Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রোহিঙ্গা পরিচয়পত্র ও ছিটমহলবাসির নাগরিক সনদ

প্রকাশের সময় : ২৭ জানুয়ারি, ২০১৬, ১২:০০ এএম

বাংলাদেশে অবৈধভাবে অবস্থানরত মিয়ানমারের রোহিঙ্গা নাগরিকদের পরিচয়পত্র দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। আগামী মার্চ মাসে রোহিঙ্গাদের উপর একটি আদমশুমারির পর তাদের তথ্যসম্বলিত পরিচয়পত্র প্রদান করা হবে বলে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বিদেশী কূটনীতিকদের অবহিত করা হয়েছে বলে গতকাল প্রকাশিত এক রিপোর্টে জানা গেছে। মিয়ানমারের রোহিঙ্গা মুসলমানদের সাথে বাংলাদেশের চট্টগ্রাম-কক্সবাজার অঞ্চলের একটি প্রাচীন ঐতিহাসিক সাংস্কৃতিক মেলবন্ধন থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তারা মিয়ানমারের রাখাইন স্টেটের বাসিন্দা। ধর্মীয়ভাবে থেরাভেদা বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ মিয়ানমারে শতাধিক জাতি গোষ্ঠীর মানুষ বসবাস করলেও চতুর্থ বৃহত্তম জনগোষ্ঠী রাখাইন অঞ্চলের মূল জনশক্তি রোহিঙ্গারা অর্ধশতাধিক বছর ধরে মিয়ানমারের সামরিক শাসকদের হাতে চরম নির্যাতনের শিকার। একদিকে উগ্র বৌদ্ধরা রোহিঙ্গাদের উপর জাতিগত বিদ্বেষ পোষণ করে তাদের উপর নির্মম আচরণ করছে, অন্যদিকে মিয়ানমারের শাসকরাও রোহিঙ্গাদের নাগরিক, মানবিক, রাজনৈতিক অধিকার ও সুযোগ-সুবিধা থেকে বঞ্চিত করছে। এমনকি এদেরকে মিয়ানমারের নাগরিক হিসেবেও তারা স্বীকার করতে অনীহা প্রকাশ করছে। মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের বঞ্চনার এখানেই শেষ নয়, গত কয়েক দশক ধরে রোহিঙ্গারা সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধদের হাতে জাতিগত দাঙ্গা ও রাজনৈতিক গণহত্যার শিকার হচ্ছে। এহেন বাস্তবতায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা নাগরিক বাংলাদেশসহ প্রতিবেশী দেশগুলোতে পালিয়ে এসে আশ্রিত হয়ে থাকতে বাধ্য হচ্ছে।
বছরের পর বছর ধরে লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর দায় বহন করছে বাংলাদেশ। ২০১২ সালে মিয়ানমারের সংখ্যাগরিষ্ঠ বৌদ্ধরা রাখাইন ও রোহিঙ্গা মুসলমানদের বিরুদ্ধে জাতিগত দাঙ্গা উস্কে দেয়। সে সময় রোহিঙ্গাদের হাজার হাজার বাড়িঘর আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেয়া হয়। কয়েক দিনের দাঙ্গায় শত শত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু চরম বর্বরতার শিকার হয়। রোহিঙ্গা শিশুদের জীবন্ত পুড়িয়ে মারার দৃশ্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো রোহিঙ্গাদের মানবাধিকার হরণের প্রশ্নে কিছুটা সরব হলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থাসহ বিশ্ব সম্প্রদায় মিয়ানমার সরকারের উপর যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করেনি। উল্টো বিশ্ব সম্প্রদায় বাংলাদেশ সরকারকে উদ্বাস্তু ও ভাসমান রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। বাংলাদেশে নিবন্ধিত রোহিঙ্গার সংখ্যা ৩২ হাজার হলেও দাঙ্গা-সংঘাতে পালিয়ে আসা অনিবন্ধিত রোহিঙ্গা নাগরিকের সংখ্যা অন্তত ৫ লাখ হতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। দাঙ্গা ও এথনিক ক্লিনজিং বা রাজনৈতিক গণহত্যার শিকার, জাতিগত পরিচয়ের স্বীকৃতিবিহীন রোহিঙ্গারা বর্তমান বিশ্বের সবচে নির্যাতিত এবং মানবাধিকার বঞ্চিত সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। বিশেষত: মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সাম্প্রতিক দাঙ্গা ও গণহত্যার শিকার হওয়ার প্রেক্ষাপটে লাখ লাখ রোহিঙ্গা জীবনরক্ষা ও অভিবাসনের জন্য বাংলাদেশ ছাড়াও নৌকায় চড়ে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, থাইল্যান্ডসহ ইউরোপীয় দেশগুলোতে পাড়ি জমাচ্ছে। এতে নৌকাডুবির শিকার হয়ে মৃত্যুবরণও করছে। আন্তর্জাতিক মানবপাচারকারি চক্রের হাতে এদের অনেকে ক্রীতদাসের মতো আচরণের শিকার হচ্ছে। খাদ্যাভাবে, রোগে এবং পাচারকারিদের নির্যাতনে মৃত্যুবরণ করার পর এদের অনেকে সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হচ্ছে অথবা থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়ার জঙ্গলে গণকবরে ঠাঁই পাচ্ছে। কক্সবাজার উপকূল থেকে রোহিঙ্গাদের পাশাপাশি বেকারত্ব ও দারিদ্র্যের শিকার কিছু বাংলাদেশী নাগরিকরাও আন্তর্জাতিক মানব পাচারকারি চক্রের প্রলোভনের শিকার হয়ে সমুদ্রপথে বিদেশে অভিবাসি হওয়ার ঝুঁকি গ্রহণ করছে। এহেন বাস্তবতায় লাখ লাখ রোহিঙ্গা শরণার্থীর তালিকাভুক্তি ও পরিচয়পত্র প্রদানের সরকারী উদ্যোগকে আমরা স্বাগত জানাই।
রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব ও মানবাধিকারের প্রশ্নে বাংলাদেশ মানবিক ভূমিকা পালন করে চলেছে। তবে শরণার্থী শিবিরে অথবা বিভিন্ন স্থানে বিচ্ছিন্নভাবে বসবাসরত রোহিঙ্গাদের পরিচয়পত্র দেয়া কোন স্থায়ী সমাধান নয়। তাদের মিয়ানমারের পূর্ণ নাগরিকত্বের স্বীকৃতিসহ নাগরিক সুযোগ-সুবিধা ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে মিয়ানমার সরকারকে বাধ্য করতে জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নিতে হবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের তালিকাভুক্তি ও পরিচয়পত্র প্রদানের ক্ষেত্রে আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতার স্বার্থে জাতিসংঘের শরণার্থী সংস্থা ইউএনএইচসিআর-কে সরাসরি সম্পৃক্ত করা প্রয়োজন। গতকাল প্রকাশিত অন্য একটি সংবাদে জানা যায়, ভারতের সাথে ছিটমহল বিনিময় চুক্তির চূড়ান্ত নিষ্পত্তির ৬ মাস পেরিয়ে যাওয়ার পরও বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্ত সাবেক ১১১টি ছিটমহলের প্রায় চল্লিশ হাজার মানুষের নাগরিকত্ব নিষ্পত্তি হয়নি। সরকারের পক্ষ থেকে তাদের জীবনমান উন্নয়নে অনেক আশ্বাস দেয়া হলেও প্রয়োজনীয় নাগরিকত্বের দলিল এবং রেজিস্ট্রেশনের প্রক্রিয়া সম্পন্ন না করায় তাদের প্রত্যাশিত সুযোগ-সুবিধা এখনো অধরাই রয়ে গেছে। অন্যদিকে ভারত সরকার তাৎক্ষণিকভাবেই তাদের কাছে হস্তান্তরিত ৫১টি ছিটমহলের ১৫ হাজার বাসিন্দাকে ভারতীয় নাগরিকত্বের সনদ প্রদান করেছে বলে জানা যায়। ভারতের অনীহা ও আইনগত জটিলতায় এসব ছিটমহলবাসিকে নাগরিকত্বের স্বীকৃতি লাভ করতে ৪১ বছর অপেক্ষা করতে হয়েছে। আমরা মনে করি, যথাশীঘ্র তাদের নাগরিকত্ব দলিল বুঝিয়ে দিয়ে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেয়া হবে। এদিকে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশী জাল পাসপোর্ট নিয়ে বিদেশে গিয়ে নানা ধরনের সংকট তৈরি করে দেশের ভাব-মর্যাদা নষ্ট করছে, অন্যদিকে মিয়ানমারের পক্ষ থেকেও এদেরকে বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে আখ্যায়িত করে পুশব্যাক করছে। এসব অগ্রহণযোগ্য হলেও রোহিঙ্গাদের তালিকা প্রণয়ন ও পরিচয়পত্র প্রদানের পদক্ষেপ একটি ইতিবাচক উদ্যোগ। আমরা এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানাই।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: রোহিঙ্গা পরিচয়পত্র ও ছিটমহলবাসির নাগরিক সনদ
আরও পড়ুন