Inqilab Logo

শনিবার ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ০১অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ১৩ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন এবং জাতীয় ঐক্যই হচ্ছে একমাত্র বিকল্প

জামালউদ্দিন বারী | প্রকাশের সময় : ১৯ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:১১ এএম

বিভেদ বিভাজনের রাজনীতি দেশকে দুর্বল করে দেয়। আমাদের মত দেশে অর্থনৈতিক উন্নয়ন, অবকাঠামোগত উন্নয়ন ইত্যাদি লক্ষ্য অর্জনের চাইতেও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে যে কোন মূল্যে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ রাখা। ভিন্নমতের শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান নিশ্চিত করতে বহুদলীয় সংসদীয় গণতন্ত্র একটি মোক্ষম পদ্ধতি। যেখানে আমাদের সংবিধানে জনগণকে রাষ্ট্রের মালিকানার স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল স্পিরিটই হচ্ছে, মানবিক মর্যাদা, সামাজিক ন্যায়বিচার ও বৈষম্যহীন সমাজ প্রতিষ্ঠার অঙ্গিকার। এ কারণেই সংবিধানে মৌলিক মানবাধিকারের পাশাপাশি মত প্রকাশের স্বাধীনতা তথা বাক স্বাধীনতা, রাজনৈতিক কর্মকান্ডে অংশগ্রহণের স্বাধীনতা এবং অর্থনৈতিক মুক্তির গ্যারান্টি দেয়া হয়েছে। রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধে লাখো প্রাণের বিনিময়ে স্বাধীনতা অর্জনের পর সাড়ে চার দশক পেরিয়ে এসে দেশের মালিকরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করছি, আমরা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অঙ্গিকার থেকে ক্রমেই দূরে সরে যাচ্ছি। পাকিস্তান আমল থেকে রাজনৈতিকভাবে নির্বাচিত সরকারের ব্যর্থতা অথবা দুর্বলতার সুযোগ নিয়ে সেনাবাহিনী ও সেনাসমর্থিত অনির্বাচিত কুশীলবদের হাতে বার বার ক্ষমতা দখল হতে আমরা দেখেছি। ১৯৭০ সালে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার অধীনে অনুষ্ঠিত জাতীয় নির্বাচনও অংশগ্রহণমূলক ছিল, জনগণ নির্ভয়ে ভোট দিতে পেরেছিল। নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসনে বিজয়ী দলের নেতার হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরে গড়িমসি করার কারণেই মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতার ডাক অনিবার্য হয়ে পড়েছিল। এছাড়া কখনোই এভাবে জনগণের ম্যান্ডেটকে এমন ম্যানিপুলেটেড ও অপদখল হয়ে যেতে দেখা যায়নি। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের অধিকাংশ রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকা, ১৫৩ আসনে বিনাভোটে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়া এবং অবশিষ্ট আসনে শতকরা ১০-১৫ ভাগ ভোটে নির্বাচিত সরকার দেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি, জননিরাপত্তা, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও আইনের শাসনের প্রত্যাশাকে চরম সংকটের মধ্যে ঠেলে দেয়া হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে, নিজেদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও স্বাধীনতার স্বপক্ষের শক্তি হিসেবে দাবীদার সরকার দেশের মানুষকে একটি অনিবার্য সংঘাতের দিকে ঠেলে দেয়ার মত অপরিণামদর্শি কর্মকান্ডে লিপ্ত হয়েছে। রাষ্ট্রের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ভিন্নমত দমন ও ভিন্নমতের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক নিরাপত্তাহীনতা, অস্থিতিশীলতা ও অনিশ্চয়তার ঘূর্ণাবর্তে ঠেলে দেয়া হয়েছে। কোন দেশের শান্তিকামী, উন্নয়নকামী সরকারের প্রথম ও প্রধান কাজই হচ্ছে, জনমনে আস্থা ও নিরাপত্তার বোধ জাগ্রত করা এবং দলমত নির্বিশেষে দেশের জনশক্তিকে সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের স্বপক্ষে কাজে লাগানোর রাজনৈতিক কর্মকৌশল নির্ধারণ করা। গত একদশক ধরে আমরা বাংলাদেশে এর বিপরীত চিত্রই দেখতে পাচ্ছি। এর ফলে দেশে প্রত্যাশিত বিনিয়োগ হয়নি, আভ্যন্তরীন কর্মসংস্থান হয়নি, বেকারত্ব বেড়েছে, দেশ থেকে লাখ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। দেশের শিক্ষিত তরুণ সমাজের এক বড় অংশ নিজেদের মেধা, মননশীলতা ও কর্মশক্তিকে দেশ ও সমাজের কল্যাণে নিয়োজিত করার বদলে যেনতেন প্রকারে দেশ ছেড়ে অন্য কোন দেশে আশ্রয় নিয়ে নিজেদের কর্মসংস্থান ও অর্থনৈতিক মুক্তির পথ খুঁজতে বাধ্য হয়েছে। সিরিয়া, লিবিয়া, ইয়েমেনের মানুষ প্রাণ বাঁচাতে জীবন বাজি রেখে দেশ ছেড়ে বিপদসঙ্কুল সমুদ্রপথে বিদেশে পাড়ি জমিয়েছে। বাংলাদেশে দৃশ্যত কোন রাজনৈতিক আন্দোলন সংগ্রাম বা যুদ্ধাবস্থা না থাকলেও ভ‚মধ্যসাগরে প্রাকৃতিক দুযোর্গে বা বিদেশী কোস্টগার্ডের হাতে বন্দি হতভাগ্য অভিবাসন প্রত্যাশিদের মধ্যে অনেক বাংলাদেশী নাগরিককেও দেখা গেছে। কয়েক বছর আগে ইউরোপে ইমিগ্রান্ট ক্রাইসিসের সময়ে ইতালী সীমান্তে আটকে পড়া বিদেশী নাগরিকদের মধ্যে বাংলাদেশী তরুণরা প্লাকার্ডে ইংরেজীতে লিখেছিল আমাদেরকে গুলি কর তবু দেশে ফেরত পাঠিও না। এমন দৃশ্য আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে প্রকাশিত ও প্রচারিত হয়েছে। তথাকথিত উন্নয়নের দাবীর সাথে এমন দৃশ্য মেলানো যায় না।
প্রত্যেক জাতির কিছু সুনির্দ্দিষ্ট লক্ষ্য যেমন থাকে, তেমনি সে সব লক্ষ্য অর্জনের কিছু প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিপক্ষ শক্তিও থাকে। এই প্রতিবন্ধকতা ও প্রতিপক্ষকে সুচিহ্নিত করতে না পারলে রাষ্ট্রের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক লক্ষ্য ব্যর্থ হতে পারে। আমরা কি এখন তেমন একটি পরিস্থিতির সম্মুখীন? এমন প্রশ্ন এখন জনমনে ঘুরপাক খাচ্ছে। শান্তিকামী, সমৃদ্ধিকামী মানুষ বিভাজনের রাজনীতি পছন্দ করে না। এ দেশের মানুষ ঐতিহাসিকভাবে বার বার তা প্রমাণ করেছেন। স্বাধীনতা সংগ্রামের আগে ও পরে চুয়ান্ন সালের যুক্তফ্রন্টের নির্বাচন, নব্বইয়ের গণআন্দোলনে এ দেশের মানুষ প্রবল রাষ্ট্রশক্তিকে পরাস্ত করেই বিজয় অর্জন করেছিল। দেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্যারা মিলিটারি ও সামরিক বাহিনীর সদস্যরা এ দেশেরই মাটির সন্তান। সামরিক জান্তা বা অনির্বাচিত সরকার কায়েমী স্বার্থবাদী ও দলবাজ কর্মকর্তাদের নিজেদের অগণতান্ত্রিক স্বার্থে ব্যবহার করলেও আখেরে তারা কখনোই সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের প্রত্যাশার বিরুদ্ধে অবস্থান নেয়নি। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে বাংলাদেশে আরেকবার অভাবনীয় এক জাতীয় ঐক্য সংঘটিত হতে দেখা যাচ্ছে। যে ঐক্যে জিন্দাবাদ, জয়বাংলা একাকার হয়ে গেছে। বঙ্গবন্ধু ও জিয়াউর রহমানের রাজনৈতিক মতাদর্শের বিভাজন ঘুচে আওয়ামী লীগের জোটের বাইরের প্রায় সব রাজনৈতিক দল এক কাতারে সামিল হয়ে গেছে। সংশ্লিষ্টদের দাবী হচ্ছে, দেশের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ এখন জাতীয় ঐক্যের পক্ষে সমর্থন দিচ্ছে, আগামী নির্বাচনে তারই প্রতিফলন ঘটবে। বাংলাদেশে একটি প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন অনুষ্ঠান এবং সেই নির্বাচনে ক্ষমতাসীন সরকারের মেয়াদ প্রলম্বিত করার পেছনে বাংলাদেশ সম্পর্কে ভারতের রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বড় ভ‚মিকা পালন করেছে বলে অভিযোগ রয়েছে। বাংলাদেশে বিভাজনের রাজনীতির প্রতিও ভারতের প্রচ্ছন্ন ভ‚মিকা লক্ষ্য করা গেছে। যেখানে এ দেশের মানুষ বিভাজন-বিভক্তি ও নির্মূলের রাজনীতিকে সমর্থন বা পছন্দ করে না, সেখানে ভারত সরকারের এমন ভ‚মিকা ভারত-বাংলাদেশের পিপলস টু পিপলস সম্পর্কের প্রত্যাশা ও বাস্তবতাকেই সবচেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। গত ১০ বছরে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উন্নয়নের প্রশ্নে ভারতের কংগ্রেস ও বিজেপি সরকারের নীতির মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য না থাকলেও তাদের ভ‚মিকায় একই সঙ্গে ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্ক এবং দুই দেশের জনগণের মধ্যকার বোঝাপড়া অনেক বেশী ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত ভারতের বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি’র বিভাজন-বৈরিতার রাজনীতির বিরুদ্ধে তাদের অবস্থানের জানান দিয়েছে ভারতের জনগণ। নির্বাচনে ৫টি রাজ্যে শক্তিশালী, সংঘবদ্ধ ও প্রবল বিজেপি ,ভিএইপির বিরুদ্ধে তুলনামূলকভাবে অনেক দুর্বল, অংসগঠিত কংগ্রেসের কাছে ধরাশায়ী হয়েছে ক্ষমতাসীনরা। তেলেঙ্গানা, রাজস্থান, মিজোরাম, মধ্যপ্রদেশসহ ৫টি রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে কংগ্রেসের অপ্রত্যাশিত বিজয়কে বিজেপির সাম্প্রদায়িক ও জাতিগত বিভাজনের বিরুদ্ধে ভারতের হিন্দু-মুসলমানের ঐক্য ও সহাবস্থানের রাজনীতির বিজয় বলে মনে করছেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। বিজেপির মুসলিম বিদ্বেষী ও বিভাজনের রাজনীতি, গোরক্ষার নামে মুসলমানদের উপর আগ্রাসন, আসামসহ উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় প্রদেশগুলো থেকে কথিত অবৈধ বাঙ্গালীদের বিতাড়নের ঘোষণার মত রাজনৈতিক কর্মসূচিকে সমর্থন করছে না ভারতের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনগণ। বাংলাদেশেও প্রায় একই রকম পরিস্থিতি বিদ্যমান। তবে ভারতে নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষ ভ‚মিকা নির্বাচনকে পক্ষপাতদুষ্ট বা বিতর্কিত হতে দেয় না। বাংলাদেশে এবারের নির্বাচন একদিকে দলীয় সরকারের অধীনে অংশগ্রহণমূলক, স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন সম্ভব এবং তাদের উপর আস্থা রাখতে ক্ষমতাসীনদের দাবীর বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ, অন্যদিকে দেশের নির্বাচন ও রাজনৈতিক সংস্কৃতি, নির্বাচন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর নিরপেক্ষতা ও জনগণের অভিপ্রায়ের পক্ষে আইনানুগ অবস্থান নিশ্চিত করা, সুশাসন ও জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার পক্ষে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের প্রতিশ্রæতি বাস্তবায়নের চ্যালেঞ্জ।
ইতিমধ্যে প্রকাশিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের ১৪ দফা নির্বাচনী ইশতেহারে বিভেদ বিভাজন পরিহার করে সবক্ষেত্রে জাতীয় ঐক্য গড়ে তোলার প্রতিশ্রুতি স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রথম দফার শিরোনাম দেয়া হয়েছে, প্রতিহিংসা বা জিঘাংসা নয় জাতীয় ঐক্যই লক্ষ্য। এমনকি রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ও পরাজিত প্রার্থীদেরকেও পরোক্ষভাবে ক্ষমতা রাজনৈতিক অংশীদার করার অঙ্গিকার করা হয়েছে। যেখানে সরকারী দলের শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের কেউ কেউ ক্ষমতার হারানোর পর একদিনেই লাখো মানুষের হত্যাকান্ডের শিকার হওয়ার আশঙ্কার কথা বলছেন, সেখানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নিরাপত্তা ও সহাবস্থানের নিশ্চয়তা দিচ্ছে। ‘নাগরিকদের নিরাপত্তা ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা’ শিরোনামের দফাটি দ্বিতীয় স্থান লাভ করেছে। এ দেশের গণতন্ত্রকামী, শান্তিপ্রিয় মানুষ জাতির প্রয়োজনে জীবন বাজি রেখে শত্রæর মোকাবেলা করতে পিছপা হয় না, আমাদের স্বাধীনতার ইতিহাসই তার সাক্ষী। স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীকে সামনে রেখে, স্বাধীনতার লক্ষ্য থেকে বিচ্যুত হওয়ার বাস্তবতায় জাতীয় গৌরব ¤øান হয়ে যায়, বিভেদ বিভাজনের রাজনীতির বিরুদ্ধে সংক্ষুব্ধ হয়ে মানুষ একটি জাতীয় ঐক্যের প্লাটফর্ম দেখতে চায়। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে জনগণের সে ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটবে বলেই সাধারণ মানুষের প্রত্যাশা ছিল। জনপ্রত্যাশা ও গণরায়কে ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার যে রাজনৈতিক কৌশল ক্ষমতাসীরা গ্রহণ করেছে তা’ এখন অনেকটাই ওপেন সিক্রেট। নির্বাচনের প্রক্রিয়া ও তফসিল ঘোষণার শুরুতেই আইন শৃঙ্খলা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন ও সরকারী দলের নেতাকর্মীদের বেপরোয়া একপাক্ষিক ভ‚মিকা স্পষ্ট হয়ে যায়। আল জাজিরা টেলিভিশন এ পরিস্থিতিকে বাংলাদেশে আবারো একটি নিয়ন্ত্রিত ও একপাক্ষিক নির্বাচনের আলামত বলে প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে। গত ১৩ ডিসেম্বর নিউ ইয়র্ক ভিত্তিক হিউম্যান রাইটস ওয়াচের রিপোর্টে বাংলাদেশে নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধীদলের প্রার্থী ও কর্মী-সমর্থকদের উপর পুলিশের ক্রাক-ডাউনের চিত্র তুলে ধরা হয়েছে। সেই সাথে তুলে ধরা হয়েছে হাজার হাজার গায়েবী মামলার কিঞ্চিত ফিরিস্তি। কথিত নাশকতার মামলায় বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মীকে গ্রেফতার-হয়রানির যে চিত্র বছরের শুরু থেকেই চলছে, নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর তা আরো বেড়ে গেছে। কথিত ঘটনা সংঘটিত হওয়ার সাতদিন বা এগারো বছর আগে মৃত জসিমুদ্দিন বা মিন্টু কুমার দাস কীভাবে নাশকতার মামলার আসামী হয়ে যায় হিউম্যান রাইটস ওয়াচ তারও বর্ণনা দিয়েছে। মানুষের মত প্রকাশের স্বাধীনতা নিয়ন্ত্রণের জন্য ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত ব্যবস্থা আগেই করে রাখা হয়েছে। এখন নির্বাচনের প্রাক্কালে হাজার হাজার মামলার লাখ লাখ অজ্ঞাতনামা আসামীর একজন অথবা আগের মামলায় বিএনপির প্রার্থীদের গ্রেফতার করা হচ্ছে বলেও হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। বাংলাদেশের নাগরিক সমাজ একটি স্বচ্ছ, অবাধ, নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য ১০ বছর ধরে প্রহর গুনছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পাশাপাশি চীন-ভারতের মত আঞ্চলিক শক্তিগুলোও একটি ক্রেডিবল ইলেকশন দেখতে চায়। ভারত ছাড়া সব দেশ এবং বাংলাদেশের নাগরিক সমাজের বড় অংশ বিভেদ বিভাজনের রাজনীতি পরিহার করে ঐক্য ও সহাবস্থানের রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে তোলার পক্ষে মত দিয়েছে। জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সেই প্রত্যাশারই সামাজিক-রাজনৈতিক রূপায়ণ।
আজকের বিশ্বব্যবস্থায় যে বিশৃঙ্খলা, যুদ্ধ ও নিরাপত্তাহীনতা দেখা যাচ্ছে, তার মূলে রয়েছে রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বৈষম্য, বিভাজন ও অনৈক্যের রাজনীতি। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র থেকে মধ্যপ্রাচ্য ও দক্ষিণ এশিয়ায় মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক হানাহানি, গণহত্যার মত নৃসংশ ঘটনাগুলোর সাথেও রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক বিভেদ-বৈরিতার ভ‚মিকা সুস্পষ্ট। আরব ইসরাইল সংঘাত ও সংকটের প্রশ্নে মার্কিনীদের দৃষ্টিভঙ্গি, মিয়ানমারে রোহিঙ্গা গণহত্যা ও এথনিক ক্লিনজিং এবং বাংলাদেশের উপর ভারতের বেপরোয়া আগ্রাসী নীতির বিরুদ্ধে বাংলাদেশের দুর্বল অবস্থানের পেছনেও বিভেদ-বিভাজনের রাজনীতি মূখ্য ভ‚মিকা রাখছে। বিভেদ, বৈরিতা, আঞ্চলিক ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্যই হচ্ছে সবেচেয়ে মোক্ষম ও শক্তিশালী অস্ত্র। সাম্প্রতিক সময়ের সিরিয়া এবং বাংলাদেশ তার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে। মিয়ানমারের বৌদ্ধ সন্ত্রাসী এবং সামরিক বাহিনীর পৈশাচিক নিধনযজ্ঞের শিকার প্রায় ১০ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়ার পর ইউরোপীয় ইউনিয়ন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাবিশ্ব, তুরস্ক এবং মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মত আসিয়ানভুক্ত দেশ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ালেও রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তন ও পুর্নবাসনে মিয়ানমারকে বাধ্য করা যাচ্ছে না। উপরন্তু মিয়ানমার বাহিনী বার বার বাংলাদেশের সীমান্ত লঙ্ঘন করেছে, বাংলাদেশের বিরুদ্ধে উস্কানিমূলক কথাবার্তা বলেছে। বাংলাদেশের পাল্টা ব্যবস্থা ও ক‚টনৈতিক তৎপরতা খুবই দুর্বল বলে প্রতীয়মান হয়েছে। এ ক্ষেত্রে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা ও শান্তিপূর্ণ রাজনৈতিক সহাবস্থানের প্রশ্নে চরম বৈরিতা ও নাজুক আভ্যন্তরীণ অবস্থাই বাংলাদেশের জন্য সবেচেয়ে বড় দুর্বলতা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে। পক্ষান্তরে সিরিয়ায় রিজিম পরিবর্তনের লক্ষ্যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইসরাইল, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, সউদি আরবসহ আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পরাশক্তিগুলোর একাট্টা ভ‚মিকার পরও সিরিয়াকে পরাভ‚ত করতে না পারার পেছনে রাশিয়া ও ইরানের সামরিক সহায়তার পাশাপাশি সিরিয়ার জনগণের ঐক্যবদ্ধ অবস্থানই তাদের মূল শক্তি হিসেবে কাজ করছে। গত ৫ বছরের যুদ্ধে সিরিয়ার বহু প্রাচীন ঐতিহ্যে সমৃদ্ধ শহর ও জনপদ ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ নিহত হয়েছে কোটি মানুষ গৃহহারা হয়েছে। যদিও সিরিয়া যুদ্ধ এখনো চলছে, পশ্চিমা বিশ্বের কোন কোন রাজনৈতিক বিশ্লেষক যুদ্ধে সিরিয়ার বিজয় অর্জিত হয়েছে বলে মনে করছেন। মার্কিন লেখক-সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক আন্দ্রে ভিচেক সাম্প্রতিক লেখা একটি নিবন্ধের শিরোনাম দিয়েছেন, ‘ইন সিরিয়া এনটায়ার নেশন মোবিলাইজড অ্যান্ড অউন’। ইরাক, লিবিয়া ও আফগানিস্তানের মত কথিত বিদ্রোহী ও সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসনে সিরিয়া ভেঙ্গে পড়েনি, নতজানু হয়নি। ভিচেক মনে করেন, অটল নেতৃত্ব এবং পুরো জাতির ঐক্যবদ্ধ, একাট্টা ভ‚মিকাই তাদেরকে এমন অজেয় শক্তিতে পরিণত করেছে। ৫ বছর ধরে বিদ্রোহী, সন্ত্রাসী ও প্রক্সি বাহিনীর সব রকম রসদ যোগানোর পাশাপাশি পশ্চিমা গোয়েন্দা সংস্থা ও সামরিক বাহিনী অব্যাহত আগ্রাসন চালিয়েও বাশার আল আসাদ সরকারের পতন নিশ্চিত করতে পারেনি। বিদ্রোহীদের নিয়ন্ত্রিত প্রায় শহর ও জনপদ সিরীয় বাহিনী ইতিমধ্যেই পুনরুদ্ধার করে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হয়েছে। সিরিয়ার শত শত শহর ও জনপদকে ধ্বংসস্ত‚পে পরিণত হলেও সিরিয় জনগণের ঐক্য ও মনোবল ভেঙ্গে যায়নি। তারা সাম্রাজ্যবাদী
বাদীদের রিজিম পরিবর্তনে সাড়া দেয়নি। কারণ তারা দেখেছে, সাম্রাজ্যবাদীদের পাতা ফাঁদে পা দেয়ার পর ইরাক ও লিবিয়ার কি দশা হয়েছে। অন্যদিকে আফগান মুজাহিদ ও তালেবানরা কখনোই পশ্চিমাদের সাথে আপস না করে যুদ্ধ চালিয়ে গেছে বলেই মার্কিন বাহিনী এখন তালেবানদের সাথে সংলাপ ও চুক্তি করে নিরাপদে দেশে ফিরে যাওয়ার পথ খুঁজছে। রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও আঞ্চলিক-আন্তর্জাতিক বাস্তবতায় বাংলাদেশ এখন যে অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে। জাতীয় ঐক্য ও রাজনৈতিক সমঝোতার মধ্য দিয়ে তা থেকে উত্তরণের প্রয়াস সফল না হলে আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদী গ্যাঁড়াকল থেকে বের হয়ে সম্ভাবনার নতুন বাংলাদেশের স্বপ্ন বাস্তবায়নের আর কোন পথ খোলা নেই। শান্তিপূর্ণভাবে জনগণের ব্যাপক অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে স্বচ্ছ ও বিশ্বাসযোগ্য একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সে পথের সম্ভাবনা খুলে দিতে পারে।
[email protected]



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন