পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আমাদের দরজায় কড়া নাড়ছে। গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সরকার বা রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা পরিবর্তনের চমৎকার পদ্ধতি হচ্ছে নির্বাচন। এটি সপ্তদশ শতাব্দি থেকে শুরু হয়ে ধীরে ধীরে অধিকাংশ দেশেই বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছে। কিন্তু আমাদের দেশে নির্বাচনী ব্যবস্থা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে। কেন প্রশ্নবিদ্ধ হয়ে আছে তা বুঝতে হলে বিগত জাতীয় সংসদ নির্বাচনসমূহে হানাহানির একটি পরিসংখ্যান দেখা যেতে পারে।
গণমাধ্যমের জরিপ, পত্রপত্রিকার তথ্য, মানবাধিকার সংস্থার রিপোর্ট অনুযায়ী, প্রত্যেক সরকারের শাসনামলে সহিংসতা ঘটেছে। ১৯৯১ সালকে গণতন্ত্রে উত্তরণের বছর বলা হয়। এই বছর থেকে পরবর্তী বছরগুলোর পরিসংখ্যান তুলে ধরা যেতে পারে: ১৯৯১-৯৬ সালের বিএনপির শাসনামলে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ১৭৪ জন। ১৯৯৬ সালে ১৫ ফেব্রæয়ারিতে প্রধান বিরোধী দল আওয়ামী লীগসহ অন্যান্য রাজনৈতিক দলকে বাদ দিয়েই ৬ষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। সেই সংসদ স্থায়ী হয়েছিলো মাত্র ১২ দিন। প্রথম অধিবেশন শুরু হয়েছিল ১৯ মার্চ ১৯৯৬ সালে এবং অধিবেশন স্থায়ী ছিল চার কার্যদিবস ২৫ মার্চ ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত। ৩০ মার্চ ১৯৯৬ সালে সংসদ বিলুপ্ত ঘোষণা করা হয়। এর পরপরই ৭ম জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। ওই এক বছরে রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা যান ৪৯ জন। এর মধ্যে তফসিল ঘোষণার পর নির্বাচনকেন্দ্রিক সহিংসতায় মারা যায় মোট ৪১ জন। ১৯৯৬-০১ সালে আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারায় ৭৬৭ জন! ২০০১ সালের নির্বাচন ঘিরে নিহত হয় ৩৮ জন। ২০০১-০৬ এই ৫ বছরে বিএনপির সরকারের শাসনামলে রাজনৈতিক সহিংসতায় প্রাণ হারায় ৮৭২ জনের।
২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো ধরনের সহিংসতাই হয়নি। কোনো প্রাণহানির খবরও পাওয়া যায়নি। এই নির্বাচনটি সেনা সমর্থিত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত হয়। যে দেশে স্কুল ম্যানেজিং কমিটির নির্বাচনে সহিংসতা হয় এবং মানুষ মারা যায় সে দেশে জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কোনো সহিংসতা হলো না! আমি মনে করি, এখানে আমাদের জন্য সুস্পষ্ট কিছু মেসেজ রয়েছে। সমাজ গবেষকরা ভবিষ্যতে এই ঘটনাটি নিয়ে হয়তো গবেষণা করে ভালো কিছু বের করতে পারবেন।
২০০৯-২০১২ সালে আওয়ামী লীগ সরকার আমলে মারা যায় ৫৬৪ জন মানুষ। ২০১৩ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ছিলো সবচাইতে আলোচিত। ১৫৩টি আসনে সরকারদলীয় প্রার্থী ছাড়া অন্য কোনো প্রার্থী নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। গড়ে ২০ শতাংশ বা তার কম ভোটার তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করেছে এই নির্বাচনে, যেখানে পূর্ববর্তী জাতীয় নির্বাচনে ৮৭ শতাংশের ওপর ভোট পড়েছিল। ভোটের দিনে সহিংসতায় মৃত্যু হয়েছে ২২ জন। সারা বছরে ৫০৭ জন মারা গেছে। আর আহত হয়েছে ২২ হাজার ৪০৭ জন। নির্বাচন-পূর্ব সহিংসতার দিক থেকেও এই নির্বাচন অতীতের রেকর্ড ছাড়িয়েছে। ২০১৩ থেকে ২০১৮ এর এ পর্যন্ত রাজনৈতিক সহিংসতায় মারা গেছে ৪৯৮ জন। এদের মধ্যে রয়েছে রাজনৈতিক ব্যক্তি থেকে শুরু করে জনসাধারণ।
ক্রসফায়ার, বন্দুকযুদ্ধ বা এনকাউন্টার, গুমের পরিসংখ্যান এখানে আনিনি। তাছাড়া আহত, পঙ্গুত্বের পরিসংখ্যানও আনিনি। জাতীয় নির্বাচন ছাড়াও সিটি কর্পোরেশন, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভা, ইউপি নির্বাচনও সহিংসতায় পিছিয়ে নেই! প্রত্যেক নির্বাচনেই মানুষ মারা যাচ্ছে, যা আমাদের দেশের জন্য মোটেও শুভকর নয়। এর জন্য কি শুধু সরকারি দল দায়ী? অথবা শুধু বিরোধী দল দায়ী? আমি মনে করি, আমাদের গোটা রাজনৈতিক ব্যবস্থাই এর জন্য দায়ী।
একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে ৩০ ডিসেম্বর। এই নির্বাচনে সহিংসতা আর মানবসম্পদের ক্ষয়ক্ষতির যেন পুনরাবৃত্তি না ঘটে এই বিষয়ে সরকারসহ রাজনৈতিক দলগুলোকে সচেতন ও সজাগ থাকা অতি জরুরি হয়ে দাঁড়িয়েছে। রাজনীতিগত কোন্দলের কারণে যেন একটি মানুষও অকালে প্রাণ না হারায় এ দায়িত্ব কিন্তু সরকারসহ সব রাজনৈতিক দলের। আমাদের দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি খুবই বাজে। একদল মানুষ হা করে তাকিয়ে থাকে কখন ক্ষমতায় যাবে আর লুটপাট করে নিজেদের পেট ভর্তি করবে। নির্বাচনে জয়লাভের জন্য প্রতিদ্ব›দ্বী গ্রুপগুলো যা ইচ্ছা তাই করে। নিয়মনীতি অনুসরণের কোনো বালাই নেই। আইন আর নীতিকথা সব বই আর বক্তৃতার মঞ্চেই আবদ্ধ থাকে। নির্বাচনে যারা পরাজিত হয় তাদের পরিণতি হয় খুবই করুণ। আইন, পুলিশ, প্রশাসন, সুশাসন, মানবিকতা সবই এদেশে সরকারি দলের অনুকূলে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা শুধু কাগজ কলমে সীমাবদ্ধ।
বাংলাদেশের রাজনৈতিক সাংস্কৃতি ও নির্বাচনী ব্যবস্থা উন্নয়নে আমার কিছু প্রস্তাব তুলে ধরছি-
১) রাজনৈতিক দলে পরিবার ও ব্যক্তিতন্ত্র রোধ করার লক্ষ্যে দলীয় প্রধানের পদ সর্বোচ্চ দশ বছর করা হোক। এক ব্যক্তি এর বেশি সময় দলের প্রধান থাকতে পারবেন না। এ বিষয়ে আইন করা হোক এবং তার সুষ্ঠু প্রয়োগ করা হোক। দলের প্রধান না থেকেও মানবতার সেবা করা যায়, বিশ্বের অনেক দেশে এর নজির আছে।
২) প্রেসিডেন্ট ও প্রধানমন্ত্রীসহ জনপ্রতিনিধিত্বমূলক সকল পদে এক ব্যক্তি দুই মেয়াদের বেশি না থাকার বিধান করা হোক। এটা করলে দেখা যাবে, দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতির উন্নয়ন ঘটছে। প্রেসিডেন্ট, প্রধানমন্ত্রী আজীবন থাকতে হবে কেন? এ থেকে অবসর নিয়ে জাতির সেবা করা যায় না?
৩) নির্বাচনে সঠিক বায়োমেট্রিক পদ্ধতি চালু করা হোক। আমার আঙ্গুলের ছাপ ছাড়া আমার ভোট দেয়া যাবে না- সেই ব্যবস্থা করা হোক। ঘরে বসেই ভোট দেয়ার প্রযুক্তি চালু করা হোক। সিদ্ধান্ত নিলে এটা করা সম্ভব। আমাদের দেশে ছোটখাটো অনেক কাজে অনেক বেশি অর্থ খরচ হয়। সর্বাধুনিক বায়োমেট্রিক পদ্ধতির জন্য কিছু অর্থ বরাদ্দ দিন।
৪) নির্দলীয় নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার পদ্ধতি চালু করুন। আমি জানি, এই কথাটি বললে অনেকেই সংবিধানের দোহাই দিবেন। বিশেষ করে ক্ষমতাসীনরা। অথচ, আমাদের দেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা এই যে, দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই অবাধ, নিরপেক্ষ ও শান্তিপূর্ণ হয়নি। পক্ষান্তরে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে সব নির্বচনই গ্রহণযোগ্য হয়েছে, তুলনামূলকভাবে। শান্তিপূর্ণ হয়েছে। রাজনৈতিক সহিংসতা ও প্রাণহানি রোধে রাজনৈতিক ব্যবস্থাসহ নির্বাচনী ব্যবস্থার যথোপযুক্ত সংস্কারের বিকল্প নেই।
লেখক: প্রভাষক, রাষ্ট্রবিজ্ঞান, ফেনী ভিক্টোরিয়া কলেজ
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।