Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার, ২৩ মে ২০২৪, ০৯ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১, ১৪ জিলক্বদ ১৪৪৫ হিজরী

আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ করতে হবে

| প্রকাশের সময় : ১০ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

২০ বছরের অধিক পুরানো বাস-মিনিবাস জাতীয় যাত্রীবাহী যানবাহন এবং ২৫ বছরের অধিক পুরানো ট্রাক-কাভার্ডভ্যানসহ সমজাতীয় পণ্যবাহী যানবাহন রাস্তায় চলাচল করতে পারবে না বলে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। সম্প্রতি বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষের (বিআরটিএ) কার্যালয়ে বুয়েটসহ স্টেকহোন্ডারদের নিয়ে অনুষ্ঠিত এক সভায় এ সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্তটি কার্যকর হবে ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে। রাস্তায় চলাচলকারী বিভিন্ন ধরনের যানবাহনের আয়ুস্কাল নির্ধারণ করে দেয়ার সিদ্ধান্ত, বলা বাহুল্য, এই প্রথম নয়। ইতোপূর্বেও এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে। কিন্তু তা কার্যকর হয়নি। আমরা দেখেছি, সিদ্ধান্ত নেয়ার পর নির্ধারিত আয়ুস্কালের অধিক পুরানো যানবাহন রাস্তা থেকে সরিয়ে দেয়ার জন্য অভিযান চালানো হয়েছে; কিছু যানবাহন আটকও করা হয়েছে। তবে কিছুদিন পরই অভিযান অজ্ঞাতকারণে পরিত্যক্ত হয়েছে। আমরা এও দেখেছি, ধরপাকড় শুরু হওয়ার পর লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা, রংচটা, জরাজীর্ন যানবাহনের মালিকরা পরিকল্পিতভাবে রাস্তা থেকে তাদের মালিকানাধীন অধিকাংশ যানবাহন সরিয়ে নিয়ে কৃত্রিম যানসংকট সৃষ্টি করেছে। এতে যাত্রী ও মালামাল পরিবহনে ব্যাপক দুর্ঘট সৃষ্টি হয়েছে। এই চাপের কারণেই হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, শেষ পর্যন্ত অভিযান ও ধরপাকড় বন্ধ হয়ে গেছে। আর বন্ধ হওয়ার পর ধীরে ধীরে পুরানো যানবাহন ফের রাস্তায় নেমেছে। সামান্য রংচং করে, ফিটনেস সার্টিফিকেট জোগাড় করে এসব যানবাহন রাস্তায় নামানো হয়েছে। এ ধরনের ইঁদুর-বিড়াল খেলা প্রত্যক্ষ করার অভিজ্ঞতা আমাদের বার বার হয়েছে। এমতাবস্থায়, নতুন করে নেয়া সিদ্ধান্ত কতটা কার্যকর হবে তা নিয়ে অনেকের মধ্যেই ঘোর সন্দেহ রয়েছে।
বাস-মিনিবাস, ট্রাক-কাডার্ভভ্যান ইত্যাদির নতুনভাবে নির্ধারিত আয়ুস্কাল নিয়েও কথা আছে। বিশেষজ্ঞদের অনেকেই মনে করেন, এই আয়ুস্কাল আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের চেয়ে অনেক বেশি। তাদের মতে, সাধারণত বড় বাসের ক্ষেত্রে গড় আয়ু ধরা হয় সর্বোচ্চ ১২ বছর। নির্মাতা কোম্পানিগুলো গড় আয়ু সর্বোচ্চ ১২ বছরই নির্ধারণ করে দেয়। যেমন, সুইডিশ নির্মাতা কোম্পানি ভলভোর একটি বড় বাসের গড় আয়ু ১২ বছর, যা সর্বাধিক ৫ লাখ মাইল চলাচল করতে পারে। আন্তর্জাতিক মানদণ্ডে ছোট বাসের গড় আয়ু ৭ থেকে ১০ বছর। অন্যদিকে বড় ট্রাকের গড় আয়ু সর্বোচ্চ ১২ বছর। আর মাঝারি ও ছোট ট্রাকের গড় আয়ু ৭ থেকে ১০ বছর। অথচ আমাদের দেশে বাস-মিনিবাস এবং ট্রাক-কাভার্ডভ্যান ইত্যাদির আয়ুস্কাল নির্ধারণ করা হয়েছে যথাক্রমে ২০ ও ২৫ বছর। এখানে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডকে আমলে নেয়া হয়নি। আমাদের দেশে চলাচলকারী অধিকাংশ যানবাহনের আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আয়ুস্কাল অনেক আগেই শেষ হয়ে গেছে। এমনকি নতুন করে নির্ধারিত ২০-২৫ বছরের আয়ুস্কালও অতিক্রান্ত হয়ে গেছে বিপুল সংখ্যক যানবাহনের। বিআরটিএর হিসাবে দেশে বাস-মিনিবাসের সংখ্যা ৭৪ হাজার। এর মধ্যে ৫৩ হাজারের বয়স ১০ বছর বা তার চেয়ে বেশি। ২০ বছর বা তার চেয়ে বেশি বয়সের বাস-মিনিবাসের সংখ্যা কত, তার কোনো হিসাব বিআরটিএর জানা নেই। তবে কর্মকর্তাদের ধারণা, এ সংখ্যা ১৮-২০ হাজারের মতো হতে পারে। ওদিকে নিবন্ধিত ট্রাক, কার্গো, ও কাভার্ডভ্যানের সংখ্যা ১ লাখ ৮০ হাজার, যার মধ্যে প্রায় ৯২ হাজারের বয়স ১০ বছর বা তার ঊর্ধ্বে। এরকম আয়ুস্কাল অতিক্রান্ত যানবাহনের চলাচল উন্নত দেশগুলোতে কাস্মিনকালেও দেখা যায় না। উন্নয়নশীল, এমনকি আফ্রিকার দরিদ্র দেশগুলোতেও আমাদের দেশের মতো ভাঙ্গাচোরা, রং ওঠা, ফিটনেসবিহীন যানবাহনের চলাচল দেখা যায় না।
পুরনো লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা, ভঙ্গুর ও ফিটনেসবিহীন যানবাহন আমাদের দেশে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে চিহ্নিত। যান্ত্রিক অক্ষমতা ও ত্রুটির কারণে সহজেই এসব যানবাহন দুর্ঘটনার শিকার হয় এবং তাতে হতাহতের ঘটনা ঘটে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক রিপোর্ট বলা হয়েছে, ২০১৬ সালে সড়ক দুর্ঘটনায় বাংলাদেশে প্রায় ২৫ হাজার মানুষ প্রাণ হারিয়েছে। এই বিপুল প্রাণহানির বড় কারণ যে আয়ুস্কাল অতিক্রান্ত ফিটনেসবিহীন যানবাহন তাতে কোনো সন্দহ নেই। এ ধরনের যানবাহন চালানোর ক্ষেত্রে চালকরা খুব একটা সচেতন থাকে না। তারা প্রায়শই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত হয় এবং যানবাহন দুর্ঘটনায় পতিত হয়। অনেকেই লক্ষ্য করে থাকবেন, দেশের বিভিন্ন কোম্পানীর লাক্সারিয়াস বাসগুলোর দুর্ঘটনার হার প্রায় শূণ্যের কোঠায়। এর কারণ বাসগুলো দামী এবং আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী নির্ধারিত আয়ুস্কাল মেনে চলাচল করে। সবচেয়ে বড় কথা, মালিকরা সবাই এসব বাস রক্ষণাবেক্ষণে সচেতন থাকে। আর চালকদের দক্ষতার সঙ্গে থাকে যথাযথ সচেতনতা। ফলে এসব বাস দুর্ঘটনায় পতিত হয়না বললেই চলে। পক্ষান্তরে, আয়ুস্কাল অতিক্রান্ত বাসের ক্ষেত্রে মালিক-চালকদের তেমন কোনো সচেনতাই লক্ষ্য করা যায় না। এদের রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলা পরিলক্ষিত হয়। চালকরাও যাচ্ছেতাই ভাবে চালায়। কাজেই, দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি কমাতে হলে একদিকে আয়ুস্কাল অতিক্রান্ত, সকল যানবাহন চলাচল বন্ধ করতে হবে, একই সঙ্গে মালিক-চালকদের সচেতন হতে হবে। বিআরটিএ ও পুলিশের মধ্যে দুর্নীতির যে বিস্তার ঘটেছে তা রহিত করতে হবে। পুরানো, লক্কড়-ঝক্কড় মার্কা, ফিটনেসবিহীন যানবাহন শুধু দুর্ঘটনা ও প্রাণহানিরই কারণ নয়, সেই সঙ্গে পরিবেশ দূষণের বড় কারণ। ইউএসআইডির তথ্যমতে, বাংলাদেশে বছরে যে পরিমাণ কার্বনডাইঅক্সাইড নি:সরণ হয় তার ১৪ দশমিক ৪৯ শতাংশ আসে পরিবহন খাত থেকে আসে। পরিবেশ দূষণের ফলে জনস্বাস্থ্যের ওপর কি বিরূপ প্রভাব পড়ছে তা কারো অজানা নেই। এই সার্বিক প্রেক্ষাপটে আয়ুস্কাল অতিক্রান্ত, যানবাহন চলাচল সম্পূর্ণ বন্ধ করতে হবে। শুধু সিদ্ধান্ত নেয়া নয়, তা কঠোরভাবে বাস্তবায়ন করতে হবে।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: আয়ুষ্কাল অতিক্রান্ত যানবাহন
আরও পড়ুন