Inqilab Logo

সোমবার, ০৮ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১, ০১ মুহাররম ১৪৪৬ হিজরী

ইশতেহার যেন হয় অঙ্গীকারপত্র

মোহাম্মদ আবু নোমান | প্রকাশের সময় : ৫ ডিসেম্বর, ২০১৮, ১২:০৪ এএম

নির্বাচনে জনগণ শুধু দল ও মার্কা নয়; প্রার্থীর যোগ্যতা, দক্ষতা, সততা, অতীত কর্মকান্ড ও সার্বিক বিষয় বিবেচনা করেই ভোট দিয়ে থাকে। আগামী ৩০ ডিসেম্বর একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন। নির্বাচন-পরবর্তী রাষ্ট্র পরিচালনা কিভাবে করা হবে তার রূপরেখাই হলো নির্বাচনী ইশতেহার। এক কথায়, ইশতেহার রাজনৈতিক দলের অঙ্গীকারপত্র। রাজনৈতিক দলগুলোর রাষ্ট্র পরিচালনার মূলনীতি ও ক্ষমতায় গেলে করণীয় ও ভবিষ্যৎ কর্মপন্থার খসড়া তুলে ধরা হয় নির্বাচনী ইশতেহারে। রাজনৈতিক দলগুলোর বাস্তবভিত্তিক ও যুযোপযোগী নির্বাচনী ইশতেহার এবং তার পুঙ্খানুপুঙ্খ প্রতিফলন ও বাস্তবায়নের অঙ্গীকার থাকতে হবে। প্রতিশ্রুতি দেয়ার আগে রাজনৈতিক দলগুলোর সাধারণ মানুষের চাহিদা ও আকাক্সক্ষার কথা মাথায় রাখা প্রয়োজন। নির্বাচনী ইশতেহারে সব দলই ভালো ভালো প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। কিন্তু নির্বাচনে জিতলে কোনো দলই ইশতেহার দেখে না, এটাই আমাদের দেশের বাস্তবতা। নির্বাচনে জিতে দল বা জোট যদি ইশতেহার বাস্তবায়ন করতো, তাহলে ঠিকই সোনার বাংলা গড়ে উঠত। নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণায় যা বলা হয়, বাস্তবে তার প্রতিফলন ঘটে খুবই কম। এজন্য রাজনৈতিক দলের নির্বাচনী ইশতেহার গতানুগতিক না করে জনকেন্দ্রিক, জনকল্যাণমুখী, ভিন্নধর্মী এবং চমক দেখানোর মতো বিষয়গুলো থাকা অপরিহার্য।
ইশতেহারকে সর্বসাধারণের যাবতীয় মৌলিক অধিকারের কাছাকাছি নিয়ে যেতে হবে। জনগণের রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক জীবন ও জীবিকার সুন্দর, প্রচ্ছন্ন ও প্রশংসনীয় দিকনির্দেশনা ইশতেহারে উল্লেখ থাকা একান্ত কাম্য। মানুষের চাওয়া-পাওয়ার দিকে লক্ষ রেখেই নির্বাচনী ইশতেহার প্রকাশ করা সমীচীন। কোনো মন্ত্রী, এমপি, নেতা, আমলা যদি জনগণের সম্পদ হরণ, চুরিচামারী করে বা করতে সাহায্য করে অথবা অবৈধ কর্মকান্ডে জড়িত থাকে তাহলে তাকে দল, সংসদ ও প্রশাসন থেকে বহিষ্কার করে সংসদের পবিত্রতা রক্ষা করতে হবে। সর্বোপরি সংবিধানের ৬৫ অনুচ্ছেদের আলোকে সংসদ সদস্যদের ও প্রশাসনের জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।
প্রতিটি দলের ইশতেহারে জনগণের প্রত্যাশার প্রতিফলন ও দেশের বিভিন্ন সমস্যা সমাধানের প্রতিশ্রæতি যেন থাকে। ঋণজালিয়াত, ঋণখেলাপি ও সব সেক্টরের দূর্নীতিবাজদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করে জনগণের টাকা উদ্ধার করার অঙ্গিকার থাকতে হবে। দেশের সম্পদ অতীতে যারা বিদেশে পাচার করেছে বা করবে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশনসহ সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে সম্পূর্ণ স্বাধীন ও বিতর্কের ঊর্ধ্বে রাখার অঙ্গিকার ইশতেহারে থাকতে হবে।
সড়ক ও পরিবহনব্যবস্থায় শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনতে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে এবং নৈরাজ্য, চাঁদাবাজি ও দুর্নীতি দূর করতে হবে। দেশের সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো যানজট। এ বিষয়ে সুদূরপ্রসারী ভাবনা ও পরিকল্পনা দরকার। আলাদা লেন করাসহ সড়ক ও যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে আরো বেশী বরাদ্দ রাখা উচিত। প্রত্যন্ত অঞ্চলের উন্নয়নের ব্যাপারে যথেষ্ট বরাদ্দ রাখতে হবে। জনগণের শহরমুখী হওয়া বন্ধ করে গ্রামে পরিবেশবান্ধব প্রকল্প করা, যানজট নিরসন করা, আইন-শৃঙ্খলায় সুশাসন প্রতিষ্ঠা করার ব্যবস্থা নেওয়ার প্রতিজ্ঞা ইশতেহারে থাকতে হবে। সাংস্কৃতিক আগ্রাসন বন্ধ ও দেশীয় সংস্কৃতির বিকাশে ভ‚মিকাসহ সন্ত্রাসমুক্ত দেশ গড়া, মাদক ও নেশাজাতীয় দ্রব্য নিয়ন্ত্রণে মৃত্যুদন্সডহ কঠোর আইন প্রণয়নের প্রতিশ্রুতি থাকতে হবে। গ্রামীণ অবকাঠামো ও সুবিধা বৃদ্ধি করতে হবে। কৃষকের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিত করতে হবে এবং কৃষকের জন্য কৃষি উপকরণ সহজলভ্য করতে হবে। নিত্যপণ্যের দর সাধারণের অনুকূলে রাখা, দারিদ্র্য দূর করা, বিশেষত বয়স্কদের রাষ্ট্রীয় খরচে চিকিৎসার ব্যবস্থা রাখা।
ইশতেহারে রাজনৈতিক ভ্রাতৃত্ব গঠনের কৌশল ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের কর্মপরিকল্পনা থাকা বর্তমান সময়ে খুবই জরুরি। প্রতিহিংসার রাজনীতি দেশের সর্বসাধারণ দেখতে চায় না। বিরোধী দলকে অন্যায়ভাবে দমন না করার প্রতিশ্রæতি, বিচারবহির্ভূত হত্যা, রাজনৈতিক হয়রানি ও খুন-গুম যেন না হয়- সে বিষয়ে ঘোষণা দরকার। নির্বাচিত সব সংসদ সদস্য ও সংসদের বাইরে রাজনীতিবিদ মিলে একত্রে দেশের উন্নয়নে কাজ করার ঘোষণা রাখা। জাতীয় সংসদে বিরোধীদলকে নিয়ে সব নীতিনির্ধারণের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা। রাজনীতিবিদদের পরস্পরের প্রতি সম্মান বোধ নেই। দেশ তথা জাতির উন্নতি সাধনে হিংসার রাজনীতি ছেড়ে মানবতার লক্ষ্যে কাজ করার অঙ্গীকার থাকা। সৎ, দক্ষ, গণমুখী, রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত কার্যকরী প্রশাসন গড়ে তোলা; তাদের কর্মকান্ডের জন্য জনপ্রতিনিধির কাছে দায়বদ্ধ থাকার ব্যবস্থা করা। ইশতেহারে সংঘাত, সংঘর্ষ ও প্রতিহিংসার রাজনীতি পরিহার করে সহনশীলতা, সহাবস্থান ও সমঝোতার রাজনীতি ফিরিয়ে আনার পরিকল্পনা ও সংসদ বয়কট বা বর্জনের রাজনীতি পরিত্যাগ করতে হবে।
বর্তমানে দেশের প্রধান সমস্যা বেকারত্ব। পরিতাপের বিষয়, আমাদের শিক্ষিত বেকাররা দেশের বোঝা হয়ে আছে। নির্বাচনী ইশতেহারে তরুণদের কর্মসংস্থানের স্বীকৃতির সাথে নেতৃত্বে তরুণদের অবস্থানের কথাও থাকা দরকার। ঘুষ ছাড়া সরকারি চাকরি পাওয়ার অঙ্গীকার থাকতে হবে। বেকারত্বের কারণে যুবকদের বড় একটি অংশ হতাশায় ডুবে থাকে। এই বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে কর্মসংস্থানের মাধ্যমে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে আরো জোরালো ভ‚মিকা জরুরি। অযোগ্য, অসৎ মানুষকে বিতাড়িত করে সুশিক্ষিত তরুণ, সৎ ও যোগ্য নেতৃত্ব ক্ষমতায় আনলে বাংলাদেশের চেহারা পাল্টে যাবে। রাজনৈতিক দলগুলোকে এ-ও ভাবতে হবে, রাজনীতি হবে জনগণের জন্য; ক্ষমতা, মোহ বা ক্ষমতায় টিকে থাকতে নয়।
সর্বসাধারণকেও সজাগ ও সচেতন হতে হবে। অসৎ লোক দিয়ে উন্নয়ন সম্ভব নয়, এটা জনগণকে বুঝতে হবে। দল বা জোটের নীতি-আদর্শ, অতীত কর্মকান্ড ও প্রার্থীর যোগ্যতা, সততা, দেশপ্রেম প্রভৃতি বিবেচনা করেই ভোট দিতে হবে। দুর্নীতিবাজ, কালো টাকার মালিক, ব্যবসায়ী, অবসরপ্রাপ্ত আমলা, যারাই জনগণের সম্পদের অপচয়কারী হিসেবে চিহ্নিত তাদের ভোট দেয়া থেকে বিরত থাকতে হবে। সবদলকে সৎ, নির্লোভ, চরিত্রবান ও জনসেবক প্রার্থীদের মনোনয়ন দিতে হবে। এজন্য সবার আগে দরকার সৎ ও নীতিবান প্রার্থী। দুর্নীতিবাজ, চাঁদাবাজ, সন্ত্রাসী, মাদক কারবারীদের আশ্রয়-প্রশ্রয়দাতা গডফাদারদের কোনো রাজনৈতিক দলে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেওয়া যাবে না। রাজনীতি কোনো ব্যবসা নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর প্রধানরা যা যা বলবেন সে কথা শুনে জনগণকে নাচলে চলবে না। রাজনীতিকরা চাইলেও যেন জনগণকে বিভ্রান্ত করতে না পারে। দুর্নীতিবাজ, ঋণখেলাপি, সন্ত্রাসীদের আশ্রয় ও প্রশ্রয়দাতাদের জনগণ ভোট দেবে না। সব দলই যেন সৎ, যোগ্য ও দেশপ্রেমিক ব্যক্তিদের মনোনয়ন দেয়। এজন্য জনগণকে আরো সতর্ক ও সচেতন হতে হবে। দলগতভাবে বা স্বতন্ত্রভাবে জ্ঞানী-গুণী, সৎ, যোগ্য ও পূর্ব থেকেই জনসেবায় নিয়োজিত ব্যক্তিরা যাতে নির্বাচিত হতে পারেন সেদিকে জনগণকেই নজর রাখতে হবে। যাদের মধ্যে দেশাত্মবোধ আছে, যারা মানুষের জন্য কাজ করবে এবং মানবিক হবে তারাই যেন সরকারে আসতে পারে সে জন্য সর্বসাধারণকে সজাগ ও সচেতন হতে হবে। এভাবে জনগণ সচেন হলে রাজনীতিকরাও ইতিবাচক রাজনীতির পথে ফিরে আসতে বাধ্য হবে।
লেখক : গণমাধ্যমকর্মী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন