পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আগ্রাসী ইসরাইল স্বাধীন ফিলিস্তিনের আসল মানচিত্র যেভাবে ওলট-পালট করে চলছে এবং সেখানকার মুসলমানদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে তাদের পিতৃভূমি ছাড়া করে উদ্বাস্তুতে পরিণত করছে এবং নতুন নতুন ইহুদি বসতি স্থাপন করে সমগ্র ফিলিস্তিনকে কুক্ষিগত করার আগ্রাসী তৎপরতা অব্যাহত রেখেছে, ইতিহাসের তা এক ঘৃণ্যতম অধ্যায়। ইসরাইল আন্তর্জাতিক আইনেরও তোয়াক্কা করে না, জাতিসংঘ ঘোষিত সকল প্রস্তাব-সিদ্ধান্ত অমান্য করে ফিলিস্তিনিদের ওপর যে মানবতা বিরোধী অকথ্য অত্যাচার-নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে এবং পরাশক্তিবর্গের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সর্বপ্রকারের মদদ-সহযোগিতায় গোটা ফিলিস্তিনকে পদানত করে মধ্যপ্রাচ্যে আগ্রাসী থাবা বিস্তারের স্বপ্ন দেখছে, তা মুসলমানগণ বৃহত্তর ঐক্যের মাধ্যমে নস্যাৎ করে দিতে সক্ষম। জেরুজালেমকে ইসরাইলের রাজধানী করার সর্বশেষ উদ্যোগও ব্যর্থ করে দিতে পারে। ফিলিস্তিনের গ্র্যান্ড মুফতি মরহুম সৈয়দ আমিন আল হোসাইনী জীবিত থাকলে ইসরাইলি ইহুদিরা এত দুঃসাহস দেখাতে পারত না। তাঁর বিদেহী অত্মার কান্না শোনার কেউ কি আছে? তবুও তাকে স্মরণ করতে হয়। আজ ফিলিস্তিনের এবং ফিলিস্তিনিদের করুণ অবস্থায় তার মতো সুযোগ্য, আত্মত্যাগী দূরদর্শী নেতার বড়ই প্রয়োজন ছিল। ফিলিস্তিনিদের দুর্ভাগ্য, তিনি এখন বেঁচে নেই। তাই তাঁর সংগ্রামের কিছু কথা স্মরণ করা দরকার।
১৯১৭ সালের নভেম্বর মাসে বেলফোর ঘোষণার মাধ্যমে ফিলিস্তিনকে বিভক্ত করে তথাকথিত ইসরাইলি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধে ফিলিস্তিনি আরবদের মধ্যে যে গণআন্দেলনের সূচনা হয়েছিল তার অগ্রভাগে থেকে যারা নেতৃত্ব দান করেছিলেন তাদের মধ্যে মুফতী সৈয়দ আমীন আল হোসাইনীর নাম বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। আজীবন তিনি এ আন্দোলনের পুরোধা হিসেবে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে গিয়ে কেবল জেল-জুলুমই ভোগ করেননি, অধিকাংশ সময় তাকে প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশে পলাতক জীবন যাপনও করতে হয়েছে। মরহুম ইয়াসির আরাফাতের ঐতিহাসিক মুক্তি সংগ্রামের প্রারম্ভকালেও মুফতী আমীন আল হোসাইনীর নেতৃত্বে কোনো ভাটা পড়েনি, ফিলিস্তিনের ধর্মীয় নেতা হিসেবেও তিনি ছিলেন ফিলিস্তিনিদের অতি প্রাণপ্রিয় আধ্যাত্মিক গুরু এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন মুসলিম মুরুব্বী। ফিলিস্তিন আন্দোলন ও মুক্তি সংগ্রামের দুই দিকপাল ছিলেন মুফতী আমিন আল হোসাইনী এবং ইয়াসির আরাফাত।
অত্যন্ত সম্ভ্রান্ত সৈয়দ বংশের কৃতি সন্তান গ্র্যান্ড মুফতী সৈয়দ আমীন আল হোসাইনী ছিলেন বিশ শতকের আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন এক সংগ্রামী, ধর্মীয় এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। সারা জীবন তিনি ফিলিস্তিনকে আগ্রাসী সম্রাজ্যবাদী চক্র ও ইহুদিদের কবল হতে মুক্ত করার সংগ্রামে লিপ্ত ছিলেন। এই ক্ষণজন্মা পুরুষের জন্ম হয় ১৮৯৩ সালে ঐতিহাসিক পবিত্র নগরী জেরুজালেমে। বংশ মর্যাদার দিক দিয়েও তিনি ছিলেন সম্ভ্রান্ত। তাঁর পিতার নাম তাহেরুল হোসাইনী এবং দাদার নাম মোস্তফা। ফিলিস্তিনে তৎকালে মুফতির পদটি ছিল অতি সম্মানী। তাঁর পরিবারের সদস্যগণ বহুবার এই পদের অধিকারী হয়ে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব পালন করেছিলেন। ১৯২১ সালের পূর্বে তাঁর পরিবারের তিন জনই ছিলেন মুফতী। তাছাড়া কয়েকজন রাষ্ট্রের বিভিন্ন উচ্চ পদ অলংকৃত করেছিলেন। তিনি গ্র্যান্ড মুফতীর সর্বোচ্চ পদও লাভ করেন। তাঁর জীবন ছিল বৈচিত্র্যময় ও ব্যতিক্রমী।
মুফতী সৈয়দ আমীন আল হোসাইনীর শিক্ষাজীবন শুরু হয় পবিত্র জন্মভূমি জেরুজালেমে। প্রথমে তিনি স্থানীয় মুসলিম বিদ্যালয়ে এবং পরে জেরুজালেমের উসমানীয় রাষ্ট্রীয় বিদ্যালয়ে ফরাসী ভাষা শিক্ষা করেন। ১৯১২ সলে কায়রো গমন করে আল আজহার বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি হন। কিন্তু নানা কারণে সেখানে তিনি এক বছরের বেশি অধ্যায়ন করতে পারেননি। এ সময় তিনি পবিত্র হজে¦ গমন করেন। অতঃপর জন্মভূমি জেরুজালেমে প্রত্যাবর্তন করেন। শুরু হয় প্রথম মহাযুদ্ধ। তিনি এসময় উসমানীয় সেনাবাহিনীতে যোগদান করেন। একই সময়ে তিনি এই বিষয়ে অধিকতর শিক্ষা লাভ করেন। তিনি যখন ইজমিরে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিলেন তখন উসমানীয় কর্মকর্তার প্রতীকরূপে ‘তারবুশ’ পরিধান করার অনুুুুুুুুুুমতি লাভ করেন। যুদ্ধের পর তিনি জেরুজালেমে প্রত্যাবর্তন করেন এবং ১৯ বছর তিনি সেখানেই কর্মতৎপরতা অব্যাহত রাখেন। তিনি একজন শিক্ষক, অনুবাদক ও সরকারি কর্মচারী রূপে কাজ করেন। অচিরেই তিনি সাংবাদিকতা ও রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডের সাথে জড়িয়ে পড়েন এবং ইহুদি বিরোধী আন্দোলনের নেতৃত্ব দান করেন। ১৯২১ সালে মুফতী কামেল আল হোসাইনীর ইন্তেকালের পর মে মাসে তাঁকে এই পদ প্রদান করা হয়। একই সালে তিনি ইহুদি বসতি স্থাপনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ এবং আরব সরকার প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। ১৯৩১ সালে জেরুজালেমে একটি প্যান ইসলামী সম্মেলন আহ্বান করেন। ১৯৩৭ সালে ইহুদি বিরোধী দাঙ্গায় প্রেরণা যোগাবার অপরাধে তাঁকে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। কিন্তু তিনি লেবাননে পলায়ন করতে সক্ষম হন এবং পরে ইরাকে গমন করেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বার্লিন বেতার কেন্দ্র হতে নাৎসী প্রচার কার্য চালানোর দায়ে তাঁকে যুদ্ধ অপরাধীদের তালিকাভুক্ত করা হয়। কিন্তু ১৯৪৬ সালে তিনি মিসরে ও পরে পাকিস্তানে আশ্রয় লাভ করেন।
ফিলিস্তিনে বৃটিশ ও ইহুদি সম্রাজ্যবাদীদের বিরুদ্ধে দীর্ঘকাল সংগ্রামে লিপ্ত, আরব উচ্চ পরিষদের প্রেসিডেন্ট এবং রাবেতায়ে আলমে ইসলামীর সদস্য গ্রান্ড মুফতী সৈয়দ আমীন আল হোসাইনী তাঁর সংগ্রামী জীবনের উপর একটি গ্রন্থ রচনা করেন তাঁর শেষ জীবনে। এতে তিনি তাঁর হিজরতের কারণ, তাঁর বিরুদ্ধে ভিত্তিহীন অভিযোগ, ১৯৩৬ সালের বিদ্রোহ, ফিলিস্তিন বিভক্তির প্রস্তাব, প্রতিশ্রুতি ও হুমকী, সশস্ত্র হামলা, হিজরতের সিদ্ধান্ত, পলায়ন কাহিনী রচনায় ডেইলী এক্সপ্রেস কর্তৃক কুঁড়ি হাজার ডলার প্রদানের প্রতিশ্রুতি, আরবদের পক্ষ হতে ফিলিস্তিন বিভক্তির বিরোধিতা, জাতিসংঘের বিভক্তি প্রস্তাব, ১৯৩৭ সালে বলুদান সম্মেলন, লেবাননে অবস্থানকালে পুলিশের হানা, দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধকালে ইংরেজদের দাবি, ১৯৩৯ সালে লেবানন ত্যাগের সময় দুটি বিস্ময়কর ঘটনা, লেবানন ত্যাগ, মরু বাহিনীর কবলে, ইরাকি প্রধানমন্ত্রী নূরী আস সাঈদের উদ্বেগ, নিরপেক্ষ নীতি, ইংরেজদের প্রতিবাদ, বৃটিশ উপদেষ্টার ষড়যন্ত্র এবং ইহুদি ষড়যন্ত্র ইত্যাদি বহু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় স্থান পেয়েছে। ১৯৫১ সালে তিনি করাচীতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব মুসলিম কনফারেন্সে সভাপতিত্ব করেন। বান্দুং সম্মেলনে ফিলিস্তিনি আরবদের প্রতিনিধিত্ব করেন। ১৯৪৮ সালের সেপ্টেম্বর মাসে তিনি একটি ফিলিস্তিনি সরকার গঠন করেন এবং তাঁকে এই সরকারের প্রেসিডেন্ট করা হয়। তিনি ছিলেন ইহুদিদের বিরুদ্ধে আরব প্রতিরোধের প্রতীক। দ্বিতীয় বিশ^যুদ্ধের পর তিনি প্রথমে ১৯৪৫-১৯৪৬ সালে প্যারিসে এবং তারপর পুনরায় মধ্যপ্রাচ্যে-মিসরে গমন করেন। সর্বোচ্চ মুসলিম শরীয়া পরিষদ ‘আল মজলিশ আশ শরয়ী আল ইসলামী আল আলা’র প্রধান হিসেবে তিনি এই পদে আজীবন বহাল থাকেন। ১৯৪২ সালের ১১ নভেম্বর তিনি বলেছিলেন, ‘কেবল যখন বৃটিশ ও তার মিত্রবর্গ ধ্বংস হবে তখনই আমাদের মারাত্মক বিপদ ইহুদি সমস্যার চূড়ান্ত সমাধান সম্ভব হবে।’
ফিলিস্তিনের এই মহানায়কের জীবদ্দশায় আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের বিষফোঁড়া তথাকথিত ইহুদি রাষ্ট্র ইসরাইল প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাধ্যমে যে মারাত্মক বিপদ-সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার চূড়ান্ত সমাধান কবে হয় তা কেউ বলতে পারে না। গ্রান্ড মুফতী সৈয়দ আমীন আল হোসাইনী ১৯৭৪ সালের ৪ জুলাই বৈরুতে ইন্তেকাল করেন। তাঁর সংগ্রামী জীবনাদর্শের কথা স্মরণ করে আজও ফিলিস্তিনে মজলুম মুসলমানগণ ঐক্যবদ্ধভাবে আগ্রাসী ইসরাইলের বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।