পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
দেশজুড়ে ভোটের হাওয়া বইতে শুরু করলেও নির্বাচনী খেলার মাঠ সমতল হয়নি। নির্বাচনী মাঠে এখন সবচেয়ে আলোচিত বিষয় হচ্ছে লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড। ক্ষমতাসীন দলের নেতাকর্মী ও দলবাজ বুদ্ধিজীবিদের মতে, লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড সন্তোষজনক। অথচ প্রশাসন থেকে শুরু করে সর্বত্রই ক্ষমতাসীন দলের দাপটে সুষ্ঠু ভোটের সংশয় বেড়েই চলছে। নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর জনগণের ধারণা ছিল, সুষ্ঠু ভোটের সম্ভাবনা হয়তো দেখা দিতে পারে। কিন্তু দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই নির্বাচনী আচরণবিধি লঙ্ঘনে ক্ষমতাসী দল চ্যাম্পিয়ান হচ্ছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড রাজনৈতিক দলগুলো প্রত্যাশা করলেও লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড জোর যার মুল্লুক তার নীতিতে পরিণত হচ্ছে। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের নামে আমরা যা দেখছি তা সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য মোটেও সহায়ক নয়। কেননা তফসিল ঘোষণার পরও বিরোধীদলের সম্ভাব্য প্রার্থী এবং হাজারো নেতাকর্মীদের জেলে পাঠানো অব্যাহত রয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন যত ঘনিয়ে আসছে ততই লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের বিষয়টি উপেক্ষিত হচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর জোর দাবি থাকা সত্তে¡ও নির্বিকার নির্বাচন কমিশন। তফসিল ঘোষণার পর থেকে অদ্যাবধি নির্বাচন কমিশন পক্ষপাত্বিহীন থেকেছে এমন নজির জাতির সামনে উপস্থাপন করতে পারেনি। জনগণের প্রতিনিধি নির্ধারণের একমাত্র গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা হচ্ছে নির্বাচন। পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ সর্বাধিক নির্বাচনমুখী। বাংলাদেশের জনগণ গণতান্ত্রিক অধিকার আদায় করার জন্য নিজের জীবন বিলিয়ে দিতে কুণ্ঠাবোধ করেনি। অথচ স্বাধীনতার ৪৬ বছর পেরিয়ে গেলেও কাক্সিক্ষত মানের গণতান্ত্রিক পরিবেশ দেশে বিরাজ করছে না। দেশে প্রথমবারের মতো দলীয় সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচন হতে যাচ্ছে। এ নির্বাচন দেশের গণতান্ত্রিক রাজনীতির জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। কারণ, গত তিন দশক ধরে নির্বাচনের পদ্ধতি নিয়ে চলমান রাজনৈতিক মতবিরোধ উত্তরণের সুযোগ সৃষ্টি হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিতে পারে যদি নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষভাবে অর্পিত দায়িত্ব পালন করতে পারে। সারা বিশ্বের গণতন্ত্রমনা মানুষ অধীর আগ্রহে বাংলাদেশের নির্বাচনের দিকে চেয়ে আছে। এবারের নির্বাচন কলংকিত হলে শুধু রাজনৈতিক দলগুলো ক্ষতিগ্রস্থ হবে তা কিন্তু নয়! ক্ষতিগ্রস্থ হবে ৫৬ হাজার বর্গমাইলের মানুষ।
আমাদের দেশে দলীয় সরকারের অধীনে সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ইতিহাস সুখকর নয়। কারণ, যারাই ক্ষমতায় থেকে নির্বাচনের আয়োজন করেছে তারাই জনগণের ভোটের অধিকার ভুলণ্ঠিত করেছে। হ্যাঁ না ভোটের কথা আজকের তরুণ প্রজন্ম না জানলেও গায়েবি ভোটের নির্বাচন দেখেছে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। একটি সুষ্ঠু অবাধ নিরেপেক্ষ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সব দলের অংশগ্রহণ ও নির্বাচন কমিশনারের অপক্ষপাতমূলক ভূমিকা জরুরি। কারণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় সুষ্ঠু অবাধ নিরপেক্ষ নির্বাচনের বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের জনগণ নির্বিঘেœ ভোট দিতে চাইলেও স্বৈরতান্ত্রিক শাসকেরা জনগণের ভোটের অধিকার হরণ করতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তারা চায় যেনতেন নির্বাচনের মাধ্যমে ক্ষমতায় টিকে থাকতে। কিন্তু ইতিহাস সাক্ষী, ভোটের অধিকার কেড়ে নিয়ে কেউ আজীবন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। যে দেশে গণতান্ত্রিক পরিবেশ বিরাজ করে না সেখানে সুষ্ঠু ভোট কিংবা সমতল নির্বাচনী খেলার মাঠ প্রত্যাশা করা যায় না। ক্ষমতাসীনরা সমতল মাঠে খেলতে পছন্দ না করলেও অসমতল মাঠে খেলতে বড্ড পছন্দ করে। তারা জানে অসমতল মাঠে বিশ্বচ্যাম্পিয়ানরাও হেরে যায়। আর দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন হলে ক্ষমতাসীনরা এত বেশি পেনাল্টি পায় যে প্রতিপক্ষ মাঠে থাকলেই কী আর না থাকলেই কী! তখন প্রতিপক্ষ কেবল লালকার্ড পায়। আর ক্ষমতাসীন দল ফ্রি কিক পায় ডি বক্সের সামনে। নির্বাচনের মাঠে খেলোয়াড় আওয়ামী সরকার বনাম ঐক্যফ্রন্ট। নির্বাচন কমিশন হচ্ছে রেফারি। নিরপেক্ষ রেফারির দায়িত্ব পালন করার কথা থাকলেও নির্বাচন কমিশন নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে পারছে না। সুষ্ঠু, অবাধ, নিরপেক্ষ ও সবার কাছে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানে নির্বাচন কমিশনের ভূমিকা অপরিসীম। নির্বাচন কমিশন সাংবিধানিকভাবে স্বাধীন হলেও বাস্তবে কতটুকু স্বাধীন তা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে নির্বাচন কমিশন ইচ্ছে করলে ভোট কারচুপি, ভোটকেন্দ্র দখল, ব্যালট ছিনতাই কিংবা সিলমারা প্রতিরোধ করতে পারে। আমাদের দেশে দৃঢ়-ঋজু নির্বাচন কমিশনের যেমন উদাহরণ আছে, তেমনি সরকারের কাছে নতজানু নির্বাচন কমিশনেরও দৃষ্টান্ত আছে। নির্বাচন কমিশন সত্যিকার অর্থে নির্ভয়ে দায়িত্ব পালন করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হলে যে সরকারই ক্ষমতায় থাকুক না কেন নির্বাচন অবাধ সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হতে বাধ্য।
পৃথিবীর যে কোনো দেশের তুলনায় বাংলাদেশের মানুষ সর্বাধিক নির্বাচনী উৎসবে আনন্দে মাতোয়ারা থাকে। গাঁও-গেরাম থেকে শুরু করে অফিস-আদালত, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান সর্বত্র নির্বাচনী আমেজ বিরাজ করে। এবারের নির্বাচন অতীতের যে কোনো নির্বাচনের তুলনায় সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ। কারণ এই প্রথম একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন হতে যাচ্ছে যেখানে পার্লামেন্টের ৩৫০ জন এমপি স্বপদে বহাল থেকে নির্বাচনে প্রতিদ্ব›িদ্বতা করবে। সে কারণে জনগণের মধ্যে একধরনের ভয় কাজ করছে। এমনকি তফসিল ঘোষণার পরও বেশির ভাগ থানায় আগের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রয়েছেন। তারা দলীয় সরকারের অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবে এমনটি ভাবা যায় না। ইতোমধ্যে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী নির্বাচনে দায়িত্ব পালন করতে পারে এমন সম্ভাব্য কর্মকর্তাদের ব্যাপারে খোঁজখবর নিচ্ছে। এমতাবস্থায় সুষ্ঠু নির্বাচনের স্বার্থে সমতল মাঠ এবং মন্ত্রী-এমপিদের পছন্দের ইউএনও ও ওসিদের বদলি করা প্রয়োজন। কারণ ক্ষমতাসীনরা গত দশ বছরে এমন কোনো সেক্টর নেই যেখানে দলীয় বলয় সৃষ্টি করেনি। নির্বাচন কমিশনের অদক্ষতা ও পক্ষপাতমূলক আচরণের কারণে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার নজির তো আমাদের দেশে আছে। এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ হচ্ছে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন। তফসিল ঘোষণার পরও আইনপ্রয়োগকারী বাহিনী দলীয়বাহিনীর মতো আচরণ করছে। বিরোধীদলীয় নেতাকর্মীদের গণহারে গায়েবি মামলা দিয়ে গ্রেফতার করছে। অথচ ক্ষমতাসীন দলের দলীয় কোন্দলে রাজধানীর মোহাম্মদপুরে দু’জন নিহত হলেও পুলিশ নির্বিকার। পুলিশ বাহিনীর পক্ষপাতমূলক আচরণ অব্যাহত থাকলে সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠান করা সম্ভব হবে না। দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হয় না বলেই কেয়ারটেকার সরকারের দাবিতে আন্দোলন গড়ে তোলা হয়েছিল। ১৯৯৫-৯৬ সালে তৎকালীন সরকার সে দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছিল। এর ফলে সংবিধানে সংযোজিত হয়েছিল নির্বাচনকালীন কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতি। তৎকালীন বিরোধী দল আজকের ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ কেয়ারটেকার সরকার পদ্ধতির বিধান সংবিধানে সংযুক্ত করতেই নৈরাজ্যের পথ বেছে নিয়েছিল। অথচ তারাই আবার ক্ষমতার মোহে অন্ধ হয়ে কেয়ারটেকার সরকার ব্যবস্থাকে বাতিল করে দিয়েছে। কারণ কেয়ারটেকার ব্যবস্থা নাকি সংবিধানের সাথে সাংঘর্ষিক। তর্কের খাতিরে ধরে নিলাম সাংঘর্ষিক। তাই বলে কি এমন একটি পদ্ধতি বের করা যেত না, যা সবার কাছে গ্রহণযোগ্য হবে?
লেভেল প্লেয়িং কোথায় আছে? পোস্টার দেখলেই তো বোঝা যায়। রাজধানীর এমন কোনো স্থান নেই যেখানে নৌকার বিল বোর্ড, পোস্টার বা ব্যানার পাওয়া যাবে না। রাজধানীর অধিকাংশ কমিশন কার্যালয়ে নৌকার প্রচার অবিরাম চলছে। এমনকি সরকারি অফিসের সামনেও নৌকার পক্ষে ভোট চেয়ে লাগানো বিলবোর্ডগুলো এখনো দৃশ্যমান। আওয়ামী লীগ কারও সমালোচনা সহ্য করতে পারে না। ক্ষমতায় আসার পর তারা যে লুণ্ঠন ও লুটপাট করেছে তা লিখলে সমাপ্তি টানা যাবে না। সরকারের তল্পিবাহকেরা ভাঙা রেকর্ডের মতো উন্নয়নের আফিমে জাতিকে বুদ রেখে বিভ্রান্ত করছে। তাদের মুখে উন্নয়নের শ্লোগান যেভাবে মুখরিত হয় সেভাবে যদি নির্বাচনী সমতল মাঠের শ্লোগান শোনা যেত, তাহলে সুষ্ঠু ভোটের ভয় দূর হয়ে যেত। উন্নয়ন হয়নি এটা বলব না। কিন্তু উন্নয়নের আড়ালে হাজারো কোটি টাকা লুটপাটের দায়ভারটা কে নেবে? দেশের জনগণের মাথা বন্ধক দিয়ে অর্থলগ্নি সংস্থার কাছ থেকে ঋণ এনে উন্নয়নের নামে লুটপাট করা হয়েছে। স্বাধীনতার পর এত বছরের ইতিহাসে কোনো সরকারের আমলে এত আর্থিক অনিয়ম হয়নি যেটা এই সরকারের শাসনামলে হয়েছে। প্রতি জনের মাথাপিছু ঋণ ৭০-৮০ হাজার টাকা। এই ঋণ আজ হোক কাল হোক জনগণকে পরিশোধ করতে হবে। সমাজের অশিক্ষিত মানুষেরাও বুঝে ঋণ করে বাহাদুরী করার কোনো মানে হয় না। অথচ ক্ষমতাসীনরা ঋণের টাকায় পায়রা উড়িয়ে জনগণকে বোকা বানাচ্ছে। বাংলাদেশের নির্বাচনী ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, প্রত্যেকটি নির্বাচন কমিশন আস্থার সংকটে থেকে কাজ করেছে। কিছু নির্বাচন কমিশন সে আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারলেও অনেক কমিশনই সেই আস্থার সংকট কাটিয়ে উঠতে পারেনি। তবে যারা কাটিয়ে উঠতে পেরেছে তারা মোটামুটিভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে সক্ষম হয়েছে। আগামী নির্বাচন কেমন হবে তা অনেকটাই নির্ভর করছে আইনপ্রয়োগকারী বাহিনীর ওপর। ইতিহাসের এক টার্নিং পয়েন্টের সামনে দাঁড়িয়ে আছে আজ বাংলাদেশ। সরকার ও নির্বাচন কমিশন অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনের যে অঙ্গীকার জাতির সামনে করেছে তা বাস্তবায়নে সমতল মাঠ নিশ্চিত করবে, এমনটিই মানুষের প্রত্যাশা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।