Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

এখন চলছে অর্থ আর নির্দেশের রাজনীতি

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২২ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

Left Hand of the law প্রবাদ বাক্যটি আইনশাস্ত্র প্রয়োগ হওয়ার দিন থেকেই চলে আসছে। ধারণা করা হয় যে, জনগণের কল্যাণের জন্য আইন। এর চেয়ে অধিক সত্যকথা এই যে, ক্ষমতাকে আঁকড়ে রাখার জন্যই আইন প্রয়োগ করা হয় এবং হচ্ছে। যখন এর ব্যত্যয় হয় তখনই জনস্বার্থের কথা বলে আইনটি বাতিল করা হয়, যে আইন রচিত হয়েছিল জনস্বার্থের কথা বলেই। জনস্বার্থ যখন রাজার স্বার্থে (রাজা বলতে ক্ষেত্র মতে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, শাসনকর্তাকে বুঝানো হয়েছে) আঘাত হানে তখনই আইনটি বিলুপ্ত করে মাটি চাপা দেয়া হয়। যেমন সংবিধান থেকে নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের অনুচ্ছেদটি ক্ষমতায় এসেই মাটি চাপা দিয়েছে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ। অথচ দলটি ছিল আইনটি পাশ করানোর অন্যতম উদ্যোক্তা। প্রস্তাবটি প্রথমে জামায়াতে ইসলামী থেকে উপস্থাপন করা হয়েছিল। আইনের ‘বাম হাতের’ শেষ নাই। আইন প্রয়োগকারী ব্যক্তিরাও আইনের অপপ্রয়োগ করেন আইনের ‘বাম হাতকে’ ব্যবহার করে। যেমন একই অপরাধ সরকারি দল করলে আইন প্রয়োগকারীরা অন্ধের মতে বলে যে, কোনো ঘটনা হয়েছে কি না শুনি নাই, জানি না বা কোনো অভিযোগ পাই নাই। পক্ষান্তরে বিরোধী দল বা সাধারণ মানুষ যদি একই অপরাধ করে তবে আইন তৎক্ষণাৎ প্রয়োগ হয়ে যায় এবং একেই বলে Left Hand of the law কোথাও কোথাও অপরাধ না করেও আইন দ্বারা হেনস্থা হতে হয়, যদি সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সরকারপন্থী না হয়।
আমাদের দেশের আইন Interpret (ব্যাখ্যা) করা হয় প্রধানমন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে। কারণ সংবিধানের ৪৮(৩) ধারা মোতাবেক প্রধানমন্ত্রীই রাষ্ট্রের সবচেয়ে ক্ষমতাধর ব্যক্তি। সাবেক প্রধান বিচারপতি এস. কে. সিনহা (অপমান অপদস্থ হয়ে) দেশ ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়ে বিমান বন্দরে যাওয়ার উদ্দেশ্যে গাড়িতে উঠার সময় বলেছিলেন যে, ‘প্রধানমন্ত্রী আমার উপর অভিমান করেছেন’। প্রধানমন্ত্রী কারো উপর অভিমান করলে তার শেষ রক্ষা নাই, যেমনটি শেষ রক্ষা হয় নাই এস. কে সিনহার ক্ষেত্রেও। কারো মান-অভিমানের উপর ভিত্তি করে যখন আইনের Interpret হয় তখনই চলে আসে Left Hand of the law. অতএব, আইন সর্বক্ষেত্রে জনস্বার্থে ব্যবহৃত হয়, এটা সব ক্ষেত্রে বাস্তবতা নয়।
এতো গেল আইনের বাম হাতের কথা। কিন্তু রাজনীতির যে বাম হাত আরো জটিল। এ জটিলতার কারণেই জনগণের ভোগান্তির শেষ হচ্ছে না। কথায় ও কাজের সমন্বয় পাওয়া যাচ্ছে না। রাজনীতির এ কাল ও সে কাল একই ধারায় অতিবাহিত হচ্ছে না। কারণ এর গুণগত তফাৎ অনেক। পূর্বে নিজের সম্পদ বিলিয়ে রাজনৈতিক নেতারা রাজনীতি করতেন, কিন্তু বর্তমান রাজনীতি হচ্ছে শুধু সম্পদ নয় অঢেল সম্পদের পাহাড় গড়ার প্রতিযোগিতা। পূর্বে নীতির মধ্যে অটুট থাকাই ছিল রাজনীতিবিদদের জন্য মর্যাদাকর। বর্তমানে নীতির পরিবর্তনই রাজনীতিতে প্রমোশনের হাতিয়ার। রাজনীতিবিদদের এ হেন আচরণ দেখে খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষ টিপ্পনী কাটে, অথচ পল্টিবাজেরা এতে নিজেদের খুবই মর্যাদাবান মনে করেন। অবস্থান পরিবর্তনের কারণে বুটের তলায় এখন রাজনীতিবিদদের মর্যাদা। রাষ্ট্রটি দিনে দিনে পুলিশী রাষ্ট্রে পরিণত হওয়ার এটাই একটি কারণ।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হয় যে, রাজনীতিতে চক্ষু লজ্জা উঠে গেছে। কারণ পাছে লোকে কিছু বলে- এ অবস্থা এখন আর নাই। যে যাই বলুক, আমার সোনার হরিণ চাই- এ নীতিতে চলছে এখন দেশের রাজনৈতিক অঙ্গন। হাতের কাছে যা পেলাম তাই হজম করার যে নীতি অবলম্বন করা হচ্ছে এবং তাতে বেনিফিটেড হচ্ছে রাজনীতিতে সুবিধাবাদী ও সুবিধাসন্ধানী চক্র। বঞ্চিত হচ্ছে তৃণমূলের নেতাকর্মীরা, যারা মাথার ঘাম পায়ে ফেলে দল ও দলীয় মার্কাকে সারা বছর পাহাড়া দেয়। অথচ সময়মত মার্কা ছিনতাই হয়ে যায় সুবিধাবাদিদের আগ্রাসনে, যাতে সহযোগিতা করেন জাতীয় নেতৃত্ব, যদিও মুখে থাকে ভিন্ন কথা এবং এটাই রাজনীতির চলমান সংস্কৃতি।
রাজনীতির গুণগতমান পরিবর্তন হয় নাই বিধায় রাজনৈতিক অঙ্গনটি আবর্জনাপূর্ণ হয়ে পরিবেশকে ভারসাম্যহীন করে দিয়েছে। রাজনৈতিক দলগুলির একমাত্র টার্গেট ক্ষমতা দখল। সাংগঠনিকভাবে দলকে গড়ে তোলা বা নেতৃত্ব দেয়ার মতো আস্থাশীল সংগঠক তৈরি করার কোনো পরিকল্পনা বা পদক্ষেপ রাজনৈতিক দলগুলির মধ্যে নাই। ফলে নির্বাচন এলে অন্যদল থেকে প্রার্থী টেনে আনতে হয়। অন্যদিকে মনোনয়ন বিক্রি করার একটি রাস্তা তো সর্ব সময়ই খোলা থাকে, যাকে বলা হয় পার্টি ফান্ড সংগ্রহ। কিন্তু দল বা কর্মীদের নিদান কালে এ পার্টি ফান্ড কোথায় থাকে এর খবর আর কেউ দিতে পারে না।
রাজনৈতিক দলগুলি যদি সাংগঠনিক প্রক্রিয়ায় গড়ে উঠতো তবে কর্মীর মূল্যায়ন হতো, কর্মীরা নিজেকে দলের অংশীদার বলে মনে করতো। বর্তমানে বাস্তবতার নিরিখে কর্মী ও কর্মচারীর মধ্যে কোনো তফাৎ নাই। জাতীয় নেতৃত্বই কর্মীদের কর্মচারী বানিয়ে রেখেছে, যেভাবে ব্রিটিশরা ভারত উপমহাদেশকে কলোনীতে পরিণত করেছিল, যার অন্যতম হাতিয়ার ছিল DIVIDE AND RULE সুবিধাবাদী/সুবিধা সন্ধানীদের দ্বারা রাজনৈতিক অঙ্গন ভারসাম্যহীন হওয়ায় রাজনীতি নামক শক্তিটি এখন দুর্বল হয়ে পড়েছে, শক্তিশালী হয়েছে আমলা গোষ্ঠি যারা প্রকৃত পক্ষে জনগণের অর্থে লালিতপালিত রাষ্ট্রীয় কর্মচারী মাত্র, অথচ ভাবসাব এমন যে, তারাই দেশের নীতি নির্ধারক।
রাজনীতিতে অর্থের প্রভাবের কারণে রাজপথের নেতাকর্মীর মূল্যায়ন একটি Back dated দাবিতে পরিণত হয়েছে। অনেকে অভিমান করে বলে থাকেন যে, রাজপথে রক্ত দিয়েছি, কিন্তু কেন্দ্রীয় নেতারা আমাদের মূল্যায়ন করে নাই। এ দুঃখ থেকে হতাশায় অনেক নিষ্ঠাবান কর্মীকে রাজনৈতিক অঙ্গন থেকে বিদায় নিতে হয়েছে। বাস্তবতার নিরিখে অর্থের প্রভাবে নিষ্ঠাবান কর্মীরা কেন ভুলে যায় যে, এক ব্যাগ রক্তের মূল্য মাত্র ১৪৫ টাকা। টাকা যেখানে মূল্যায়নের মাপকাঠি সেখানে ১৪৫ কোটি টাকার মালিকের নিকট ১৪৫ টাকা মূল্যের রক্ত কীভাবে পাল্লা দিয়ে রাজনীতিতে টিকে থাকবে? ১৪৫ কোটি টাকার মালিকেরা সারা বছর রাজনীতি করেন না, তারা রাজনীতির মাঠে নামেন সময় বুঝে এবং জয় ছিনিয়ে নেন এবং এটাই বর্তমান রাজনৈতিক সংস্কৃতি। এ সংস্কৃতি রাজনৈতিক অঙ্গনকে গ্রাস করেছে বিধায় দেশ ও জাতি আজ রাজনীতিশূন্য হয়ে পড়েছে। রাজনীতির বাম হাতের প্রভাব আজ প্রকৃত রাজনীতিবিদদের মাঠ ছাড়তে বাধ্য করে দল ছুট, ব্যাংক লুটেরা ও ভূমিদস্যুদের স্থান করে দিয়েছে। লুটেরাদের কোনো ধর্ম নাই। যেখানে সুযোগ পায় সেখানেই লুট করে, এখন লুট হচ্ছে দেশের রাজনীতি। রাজনীতিকে এখন রাজনীতি দিয়ে মোকাবেলার সংস্কৃতির অবসান হওয়ায় নীতি-আদর্শের কোনো মূল্য নাই, মূল্যায়িত হচ্ছে টাকা আর টাকা। অর্থই এখন রাজনীতির নিয়ন্ত্রক। রাজনীতি এখন আদর্শে নয়, বরং নির্দেশে চলছে।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন