পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বাংলাদেশ-ভারত ড্রেজিং প্রকল্পের আওতায় নৌপথে ভারতের কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্যবাহী কার্গো জাহাজ চলাচলের জন্য আজ থেকে বাংলাদেশের বিভিন্ন নদ-নদীতে ড্রেজিং শুরু হওয়ার কথা। চুক্তি অনুযায়ী, এই প্রকল্পের আওতায় বাংলাদেশের মেঘনা. যমুনা, সুরমা, কংশ ও কুশিয়ারায় ড্রেজিং করা হবে। বিস্ময়ের ব্যাপার হচ্ছে, ড্রেজিং করার আগে নদীগুলো এবং এর আশপাশের এলাকা, প্রাকৃতিক পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের কী ধরনের ক্ষতি হবে, তা নিয়ে কোনো জরিপ বা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হয়নি। এ নিয়ে পরিবেশবিদরা গভীর উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা প্রকাশ করেছেন। তারা বলেছেন, কোনো ধরনের জরিপ ছাড়া ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে ৩০ মিটার চওড়া এবং তিন মিটার গভীর চ্যানেল করা হলে তা পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতি হবে। তারা একে ‘আত্মঘাতী উদ্যোগ’ এবং পরিবেশ আইনের লঙ্ঘন বলে অভিহিত করেছেন। ‘বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলন’-এর যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ইকবাল হাবিব বলেছেন, পরিবেশ জরিপ এবং ছাড়পত্র ছাড়া এ ধরনের ড্রেজিং করা আইনের লঙ্ঘন এবং এতে নদী ভাঙন তীব্র হওয়া থেকে শুরু করে দেশের অভ্যন্তরের নৌযোগাযোগও ব্যাহত হবে। তিনি বলেছেন, পদ্মাসেতু করতে গিয়ে মুন্সিগঞ্জ ও শরীয়তপুর এলাকার ভাঙন আগের চেয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে এবং মানুষ ক্ষতির শিকার হচ্ছে। পানি বিশেষজ্ঞ শরিফ জামিল বলেছেন, এই ড্রেজিংয়ের ফলে শুষ্ক মৌসুমে যমুনা, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীকে সংকুচিত করে ফেলবে এবং নদীগুলোর সাথে সংযুক্ত ধলেশ্বরি, পুঙ্গলি, পুরাতন ব্রহ্মপুত্র, ঝিনাই, বাশিয়া, কালনি, গড়াই, বাউলাই ও তিতাস নদী শুকিয়ে যাবে। এতে এসব এলাকার প্রাকৃতিক পরিবেশ যেমন ক্ষতিগ্রস্ত হবে, তেমনি জামালপুর, টাঙ্গাইল, মানিকগঞ্জ, বৃহত্তর সিলেট এবং ব্রাহ্মনবাড়িয়ায় পানির স্তর নিচে নেমে যাবে। উল্লেখ্য, ভারতের সাথে স্বাক্ষরিত সমঝোতা চুক্তি (এমওইউ) অনুযায়ী, ভারত ৩২২টি প্রজেক্টের আওতায় সিরাজগঞ্জের যমুনা নদী থেকে দইখাওয়া পর্যন্ত ১৯৫ কিলোমিটার এবং আশুগঞ্জ থেকে জকিগঞ্জ পর্যন্ত ২৮৫ কিলোমিটার ড্রেজিং করবে। এর শতকরা ৮০ ভাগ খরচ ভারত বহন করবে। বলা বাহুল্য, শুধুমাত্র ভারতের সুবিধার জন্য এসব নদ-নদীতে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে চ্যানেল তৈরি করা হচ্ছে। এতে বাংলাদেশ লাভ দূরে থাক, উল্টো ব্যাপক ক্ষতির মুখে পড়বে।
বিগত প্রায় দশ বছরে বাংলাদেশের কাছ থেকে ভারত যেভাবে তার সুবিধা আদায় করে নিয়েছে, বিশ্বের আর কোনো দেশ এমন একপাক্ষিক সুবিধা অন্যদেশকে দেয়নি। বাংলাদেশ সরকার বন্ধুত্বের নামে ভারতের প্রতি এতটাই বিনয়ী যে, ভারত যখন যা চেয়েছে এবং চাইছে তা বিনাপ্রশ্নে দিয়ে দিয়েছে ও দিচ্ছে। বিনিময়ে ভারতের কাছ থেকে কিছুই আদায় করতে পারেনি। যে নদ-নদীতে ভারত এখন ড্রেজিং করতে যাচ্ছে, সেগুলোর করুণ দশার জন্য তো ভারতই দায়ী। উজানে বাঁধ দিয়ে পানি প্রত্যাহার করে এসব নদনদীকে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিয়েছে। এক তিস্তা চুক্তি নিয়ে টালবাহানা করতে করতে বছরের পর বছর পার করে দিয়েছে ভারত। অন্যদিকে তার যা চাহিদা এবং যেভাবে সুবিধা তা ঠিকই আদায় করে নিয়েছে। কলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব ভারতে পণ্য ও মালামাল পরিবহনের সুবিধার্থে এখন সে বাংলাদেশের নদ-নদী ব্যবহার এবং এর খনন কাজ শুরু করছে। এতে ভারত ব্যাপকভাবে অর্থনৈতিক ও কৌশলগতভাবে লাভবান হবে। নদীপথে কলকাতা থেকে করিমগঞ্জ পর্যন্ত পণ্য পরিবহন করার ক্ষেত্রে স্থলপথের চেয়ে (২২ দিন) চার দিন কম সময় লাগবে এবং ৪০০ রুপি থেকে ৩০ হাজার রুপি কম খরচ হবে। অর্থাৎ পুরোটাই ভারতের স্বার্থের অনুকূল। এর ফলে তার পণ্য পরিবহনে সময় ও অর্থ দুটোই সাশ্রয় হবে। অন্যদিকে বাংলাদেশের অপূরণীয় ক্ষতি হবে। বাংলাদেশ সরকারের সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষও পরিবেশ এবং প্রতিবেশের কী ক্ষতি হতে পারে তা কোনো ধরনের জরিপ না করেই ভারতকে ড্রেজিং করার সুযোগ দিয়ে দিয়েছে। যদিও বিআইডবিøওটিএ-এর পরিচালক বলেছেন, ড্রেজিংয়ের জন্য কোনো ধরনের জরিপের প্রয়োজন নেই। নৌ ও জাহাজ চলাচল মন্ত্রণালয়ের সেক্রেটারি দাবী করে বলেছেন, এ ব্যাপারে পরিবেশ মন্ত্রণালয় থেকে অনাপত্তিপত্র নেয়া হয়েছে। অথচ পরিবেশ অধিদপ্তর বলেছে, নদী ড্রেজিংয়ের জন্য অনাপত্তিপত্র সম্পর্কে তার জানা নেই। দেখা যাচ্ছে, নদী ড্রেজিং নিয়ে পরস্পরবিরোধী বক্তব্য দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কেউই বিষয়টি নিয়ে তেমন গা করছে না। যথাযথ পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করে এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ, নদী ভাঙন বৃদ্ধির কথা চিন্তা না করে এভাবে ড্রেজিং শুরু করা দেশের জন্য কত বড় ক্ষতি বয়ে আনবে তা তারা বিবেচনায় নিচ্ছে না। পরিবেশবিদরা এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করলেও তা আমলে নেয়া হচ্ছে না। ভারতের স্বার্থে এ প্রকল্প অদূর ভবিষ্যতে যখন ভয়াবহ পরিস্থিতি সৃষ্টি করবে, তখন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কী জবাব দেবে?
বাংলাদেশ সরকার ভারতের কাছে এতটাই নতজানু নীতি অবলম্বন করে চলেছে যে, ভারতের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দেশের স্বার্থের কথা বিন্দুমাত্র চিন্তা করছে না। বিষয়টি এমন হয়ে দাঁড়িয়েছে, ভারত আর কি চাইবে তা দেয়ার জমা সরকার যেন অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করে আছে। চাওয়া মাত্র তার চাহিদা পূরণ করতে সরকার যেন বদ্ধপরিকর। ভারতের কাছ থেকে দেশের চাহিদা আদায়ের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের দর কাষাকষির জায়গা রাখছে না। অত্যন্ত পরিতাপের বিষয়, দেশের বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ নাগরিক সমাজের কেউই ভারতের একতরফা চাওয়া পূরণের বিষয়ে কোনো উচ্চবাচ্য করছে না। ভারতকে তুষ্ট করা এবং সে যাতে কোনোভাবে অখুশি না হয়, সরকারের মতো তারাও যেন এ নীতি অবলম্বন করে চলেছে। ভারতের একের পর এক চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে দেশের যে বহুবিধ ক্ষতি হয়ে যাচ্ছে, তা তাদের বোধ-বিবেচনায় নেই। ভারতের নিজস্ব স্বার্থে যে ড্রেজিং শুরু হচ্ছে, তাতে পরিবেশ-প্রতিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের কী ধরনের ক্ষতি হবে তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা না করার মতো নির্বুদ্ধিতা আর কিছু হতে পারেনা। পরিবেশবিদরা যেমন এ ব্যাপারে সোচ্চার হয়েছেন, তাদের সাথে বিরোধী রাজনৈতিক দলসহ সচেতন মানুষকেও সোচ্চার হতে হবে। ভারতের পণ্যবাহী জাহাজ দেশের বুক চিরে ক্ষতি করে চলাচল করবে, এটা কোনোভাবেই বরদাশত করা যায় না। আমাদের স্পষ্ট অভিমত, যেসব নদ-নদীতে ড্রেজিং করার কথা, সেসব নদ-নদীর পরিবেশ, ভাঙন, জীববৈচিত্র্য এবং আশপাশের এলাকার ক্ষতির বিষয়টি বিশদভাবে পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও জরিপ করার পর ড্রেজিং শুরু করতে হবে।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।