পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের অর্থনীতি। মাঝেমধ্যে রাজনৈতিক অনিশ্চয়তার ঝড়ের কবলে পড়ে এ অগ্রযাত্রা থমকে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু পরক্ষণেই আবার অর্থনীতির চাকা আগের গতিতে ঘুরতে শুরু করেছে। এভাবে গত ৪৭ বছরে দেশের অর্থনৈতিক সামাজিক সূচকগুলোতে অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে। এটি আরও বেশি হওয়ার সুযোগ ছিল। রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সুশাসনের অভাবের কারণে সেটি হয়নি। মহান মুক্তিযুদ্ধের অব্যবহিত পরে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের তলাবিহীন ঝুড়ি উপাধি পাওয়া দেশটি ৪৭ বছরে বিশ্বে এখন উন্নয়নের রোল মডেল। যে দেশকে শোষণ, বঞ্চনা, নানাবিধ আঘাতে ক্ষতবিক্ষত করেছিল পাকিস্তান, আজ তারাই বাংলাদেশের মতো উন্নয়নের স্বপ্ন দেখে। শুধু তাই নয়, তাদের সংসদেও বাংলাদেশের উন্নয়নের উদাহরণ টানা হয়। অফুরন্ত সম্ভাবনা নিয়ে দেশটি সামনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এখনও রাজনৈতিক অনিশ্চয়তা থেকে মুক্তি মেলেনি। রাজনৈতিক কারণে মাঝেমধ্যেই অর্থনৈতিক গতি থমকে দাঁড়ায়। এ থমকে দাঁড়ান না হলে, সমান তালে অর্থনৈতিক চাকা ঘুরতে থাকলে অগ্রগতি আরও বেশি হতো।
গত ৪৭ বছরে বাংলাদেশের মানুষের উদ্ভাবনী চিন্তা চেতনার বাস্তবায়ন ও উদ্যোগী মনোভাবের কারণে দেশটি অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, সম্পদ উন্নয়ন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, শিশুমৃত্যুর হার কমান, দারিদ্র্য বিমোচন, অর্থনৈতিক সক্ষমতা অর্জন, রফতানি আয়, বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন, বৈদেশিক শ্রমবাজার, কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, জননিরাপত্তা, সামাজিক বৈষম্য নিরসনসহ প্রায় সব সূচকেই পাকিস্তানকে ছাড়িয়েছে বাংলাদেশ। বিশেষ করে সামাজিক ও অর্থনৈতিক সূচকে এশিয়া, আমেরিকা ও আফ্রিকার অনেক দেশকে পেছনে ফেলে বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে। মানুষের গড় আয়ু, শিক্ষার হার, স্বাস্থ্য, দারিদ্র্য বিমোচন এবং মাথাপিছু আয়ে যেসব দেশ বিশ্বে দ্রুত প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। এর মধ্যে নিম্ন মধ্যম আয়ের দেশের স্বীকৃতি পেয়েছে বাংলাদেশ। উন্নয়নশীল দেশের প্রাথমিক স্বীকৃতিও মিলেছে। এখন সেটি আলোর পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৭২-৭৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের মোট জাতীয় বাজেট ছিল ৭৮৬ কোটি টাকা। বর্তমানে তা প্রায় ৪ লাখ ৬৫ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এর মধ্যে রাজস্ব আয় ৩ লাখ ৩৯ হাজার ২৮০ কোটি টাকা। বর্তমানে দেশের মানুষের গড় আয়ু ৭২ বছর। ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশ উন্নত দেশের কাতারে পৌঁছানোর সব রকম প্রস্তুতি রয়েছে। ১৯৭২ সালে দারিদ্র্যের হার যেখানে ছিল ৮৮ শতাংশ, সেখানে আজ এ হার কমে ২১ দশমিক ৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। উন্নয়ন কর্মকান্ডে আগে শতভাগ অর্থ বরাদ্দ করা হতো বৈদেশিক অনুদান থেকে। এখন প্রায় ৬৬ শতাংশ বরাদ্দ করা হয় দেশীয় সম্পদের উৎস থেকে।
জাতি হিসেবে বাংলাদেশিরা অনেক মেধাবী। কিন্তু পাকিস্তান সরকার কোনো সুযোগ দেয়নি। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশে জনসংখ্যা ছিল সাড়ে ৭ কোটি। ওই সময় ৪০ শতাংশ খাদ্য বিদেশ থেকে আমদানি করতে হতো। বর্তমানে জনসংখ্যা প্রায় ১৭ কোটি। কিন্তু খাদ্য আমদানি করতে হয় না। এছাড়া শিল্পখাতের অনেক উন্নয়ন হয়েছে। বর্তমানে গার্মেন্ট শিল্পে বাংলাদেশ বিশ্বে দ্বিতীয় বৃহত্তম। চীনের পরেই আমাদের অবস্থান। একই অবস্থা সেবাখাতেও। বিশ্লেষকদের মতে, বৈষম্যের মাধ্যমে পরিকল্পিতভাবে আমাদের পিছিয়ে রাখা হয়েছিল। জানা গেছে, বতর্মানে বৈদেশিক মুদ্রার যে রিজার্ভ রয়েছে, তা দিয়ে অন্তত ৯ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। এক্ষেত্রে অনেক পিছিয়ে রয়েছে পাকিস্তান। দেশটির রিজার্ভের অর্থ দিয়ে মাত্র ২ মাসের আমদানি ব্যয় মেটানো সম্ভব। ডিজিটাল প্রযুক্তির ব্যবহার এগিয়ে বাংলাদেশ। বর্তমানে বিশ্বের ইন্টারনেট ব্যবহারে শীর্ষ দশে রয়েছে বাংলাদেশের নাম। স্বাধীনতার পর ১৯৭২ সালে দেশের মানুষের মাথাপিছু আয় ছিল ১২৯ ডলার। বর্তমানে তা ১ হাজার ৭৫০ ডলারে উন্নীত হয়েছে। ৫০১ কোটি টাকার বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি আজ ১ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকায় উন্নীত হয়েছে। এগিয়ে গেছে অর্থনৈতিক ও সামাজিক সবগুলো সূচকে।
বাংলাদেশের এ উন্নয়ন দেখতে ২০১৬ সালে বাংলাদেশে এসেছিলেন বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট জিম ইয়ং কিম। ওই সময়ে তিনি বলেছিলেন, শুধু বলার জন্য নয়, দারিদ্র্য বিমোচনে সত্যিই আজ বিশ্বে রোড মডেল। বিশ্বের অন্য দেশগুলো বাংলাদেশে উদাহরণ তুলে ধরছে বিশ্বব্যাংক। মহাকাশে রয়েছে বাংলাদেশের নিজস্ব স্যাটেলাইট। বিশ্বশান্তিতে নোবেল এসেছে বাংলাদেশে। ক্রিকেটেও বিশ্ববাসীর নজর কেড়েছে বাংলাদেশিরা। বিশ্লেষকরা বলছেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের দুটি কারণ। প্রথমত পাকিস্তান থেকে রাজনৈতিক মুক্তি, দ্বিতীয় অর্থনৈতিক মুক্তি। পাকিস্তান আমলে উন্নয়ন থেকে আমরা ছিলাম বঞ্চিত।
অন্যান্য দেশের তুলনায় সামষ্টিক অর্থনীতিতে আমাদের স্থিতিশীলতা সন্তোষজনক। বিখ্যাত সম্পদ ব্যবস্থাপনা প্রতিষ্ঠান গোল্ডম্যান স্যাকস ১১টি উদীয়মান দেশের তালিকায় বাংলাদেশকে অন্তর্ভুক্ত করেছে। ইন্দোনেশিয়া, মালয়েশিয়া, ভিয়েতনাম প্রভৃতি দেশ রয়েছে এ তালিকায়। সামগ্রিকভাবে বাংলাদেশ আরও এগিয়ে যাচ্ছে। ১৯৯১ থেকে ২০১৮ সালে দেশ পরিচালনায় থাকা সরকারের ধারাবাহিক অবদান রয়েছে। স্বাধীনতার মাত্র চার দশকেই বাংলাদেশ অবিশ্বাস্যভাবে এগিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে স্বল্পোন্নত দেশগুলোর মধ্যে বিস্ময়করভাবে এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। ১৯৭১ সালে শোষণ ও বঞ্চনার অবসান ঘটিয়ে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়েছিল বাংলাদেশ। এখনও বাংলাদেশে প্রধান সমস্যা দুর্নীতি। এ দুর্নীতি রোধ করতে হবে। পাশাপাশি সার্বজনীন সুশাসন প্রতিষ্ঠা জরুরি। এ দুটি বিষয় সফলভাবে করতে পারলে বিশ্বে সবক্ষেত্রে রোল মডেল হবে বাংলাদেশ।
আমাদের অর্জন অনেক। অল্প সময়ে আমরা অনেক দূর অগ্রসর হতে পেরেছি। কিন্তু সত্যিকার অর্থনেতিক মুক্তি গণমানুষের তখনও অনেক দূর বাকী রয়েছে। দুইটি বড় সমস্যা আমাদের অগ্রগতির পথকে পিচ্ছিল করে রেখেছে। প্রথমটি হলো দুর্নীতি, ঘুষ ও অনিয়ম। দ্বিতীয়টি হচ্ছে সুশাসনের অভাব। সকলের জন্য সমান শাসন এখনও আমরা রাষ্ট্রে পুরোপুরি চালু করতে পারিনি।
আমাদের উন্নয়নের একটি বড় অংশ দুর্নীতির কারণে গণমানুষ উপকৃত হতে পারছে না। দুর্নীতি, অনিয়ম ও ঘুষ বাণিজ্যের ফলে সমাজে উন্নয়নের যে চেহারা দেখা যাওয়ার কথা তা দেখা যায় না। ঠিক এই উন্নয়ন হচ্ছে না। ক্ষণস্থায়ী অথচ অধিক ব্যয় আমাদের উন্নয়নের মূল চেহারা। এই অবস্থার পরিবর্তনের জন্য দুর্নীতিমুক্ত সমাজ ও রাষ্ট্রের। দুর্নীতি ও মুক্ত সমাজও রাষ্ট্র গড়তে হলে প্রয়োজন সৎ, নিষ্ঠাবান, দুর্নীতিমুক্ত মানুষ। এইটির আমাদের বড় অভাব। এই জন্য রাষ্ট্রকে বড় ভূমিকা গ্রহণ করতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্র থেকে দুর্নীতি দূর করতে হলে রাষ্ট্র পরিচালক সহ সর্বস্তরে রাষ্ট্র পরিচালকদের সৎ, নিষ্ঠাবান দেশ প্রেমিক ও দুর্নীতিমুক্ত চরিত্রের অধিকারী হতে হবে। আমাদের পরিবারের সততা চর্চা করতে হবে। আমাদের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় তথা সমাজের সকল শিক্ষা স্তরে দুর্নীতিমুক্ত পরিবেশ আনতে হবে। পরিবার থেকে শিশুদের সুশিক্ষা দিয়ে সুচরিত্রের অধিকারী করে গড়ে তুলতে হবে।
আর সুশাসনের বড়ই অভাব আমাদের সমাজে। কাগজে-কলমে আমাদের বিচার ব্যবস্থা স্বাধীন, কিন্তু বাস্তবে স্বাধীনভাবে ভালভাবে কাজ করতে পারছে না। বিচার বিভাগের মধ্যে সুশাসনের অভাব রয়েছে। বিচারক নিয়োগ, কর্মকর্তা নিয়োগ থেকে, সকল পর্যায়ে সুশাসনের অভাব রয়েছে।
লেখক: সাবেক সহ সভাপতি এফবিসিসিআই, বিটিএমইএ, বিজিএমইএ, বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় সমিতি, প্রতিষ্ঠতা চেয়ারম্যান ইস্টার্ন ইউনিভার্সিটি
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।