপনি কাজ কর্মে তাদের সাথে পরামর্শ করবেন। অতঃপর আপনি কোনো সংকল্প করলে আল্লাহর উপর ভরসা করবেন। (সূরাআল ইমরান- ১৫৯) পরামর্শ করে কাজ করলে সে কাজের মধ্যে বরকত হয়। রাষ্ট্রীয় নীতি কী হবে সেক্ষেত্রে ভোটের মাধ্যমে নাগরিক তার অভিপ্রায় ব্যক্ত করতে পারেন।
এ ভূখণ্ডের প্রকৃত মালিক মহান আল্লাহ্ সুবহানাহু ওয়া তায়ালা। ভোটের পর মুসলিমতো বটেই কোনো অমুসলিম নাগরিকও যেন নিগৃহীত নির্যাতিত ও দলবাজীর শিকার না হয়। আমরা দোয়া করি, নির্বাচন যেন সুষ্ঠু, অবাধ ও নিরপেক্ষ হয়। সরকারি ও বিরোধীদলের মধ্যকার দূরত্ব যেন কমে আসে। নির্বাচন পরবর্তী নাগরিকদের মধ্যে যেন গড়ে ওঠে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন।
লেখক: সাবেক খতিব, ঐতিহাসিক শোলাকিয়া ঈদগাহ, কিশোরগঞ্জ ও গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।