পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আজ ২৫ ডিসেম্বর মঙ্গলবার। ইলেকশন সম্পর্কে এটিই হবে আমার শেষ লেখা। কারণ পরবর্তী মঙ্গলবার হলো ১ জানুয়ারি ২০১৯। কিন্তু নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে ৩০ ডিসেম্বর ২০১৮। তাই অনেক চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়ে এই লেখাটি লিখছি। সাত পাঁচ না ভেবেই যে কথাটি সোজা সাপটা বলা যায় এবং অনেকেই বলছেন, সেটা হলো এই যে গত ৪৭ বছরে এই ধরনের নির্বাচন কেউ দেখেননি। কথাটি আমার নয়। আওয়ামী লীগের জন্য যিনি জান কোরবান করেছেন, কাদের সিদ্দিকীর সেই ভাই সাবেক আওয়ামী মন্ত্রী লতিফ সিদ্দিকীর। একই ধরনের কথা বলেছেন আরেকজন সাবেক আওয়ামী স্টলওয়ার্ট নূরে আলম সিদ্দিকী। লতিফ সিদ্দিকী স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসাবে ইলেকশন করতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তার গাড়ি বহরের ওপর হামলা হয়। তিনি প্রতিবাদে ডিসি অফিসের সামনে শীতের রাতে বিছানা-কাঁথা নিয়ে শুয়ে পড়েন এবং আজীবন অনশন শুরু করেন। কিন্তু আজীবন বললেই কি আজীবন হয়? দেখা গেলো, লোটাকম্বল গুটিয়ে তিনি চিফ ইলেকশন কমিশনারের কাছে গেছেন। তাকে বলেছেন, মাঠ সমতল না থাকায় তিনি নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ালেন। সিইসির সঙ্গে দেখা করার পর লতিফ সিদ্দিকী সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি আর নির্বাচন করছি না। কারণ, মাঠ নির্বাচন করার মতো সমতল নয়। মাঠ এমনই সমতল যে, পুলিশের বুটের তলে পড়তে হয়। আর সন্ত্রাসীদের লাঠির আঘাত খেতে হয়। আমার অফিস ভেঙে দিয়েছে। আমার নিরীহ লোকদের প্রতিনিয়ত গ্রেফতার করছে। যারা সমর্থক তাদের পুলিশ প্রতিনিয়ত টেলিফোন করে ভয় দেখাচ্ছে। এর পরেও ইলেকশন করা যায় নাকি?’
লতিফ সিদ্দিকীর কি এটি বিলম্বিত চেতনা? নাকি আওয়ামী লীগের মার খাওয়ার পর তাঁর হুঁশ ফিরলো? তিনি যখন পাটমন্ত্রী ছিলেন তখন কি তিনি ভুলে গেছেন যে, আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনার দালালি করতে গিয়ে কি চরম উস্কানিমূলক এবং হিংসাশ্রয়ী কথাবার্তা বলেছেন? এই তো মাত্র সেদিনের কথা। মন্ত্রী থাকা কালে তিনি বলেন যে, আওয়ামী লীগ, শেখ হাসিনা এবং বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে যে কথা বলবে তার ঘরের মধ্যে গিয়ে তাকে হত্যা করা হবে। তিনি কি ভুলে গেছেন যে, ৯০ শতাংশ মুসলমানের দেশে তিনি পবিত্র হজ্জ এবং মহানবী (স.) সম্পর্কে কত বড় স্পর্ধিত কথা বলেছেন এবং হজ্জের বিরুদ্ধে আস্ফালন করেছেন। আমি শেখ হাসিনার বহুকালের কট্টর সমালোচক। কিন্তু অন্তত তার একটি কাজের প্রশংসা না করে পারা যায় না। সেটি হলো এই লতিফ সিদ্দিকীকে তিনি শুধু মাত্র মন্ত্রিত্ব থেকেই তিনি তাড়িয়ে দেননি, আওয়ামী লীগ থেকেও বিতাড়ন করেছেন। লতিফ সিদ্দিকী সারা জিন্দেগী আওয়ামী লীগ করেছেন। কিন্তু মনে হয়, আসল আওয়ামী লীগ চিনতে পারেননি। এই বার মনে হয় হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন যে, আওয়ামী লীগ কী জিনিস এবং কত প্রকার। তাঁর ইলেকশন করার সাধ আওয়ামী লীগ ভুলিয়ে দিয়েছে।
আর একজন হলেন, আওয়ামী লীগের সাবেক নেতা, শেখ মুজিবের সাবেক তথ্য প্রতিমন্ত্রী অধ্যাপক আবু সাঈদ। তিনি আওয়ামী লীগের কত বড় ডার্লিং ছিলেন তার বড় প্রমাণ হলো এই যে, ১৯৭৫ সালে বাংলাদেশের ৬৪ জেলায় যে ৬৪ জন গভর্নর নিযুক্ত হন, তিনি ছিলেন তার অন্যতম। ওয়ান ইলেভেনের পর তিনি শেখ হাসিনার নেক নজর থেকে পড়ে যান। অনেক ধর্না দিয়েছেন, অনেক তৈলমর্দন করেছন, কিন্তু শেখ হাসিনার নেক নজরে আর ফিরে আসতে পারেননি। এবারও যখন আওয়ামী লীগ তাকে মনোনয়ন দেয়নি এবং শেখ হাসিনার আর ধারেপাশে পাত্তা পাননি তখন গণফোরামে ধর্না দিয়েছেন এবং ড. কামাল হোসেন তাকে নমিনেশন দিয়েছেন। তারও হয়েছে বিলম্বিত বোধদয়। সারা জীবন যিনি আওয়ামী প্রশস্তি গাইলেন, তিনি এবার ধানের শীষ কাঁধে নিয়ে বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন হলে আওয়ামী লীগের প্রার্থী ২০ শতাংশ ভোটও পাবে না। তিনি বলেন, সরকার দলীয় প্রার্থী সশস্ত্র সন্ত্রাসী বাহিনী নিয়ে নকল পুলিশ সাজিয়ে নির্বাচন করছেন। আমাকে নির্বাচনী মাঠে কাজ করতে দেয়া হচ্ছে না। প্রচার-প্রচারণা শুরুর পর থেকে আমাকে হত্যার উদ্দেশ্যে ১২ বার হামলা করা হয়েছে। হামলার বিষয়গুলো নির্বাচন কমিশন কর্মকর্তাসহ স্থানীয় সকল প্রশাসনকে লিখিত ও মৌখিকভাবে অভিযোগ করেছি, কিন্তু কোনো সমাধান হয়নি। অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা পুলিশের সামনে আমার উপর হামলা চালালেও তারা কোনো পদক্ষেপ গ্রহণ করছেন না। বাধা দেওয়া বা লাঠিচার্জ তো দূরের কথা তারা নীরব দর্শকের ভূমিকা পালন করছেন, কিন্তু কেন?
আরেক জন সাবেক আওয়ামী স্টলওয়ার্ট হলেন, নূরে আলম সিদ্দিকী। মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পূর্বে এবং মুক্তিযুদ্ধকালে শেখ মুজিব যখন পাকিস্তানের জেলে ছিলেন তখন চার ছাত্র নেতা আন্দোলন এবং সংগ্রাম পরিচালনা করছিলেন। এই চার নেতার একজন হলেন নূরে আলম সিদ্দিকী। নূরে আলম সিদ্দিকী বলেছেন যে, তিনি তার ৫০ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এমন একপক্ষীয় নির্বাচন দেখেননি। পত্রিকান্তরে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেন, তার মতে জনগণ ধরেই নিয়েছে, আরো ৫ বছরের জন্য ক্ষমতাকে পোক্ত করার একটি নিমিত্ত ছাড়া এ নির্বাচনের আর কোনো উদ্দেশ্য নেই। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রশাসনতো একচেটিয়াভাবে সরকারি দলের পক্ষে মাঠে নেমে গেছে। পুলিশ প্রশাসন এখন আওয়ামী লীগের সবচেয়ে বিশ্বস্ত ক্যাডার। অনেক থানার ওসি পায়জামা, পাঞ্জাবি পরে, বঙ্গবন্ধু কোট গায়ে দিয়ে আওয়ামী লীগ নেতার মতো বক্তৃতা করছেন। দিনে বক্তৃতা করছেন, রাতে বিএনপি কর্মীদের দৌড়ের ওপর রাখছেন। আমার পঞ্চাশ বছরের রাজনৈতিক জীবনে এমন একপক্ষীয় ও বেহাল অবস্থা কখনও দেখিনি।
দুই
লতিফ সিদ্দিকী এবং নূরে আলম সিদ্দিকী বাংলাদেশী জাতীয়তাবাদী ঘরানার মানুষ নন। কথায় বলে, কেউ দেখে শেখে এবং কেউ ঠেকে শেখে। এই দুই সিদ্দিকী এবং আবু সাইদ ঠেকে শিখেছেন। এবং যেটা শিখেছেন সেটি সঠিকভাবেই বুঝে শুনে শিখেছেন। দেশি-বিদেশি যেসব রাষ্ট্রবিজ্ঞানীর লেখা পড়ে এই বয়সে এসেছি, এখন মনে হচ্ছে ওরা সকলেই আমাদেরকে ভুল শিক্ষা দিয়েছেন। আমরা শিশু শিক্ষায় পড়েছি, ‘সকালে উঠিয়া আমি মনে মনে বলি/ সারাদিন আমি যেন ভাল হয়ে চলি।’ এখন মনে হচ্ছে, দ্বিতীয় লাইনটি হওয়া উচিত ছিল, ‘সারাদিন আমি যেন পাজি হয়ে চলি।’ যদি তাই না হবে তাহলে যে সব ঘটনা ঘটে চলেছে সেসব ঘটনা ঘটে কীভাবে? পৃথিবীতে কি এমন কোনো দেশ আছে যেখানে তফসিলের পর বেপরোয়া রাজনৈতিক ধরপাকড় চলে? পৃথিবীতে কি এমন কোনো দেশ আছে যেখানে নমিনেশন পেপার প্রত্যাহারের পর রাজনৈতিকভাবে গ্রেফতার এবং রিমান্ড চলে? পৃথিবীতে কি এমন কোনো দেশ আছে যেখানে বিরোধী দলীয় প্রার্থীরা লিফলেট বিলি করতে গেলে মার খায়? যেখানে পোস্টার লাগাতে গেলে মার খায়? যেখানে ২৪ ঘণ্টা পুলিশের নাকের ডগার ওপর বিরোধী দল কোনো পোস্টার লাগাতে পারে না এবং ব্যানার ও ফেস্টুন টাঙাতে পারে না? পৃথিবীতে কি এমন কোনো দেশ আছে, যেখানে নির্বাচনে প্রার্থী হয়েছেন এবং ইলেকশন কমিশন যাদেরকে বৈধ প্রার্থী হিসাবে ঘোষণা করেছেন তেমন অন্তত ১৭ জন প্রার্থীকে নির্বাচনের আগের দিনেও কারাগারে রাখা হয়? পৃথিবীতে কি এমন কোনো দেশ আছে, যেখানে এক বছর আগে করা মামলা ঠিক নির্বাচনের ১৫ দিন আগে পুনরুজ্জীবিত করে প্রার্থীকে গ্রেফতার করা হয়? পৃথিবীতে কি এমন কোনো দেশ আছে যেখানে শত শত জায়গায় বিরোধী দলীয় প্রার্থী, তার সমর্থক ও নেতাকর্মীকে সরকারি দলের গুণ্ডারা প্রকাশ্য দিবালোকে পুলিশের নাকের ডগার ওপরে বেপরোয়া মারপিট করে? পৃথিবীতে কি এমন কোনো দেশ আছে, যেখানে ছয় ছয় বার পার্লামেন্টে নির্বাচিত সদস্যের ওপর (মাহবুব উদ্দিন খোকন) পুলিশ নির্বিচারে গুলি চালায়? গুলি চালিয়েও বহাল তবিয়তে পার পেয়ে যায়?
হ্যাঁ, আছে একটি দেশ। সেই দেশের নাম বাংলাদেশ। অনেক উচ্চশিক্ষিত লোক এখন বলছেন যে ইলেকশনের আগে প্রার্থী এবং তার নেতাকর্মীদেরকে পুলিশের সামনে মারধর, গাড়ি ভাঙচুর, ঘরবাড়ি এবং অফিসে অগ্নিসংযোগ বর্তমান সরকারের ১০ বছরে আমাদের রাজনৈতিক কালচারে পরিণত হয়েছে। এগুলো কি ঘটনার স্বাভাবিক পরিণতি? নাকি অত্যন্ত সুপরিকল্পিতভাবে একটি নীল নকশা ধরে একটি বিশেষ রাজনৈতিক পিরামিড গড়ে তোলার জন্য রাষ্ট্রীয় মদদে এগুলো করা হচ্ছে? দেশজুড়ে আজ যে মারপিটের কালচার, রাজনৈতিক অরাজকতা ও নৈরাজ্য, এগুলো কোনো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। বাংলাদেশের বর্তমান সরকার ইতোমধ্যেই ১০ বছর শাসন করেছে। এবার মারপিট করে ক্ষমতা দখল করলে ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকবে। ১৫ বছর ক্ষমতায় থাকতে পারলে তাদের ২০৪১ সাল পর্যন্ত ক্ষমতায় থাকার টার্গেট পূরণ হবে। তাহলেই মিশরের হুসনি মোবারক, তিউনিসিয়ার বেন আলী, লিবিয়ার গাদ্দাফি, রাশিয়ার পুতিন, সোভিয়েট ইউনিয়নের স্ট্যালিন প্রমুখ রাষ্ট্র নায়কের সমপর্যায়ে চলে যাবে বাংলাদেশের শাসক গোষ্ঠি। এগুলো সবই ঘটবে যদি ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনে সরকার বাহুবলে হোক, অথবা অন্য কোনো পন্থায় হোক, ক্ষমতা নিশ্চিত করতে পারে।
যেসব ঘটনার কথা বলা হলো, সেগুলো যদি ঘটে তাহলে সংবিধানে বর্ণিত মৌলিক অধিকার, ব্যক্তি ও বাক স্বাধীনতাসহ হরেক ধরনের স্বাধীনতা পদদলিত হবে এবং লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতার গলায় পরিয়ে দেওয়া হবে রাজনৈতিক দাসত্বের ফাঁস। আজ যে উন্নয়নের কথা বলা হচ্ছে ঠিক একই ভাষায় উন্নয়নের কথা বলেছিলেন পাকিস্তানের মিলিটারি ডিকটেটর জেনারেল আইয়ূব খান। আইয়ূব নাই, কিন্তু তার উন্নয়নের সেই ভৌতিক কণ্ঠস্বর আজ আবার শোনা যাচ্ছে। এই জাতি কি মুক্তির আস্বাদ গ্রহণ করতে চায়? করতে চাইলে পথ একটিই। সেটি হলো ‘আমার ভোট আমি দেব, যাকে খুশি তাকে দেব।’ কীভাবে সেটি সম্ভব? ৩০ ডিসেম্বর সকাল ৮টার আগেই ভোট কেন্দ্রে জমায়েত হতে হবে এবং সকাল ৮টা থেকেই ভোট দেওয়া শুরু করতে হবে। যারা বিরোধী দলীয় পোলিং এজেন্ট থাকবেন তারা কেউ নিজের স্থান ছেড়ে যাবেন না। রাত ৮টা হোক আর ১২টা হোক, ভোট গণনার সময় উপস্থিত থাকবেন এবং রেজাল্ট শিটে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের সিলছাপ্পড় নিয়ে তারপর ঘরে ফিরবেন। তার আগে ঘরে ফিরবেন না।
দেখবেন আপনাদের বিজয় অবশ্যাম্ভাবী। নিশ্চয়ই মোমিনদের জন্য আল্লাহর সাহায্য এবং বিজয় নিকটবর্তী।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।