Inqilab Logo

বৃহস্পতিবার ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ২৯ কার্তিক ১৪৩১, ১১ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

রাজনীতির গুণগত মান উন্নত করতে হলে-

তৈমূর আলম খন্দকার | প্রকাশের সময় : ২৫ নভেম্বর, ২০১৮, ১২:০৩ এএম

২৭ লাখ এজাহারভুক্ত নেতাকর্মীর মাথায় ৯৫ হাজার মামলা নিয়ে বিএনপি নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট একাদশ জাতীয় নির্বাচনে অংশগ্রহণ করায় মনে হচ্ছে, একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সিলভার লাইন দেখা যাচ্ছে। বিএনপির ভাষ্য মতে, ‘২০০৯ সাল থেকে এ বছরের ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট মামলার সংখ্যা ৯০ হাজার ৩৪০টি, আসামির সংখ্যা ২৫ লাখ ৭০ হাজার ৫৪৭ জন, জেলহাজতে থাকা আসামির সংখ্যা ৭৫ হাজার ৯২৫ জন, মোট হত্যার সংখ্যা ১ হাজার ৫১২ জনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দ্বারা হত্যার সংখ্যা ৭৮২ জন, বিভিন্ন দলের মোট গুমের সংখ্যা ১ হাজার ২০৪ জনের মধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হেফাজত থেকে গ্রেফতার দেখানো ৭৮১ জন এবং বিএনপির গুম ৪২৩ জন, ৩০ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বিএনপি নেতাকর্মীরা গুম রয়েছেন ৭২ এবং গুরুতর জখম ও আহত হয়েছেন ১০ হাজার ১২৬ জন।’
সরকারের কয়েকজন এমপি/মন্ত্রী রয়েছেন যারা ইতোমধ্যে বিএনপি বিশেষজ্ঞ(!) বলে প্রতীয়মান হয়েছেন। তাদের ভাবনায় বিএনপি স্বাধীনতাবিরোধী, জামায়াত-শিবিরের পৃষ্ঠপোষক ইত্যাদি বলাতে সারাক্ষণ ব্যতিব্যস্ত ছাড়াও বিএনপির দোষত্রুটির খুঁটিনাটি প্রকাশ করাই তাদের কাজ। সরকার জাতিকে সুকৌশলে দুই ভাগে ভাগ করে দিয়েছে, স্বাধীনতার চেতনা ও চেতনার বিরোধী বলে। এমতাবস্থায়, নির্বাচন যতই ঘনিয়ে আসছে ততই চেতনার চেহারা উন্মোচিত হচ্ছে বিভিন্ন পন্থায়। আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক অর্থমন্ত্রী এম এস কিবরিয়ার হত্যাকান্ডে বিএনপিকে জড়িয়ে অনেক কল্পকাহিনী রচিত হয়েছে। কিন্তু কিবরিয়াপুত্র ড. রেজা কিবরিয়া বিএনপির ‘ধানের শীষে’ নির্বাচন করার জন্য আগ্রহী হয়েছেন। পিতার হত্যার বিচার নিয়ে রেজা কিবরিয়া বলেন যে, ‘বিএনপি বিচার করেনি, তারপরও দুই বছর ক্ষমতায় ছিল বিশেষ সরকার, তারাও বিচার করতে পারল না। এর পরতো আওয়ামী লীগ টানা সাড়ে ৯ বছর ধরে ক্ষমতায়, তারা কেন বিচার করলো না?’
ক্ষমতাসীনদের স্বাধীনতার চেতনা বর্তমানে একটি ট্রেড মার্ক, যার গুড উইল বিক্রি করা সহজতর হয়েছে। জামায়াত-শিবির বিরোধী শ্লোগানে সরকার আকাশ-বাতাস মুখরিত করছে, তাদের জেলে পুরেছে, নির্বাচন করার নিবন্ধন নেই কিন্তু রাজনৈতিক দল হিসাবে তাদের নিষিদ্ধ ঘোষণা করেনি। জাতীয় নির্বাচন ঘনিয়ে এলে অনেক নাটকীয়তার অর্ভিবাব ঘটে। তবে আলোচনা-পর্যালোচনায় জনগণ জাতীয় নীতি নির্ধারণের কিছু শ্লোগানের সাথে পরিচিতি লাভ করে, যা পণ্য সামগ্রীর মতো জনগণকে আকৃষ্ট করে। রাজনীতিও একটি পণ্য সামগ্রীর মতো, যখন যেভাবে জনগণের নিকট বাজারজাত করা যায়। রাজনীতি এখন আর প্রকৃত রাজনীতিবিদদের নিয়ন্ত্রণে নেই। শ্লোগান দেয়া, পুলিশের পিটুনী খাওয়া, জেলখাটা, রাজপথে গুলি খাওয়াই রাজনীতিবিদদের পাওনা। আর যখন নির্বাচন আসে তখন দলীয় মার্কা প্রাপ্তির যুদ্ধে নেমে যায় দলছুট ছাড়াও টাকাওয়ালা, ব্যাংক লুটেরা, ভূমিদস্যু, আমলা, পুলিশ/ সেনাবাহিনীর অবসর প্রাপ্ত কর্মকর্তারা, যারা কোনো না কোনোভাবে জনগণকে শোষণ করে আসছে। অন্যদিকে ত্যাগ তিতিক্ষা বা সেবার ব্রত নিয়ে যারা নিজেদের তিলে তিলে ক্ষয় করে আসছে, তাদের নিজেদের জনগণের সামনে তুলে ধরার জন্য ‘নির্বাচন’ নামক একটি মওকা যখনই আসে তখনই অবির্ভাব হয় লুটেরাদের, যারা দু’হাতে উজাড় করে দেয় অবৈধ পন্থায় উপার্জিত অর্থ। সকল রাজনৈতিক দলেই থাকে তাদের আনাগোনা, তারা ব্যবসা করে সরকারি দলের পার্টনারশিপে এবং তলে তলে খাতির রাখে বিরোধীদের সাথে। অর্থাৎ এক জায়গায় বসতে পারলেই হলো! দুঃখজনক এই যে, নীতিবান (!) রাজনৈতিক দলগুলিও এদের লুফে নেয়। রাজনীতিতে গুণগত পরিবর্তনের কথা যারা বেশি বলেন তারাই নির্বাচনপূর্ব সময়ে নির্বাচনী ব্যবস্থাকে কুলষিত করার প্রেক্ষাপট তৈরি করেন।
মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষে ও বিপক্ষে কথা বলে ক্ষমতাসীনরা জাতিকে দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছে। ভাগটা এমনই যে, যারা সরকারের পক্ষে তারাই মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষের শক্তি, বাকী বিরোধীরা সকলেই জামায়াত-শিবিরের ছত্রছায়ায় মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরোধী। সরকার বিএনপিসহ রাজনৈতিকভাবে যাকেই জবাই করুক না কেন তা স্বাধীনতা বিরোধী বলে তাদের চালিয়ে দেয়ার ফলে সরকারবিরোধীর সংখ্যা দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে।
‘ছদ্মাবরণ’ বেশি দিন স্থায়ী হয় না। আওয়ামী লীগের কাছের লোকেরাই এখন ধানের শীষের মার্কার জন্য লাইন ধরছে। ফলে স্বাধীনতার বিরোধী শক্তি হিসাবে বিএনপিকে চিহ্নিত করার জন্য সরকার যতই চেষ্টা করুক, তা ফলদায়ক হয়নি এ কারণে যে, সরকার অসত্য ঘটনা সাজিয়ে নিজের স্বার্থ উদ্ধারের জন্য লড়ছে, যা জাতির স্বার্থে নয়।
বাংলাদেশের রাজনীতির প্রেক্ষাপট শিশু কিশোরদের কানা-মাছি-ভো-ভো খেলাকেও হার মানিয়ে দিচ্ছে। পিতা একদল, পুত্র অন্যদল থেকে নমিনেশন প্রার্থী, পরিবারের একাধিক সদস্য একই দল থেকে প্রার্থী, দল করে নাই এমন লোকও প্রার্থী, দল ছেড়ে চলে গিয়েছিল বা অন্য দলে যোগ দিয়েছিলো তারাও সে দলের প্রার্থী, দলের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিল বা দলের দুঃসময়ে দল থেকে চলে গিয়েছিল তারাও প্রার্থী, যারা এক দিনের জন্য দলীয় কর্মকান্ডে রাজপথে ঝুঁকি নেয় নাই তারাও জোরদার প্রার্থী এবং এ সকল প্রার্থীর তদবিরে বিএনপির মাঠ কর্মীদের ত্রাহি ত্রাহি অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। সকলেই বলেন যে, রাজনীতি বা রাজনীতির প্রশিক্ষণ কেন্দ্র বা রাজনীতিবিদ তৈয়ার করার সূতিকাগার রাজনৈতিক দল। নমিনেশন বণ্টনে যদি সুর্নিদিষ্টকোনো নীতিমালা না থাকে তবে দলটির সাংগঠনিক শক্তি বৃদ্ধি হবে কীভাবে? রাজনীতিবিদই বা তৈরি হবে কোথা থেকে? মানুষের যখন চক্ষুলজ্জা থাকে না, তখন সে নগ্ন হতে দ্বিধাবোধ করে না। এখন পরিষ্কার প্রতীয়মান হচ্ছে যে, রাজনীতির মাঠ এখন চক্ষুলজ্জাহীনদের অনুপ্রবেশ ঠেকাতে পারে নাই, ফলে রাজনীতির গুণগত মান সৃষ্টি হওয়ার অবকাশ কোথায়?
রাজনীতির গুণগত মান বৃদ্ধি করতে হলে রাজনৈতিক দলকে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে নয় প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তিতে দাঁড় করাতে হবে। এ জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নেয়া দরকার। রাজনৈতিক দল একটি কর্মী ব্রিগেডভিত্তিক হওয়া বাঞ্চনীয়, যেখানে প্রমোশন ও ডিমোশন হওয়ার স্কোপ অর্থাৎ পুরুষ্কার-তিরষ্কারের পদ্ধতি রাজনৈতিক দলে চালু করা উচিৎ। প্রবাদ রয়েছে যে, চক চক করলেই সোনা হয় না। কিন্তু রাজনীতিতে সে অবস্থা এখনো বিদ্যমান। সুবিধাবাদী ও সুযোগ সন্ধানীরা নির্বাচনিক মাঠ দখল করে বিধায় দল যখন খাদে পড়ে যায় তখন সুবিধাবাদী চক্রকে আর খুঁজে পাওয়া যায় না, যার মূল্য দিতে হয় দলীয় প্রধান ও দলের তৃণমূলের নেতাকর্মীদের। সুবিধাবাদী নেতাদের দলত্যাগের সুযোগ থাকলেও দলই তৃণমূল পর্যায়ের নেতাকর্মীদের শেষ অবস্থান, নতুবা থাকতে হয় কারাগারে। দেশি-বিদেশি কোনো ষড়যন্ত্রের কারণে বিএনপির নেতৃত্ব যদি বিএনপির হাতে না থাকে তবে মাঠ পর্যায়ের নেতা কর্মীদের পস্তাতে হবে অনেক বেশি। নিজস্ব আঙ্গীকে দলকে ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য সচেষ্ট হতে হবে অনেক দৃঢ়তার সাথে।
রাজনীতির গুণগত মান উন্নতির জন্য একে গরুর হাটের সাথে তুলনা করলে চলবে না। যেমন কোরবানির গরু এক হাটে বিক্রি না হলেও অন্য হাটে বিক্রি হওয়ার নজির চালু রয়েছে। গুণগত মান উন্নয়নের উদ্দেশ্যে দলের মূল নেতৃত্ব তৃণমূল হতে আসতে হবে। গবেষণা সেল থাকতে হবে, বিরোধী দলে থাকতে হবে ছায়া মন্ত্রিসভা, এমন কি স্থানীয় সরকার পর্যায়ে ছায়া প্রশাসন থাকলে জনগণ উপকৃত হতো। শুধু পাল্টাপাল্টি বক্তব্যে চিড়া ভেজে না। বিশ্লেষণধর্মী তথ্যমূলক বক্তব্য জনতা শুনতে চায়। মাঠ পর্যায় থেকে মেধা ভিত্তিক নেতৃত্ব গড়ে তোলার দায়িত্ব মূল নেতৃত্বকে নিতে হবে। জনগণের অসাহয়ত্ব অনেক বেশি। কারণ জনগণ দেশ পরিচালনার পার্টনারশিপ থেকে বঞ্চিত। ফলে দেশের মালিক জনগণ দেশ পরিচালনায় কন্ট্রিবিউট করার উৎসাহ হারিয়ে ফেলেছে। এ উৎসাহ ফিরিয়ে আনতে পারলে রাজনীতির গুণগত মান উন্নত হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও আইনজীবী



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জাতীয় সংসদ নির্বাচন

৬ ফেব্রুয়ারি, ২০১৯

আরও
আরও পড়ুন