পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের কেন্দ্রভূমি বাংলাদেশ। দেশজুড়েই নানা রকম দৃষ্টিন্দন সৌন্দর্য্য ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। দেশি-বিদেশি পর্যটকদের আকৃষ্ঠ করার মতো অনেক দর্শনীয় স্থান রয়েছে আমাদের এই দেশে। রয়েছে কক্সবাজার সমুদ্র সৈকত। এটি পৃথিবীর দীর্ঘতম সমুদ্র সৈকত। বাংলাদেশে রয়েছে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন। রয়েছে পর্যটক আকর্ষক পৃথিবীর বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবন। বাংলাদেশের অন্যান্য উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে রয়েছে চিড়িয়াখানা, জাতীয় যাদুঘর, জাতীয় সংসদ ভবন, পতেঙ্গা সমুদ্র সৈকত, ময়নামতি, মহাস্থানগড়, লালবাগকেল্লা, আহসান মঞ্জিল, জাতীয় স্মৃতিসৌধ, পাহাড়পুর, সোনা মসজিদ, তাজহাট জমিদার বাড়ি ইত্যাদি। অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্যমন্ডিত সিলেট বিভাগে পর্যটনের অসংখ্য স্পট রয়েছে। রয়েছে অসংখ্য ঐতিহাসিক নিদর্শন। জাফলং, রাতারগুল, বিছনাকান্দিসহ অন্যান্য পর্যটন স্পটে লক্ষ লক্ষ দেশি-বিদেশি পর্যটক আসেন প্রতিবছর। পাহাড়-নদী-বন বৃহত্তর সিলেটের এই প্রকৃতি পর্যটন খাতের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। এটাকে কাজে লাগিয়ে সিলেট বিভাগের পর্যটন শিল্পকে আরও এগিয়ে নেওয়া এখন সময়ের দাবি। আসলে পর্যটনের সীমাহীন উপাদান ও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দিয়ে সৃষ্টিকর্তা আমাদের এই দেশকে সৃষ্টি করেছেন। বৃহত্তর সিলেটও ঠিক তেমনি অসাধারণ পর্যটন সম্ভাবনার এক মনোরম জনপদ। সিলেটকে বলা হয়, দুটি পাতা একটি কুঁড়ির দেশ। মূলতঃ দৃষ্টিনন্দন চা বাগানের জন্যই এই উপাধিতে ভূষিত করা হয়েছে। নৈসর্গিক সৌন্দর্য্যে ভরপুর বৃহত্তর সিলেট। সারা পৃথিবীতে সিলেটের চা বাগানের সুনাম রয়েছে। দেশের উৎপাদিত চায়ের ৯০ শতাংশই বৃহত্তর সিলেটের। বাংলাদেশে মোট ১৬৩টি চা বাগানের মধ্যে ১৩৫টি রয়েছে বৃহত্তর সিলেট অঞ্চলে। সমগ্র সিলেট অঞ্চলে জালের মতো ছড়িয়ে আছে ছোটবড় অসংখ্য হাওর। সিলেট ও মৌলভীবাজার জেলার কয়েকটি উপজেলার বিশাল জায়গা নিয়ে হাকালুকি সিলেটের সর্ববৃহৎ হাওর। বর্ষা মওসুমে হাকালুকি হাওর অনেকটা সাগরের মতো মনে হয়। এই হাওরে প্রায় ৮০টি ছোট এবং প্রায় ৯০টি বড় বিল রয়েছে। শীতকালে এসব বিলে অতিথি পাখিদের আগমনে মুখর হয়ে ওঠে এই এলাকা। শীতকালে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনেক পর্যটক আসেন অতিথি পাখিদের মিলনমেলা দেখার জন্য। সিলেটকেন্দ্রিক পর্যটন সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে পারলে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হওয়ার পাশাপাশি মানুষের কর্মসংস্থানও বৃদ্ধি পাবে। হবিগঞ্জ ও সুনামগঞ্জ জেলায় রয়েছে অসংখ্য পর্যটন স্পট। হবিগঞ্জে রয়েছে দেশের বিখ্যাত রিসোর্ট প্যালেস। হবিগঞ্জ জেলায় রয়েছে অনেক প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন। পর্যটনের জন্য হবিগঞ্জ জেলা ব্রান্ডিং। জেলার দুটি প্রত্নতাত্বিক নিদর্শন শংকরপাশা শাহী জামে মসজিদ ও বিথঙ্গল আখড়াকে পর্যটন বান্ধব করার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে হবিগঞ্জ জেলা প্রশাসন।
মৌলভীবাজার জেলার পর্যটন সম্ভাবনাকেও কাজে লাগিয়ে দেশ তার অর্থনৈতিক শক্তি বৃদ্ধি করতে পারে। এখানে পর্যটনকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে পাঁচতারা মানের গ্রান্ড সুলতান রিসোর্ট। এছাড়া শতাধিক রুচিসম্মত কটেজ রয়েছে। মৌলভীবাজার জেলার শ্রীমঙ্গলে রয়েছে নয়নাভিরাম চা বাগান যা পর্যটকদের আকৃষ্ট করে। মৌলভীবাজার জেলায় রয়েছে দৃষ্টিনন্দন হাওর, রয়েছে পাহাড়, আনারস, লেবু, পান, আগর, রাবার বাগান, বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠির বসবাস, পর্যটকদের আকৃষ্ট করার জন্য আরও রয়েছে বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটি আর আই)। হাওরের অফুরন্ত মূল্যবান জলজ সম্পদ ও শীতের সময় আসা অতিথি পাখি পর্যটকদের আকৃষ্ট করে বারবার। এছাড়াও রয়েছে বন্যপ্রাণী সেবা আশ্রম, ডিনস্টন সিমেট্রি, মাগুরছড়া পরিত্যক্ত গ্যাসকূপ, খাসিয়াপুঞ্জি, নির্মাই শিববাড়ী, বধ্যভূমি ৭১’র মনুমেন্ট, লেবু ও আনারস বাগান। পর্যটকদের রাত্রি যাপনের জন্য এখানে ব্যক্তি মালিকানাধীন হোটেল, রিসোর্ট, রেস্ট হাউজ ও কটেজ দিন দিন বেড়েই চলছে। চা বাগানগুলোতেও রয়েছে কোম্পানি বাংলো। যেখানে রাত্রি যাপন করে প্রকৃতিকে খুব কাছ থেকে উপভোগ করা যায়। এছাড়া রয়েছে খাসিয়া, মণিপুরী, টিপরা, উড়িয়া, সাঁওতালসহ বিভিন্ন ক্ষুদ্র-নৃ-গোষ্ঠি সম্প্রদায়ের বসবাস। এদের বৈচিত্র্যময় জীবনচিত্র, সংস্কৃতি পর্যটকদের বারবার মৌলভীবাজার, শ্রীমঙ্গল ভ্রমণে উৎসাহিত করে। সাতরঙা সুপেয় চা মাধবপুর লেক, সাতগাঁও লেক, শীতলপাটি, দেশি-বিদেশি পর্যটকদের বিশেষভাবে আকৃষ্ট করে। এছাড়াও মাধবকুন্ড জলপ্রপাত, হাইল হাওর, বাইক্কা বিল, কাউয়া দিঘী হাওর, লাউয়াছড়া জাতীয় উদ্যান ইত্যাদি মৌলভীবাজার জেলার ৭টি উপজেলায় ছড়িয়ে আছে শতাধিক ঐতিহাসিক স্থান। মৌলভীবাজার শহরের দরগা মহল্লায় ৩৬০ আউলিয়ার অন্যতম হজরত সৈয়দ শাহ্ মোস্তফা (রহ.) এর মাজার। সবকিছু মিলে মৌলভীবাজার জেলা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় স্থান। তবে যত সম্ভাবনাই থাকুক না কেন সম্ভাবনাগুলোকে কাজে লাগাতে হবে। আমাদের দেশের পর্যটন শিল্পে রয়েছে সঠিক ব্যবস্থাপনা ও পরিকল্পনার অভাব। পর্যটন খাত ১৯৯৯ সালে বিশ্বে শিল্প খাত হিসেবে স্বীকৃতি পায়। বাংলাদেশ হাজার হাজার বছরের ঐতিহ্যে লালিত এক সমৃদ্ধ জনপদ। দেশ যেভাবে অন্যান্য ক্ষেত্রে এগিয়ে যাচ্ছে ঠিক সেভাবে পর্যটন শিল্পে এগুচ্ছে বলে মনে হয় না। তবে একথা স্বীকার করতেই হবে, অন্য যে কোনো সময়ের চেয়ে বর্তমানে পর্যটন শিল্প অনেকাংশে এগুচ্ছে। পর্যটনকে কেন্দ্র করে অনেক দেশই প্রমাণ করেছে পর্যটন হলো গুরুত্বপূর্ণ অর্থনৈতিক শক্তি। প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায় সিঙ্গাপুরের জাতীয় আয়ের ৬৫ শতাংশ, হংকং এ ৫৫ শতাংশ, ফিলিস্তিনে ৫০ শতাংশ, থাইল্যান্ডের ক্ষেত্রে ৩০ শতাংশ ও মালদ্বীপের অর্থনীতির প্রায় পুরোটাই পর্যটন খাতের ওপর নির্ভরশীল। নেপালের জাতীয় আয়ের ৪০ শতাংশের উৎস হলো পর্যটন খাত। মেক্সিকোর মোট রফতানি আয়ের ৭০ শতাংশ আসে পর্যটন খাত থেকে। মালয়েশিয়ার জাতীয় আয়ের সিংহ ভাগই আসে পর্যটন থেকে। বাংলাদেশের পর্যটনের সম্ভাবনাকে আরও বাড়াতে হলে এবং এ শিল্পকে বিকশিত করতে হলে রাস্তাঘাটের উন্নয়ন ঘটাতে হবে। পর্যটকদের নিরাপত্তা ও সব ধরনের সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে। বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের অন্যতম মাধ্যম হচ্ছে এই পর্যটন শিল্প। আমাদের প্রতিবেশী ভারতও পর্যটকদের সুযোগ-সুবিধা বাড়িয়ে, আকৃষ্ট করে অভাবনীয় সাফল্য অর্জন করেছে এ খাতে।
আধুনিক পর্যটন চাহিদা মোতাবেক পরিকল্পিতভাবে পর্যটন শিল্পকে উপস্থাপন করতে হবে। আদিকাল থেকেই বিশ্বের সৌন্দর্য্য পিপাসু মানুষ বিশ্বের এক স্থান থেকে অন্য স্থানে ভ্রমণ করা শুরু করে। বিশ্বের উন্নত দেশের মানুষ শুধুমাত্র একটি দেশের সৌন্দর্য্য উপভোগ করার জন্য ভ্রমণ করে না। তারা অন্য দেশের কৃষ্টি-কালচার, মানুষের জীবন প্রণালী, উৎসব, ইত্যাদি উপভোগ করার জন্যও ভ্রমণ করে থাকে। প্রকৃতির এক অনুপম সৌন্দর্য্যে শোভিত এক দেশ বাংলাদেশ। অসাধারণ ব্যঞ্জনায় কবি বলেছেন ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি/ সকল দেশের রানী সে যে, আমার জন্মভূমি।’ প্রাচীনকাল থেকেই বিদেশিরা এ শ্যামল ভূখণ্ডের প্রশংসা করেছেন। বিশ্ব পর্যটন সংস্থার হিসেব অনুযায়ী, পৃথিবীতে ৭৫০ কোটি জনসংখ্যার মধ্যে পর্যটকদের সংখ্যা ১০০ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। এই ১০০ কোটি পর্যটকদের মধ্যে ৫০ শতাংশ যাচ্ছে ইউরোপে আর ২০ শতাংশ আসছে এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে। বাকীরা অন্য মহাদেশে যাতায়াত করছে। পর্যটনে বিশে^র সম্ভাবনাময় বাজার ধরে রাখতে ভারত, নেপাল, ভূটান, শ্রীলংকা, ইন্দোনেশিয়া, মালদ্বীপ, চীন, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ পৃথিবীর অনেক দেশ পর্যটনের মহাপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে।
বাংলাদেশ একটি জনবহুল, উন্নয়নশীল স্বল্প আয়তনের দেশ হলেও প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য উপভোগ করে যুগে যুগে মুগ্ধ হয়েছেন এদেশে আগত পর্যটকরা। বাংলাদেশ পাহাড়-পর্বত, হাওর-বাওর, খাল-বিল, নদী-সাগর, প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, ঐতিহাসিক মসজিদ, মিনার, পার্বত্য অঞ্চলের পাহাড়ি অঞ্চলসহ নানা বৈচিত্র্যে ভরা আমাদের এই প্রিয় বাংলাদেশ। এজন্যই হয়তো কবি বলেছেন, ‘বাংলার রূপ আমি দেখিয়াছি তাই পৃথিবীর রূপ আমি দেখিতে যাই না আর’ সমতল ভূমির অপরূপ সৌন্দর্য্যরে এ দেশটির নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া পর্যটকদের জন্য অত্যন্ত সহায়ক। পৃথিবীতে এমন আবহাওয়ার দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না। এ দেশে সারা বছরই বেড়ানোর জন্য উপযুক্ত পরিবেশ বিরাজমান। সৃষ্টিকর্তা বাংলাদেশকে যা দিয়েছেন তা পৃথিবীর অন্য কোনো দেশে নাই। আমাদের শুধু প্রয়োজন সাজানো গোছানো। এটি করতে পারলে আমরা পর্যটন খাতের উন্নয়নের মাধ্যমে শক্তিশালী অর্থনীতির দেশের গর্বিত নাগরিক হতে পারবো। ২০১০ সালে সরকার পর্যটন শিল্প বিকাশে সুষ্ঠু নীতিমালার প্রয়োজনীয়তা চিন্তা করে বাংলাদেশে পর্যটন নীতিমালা ২০১০ প্রণয়ন করে। কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও সোনাদ্বীপকে কেন্দ্র করে আদর্শ অবকাশ পর্যটন গড়ে তোলার কথাও নীতিমালায় বলা হয়েছে। বাংলাদেশের পর্যটন শিল্পের সার্বিক উন্নয়ন ও বিকাশের লক্ষ্যে পর্যটন নীতিমালার বাস্তবায়নের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিতে বড় ধরনের সফলতা অর্জন সম্ভব। এজন্য স্বল্প ও দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা গ্রহণ করা প্রয়োজন। বাংলাদেশে পর্যটনে আগ্রহী মানুষের সংখ্যা বাড়ছে। ২০১৬-১৭ সালে ১ কোটির বেশি দেশী-বিদেশী পর্যটক বিভিন্ন পর্যটন স্পটে ভ্রমণ করেছেন বলে গণমাধ্যম থেকে জানা গেছে। রাজস্ব আদায়ের সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিয়েছে পর্যটন খাত। ২০২৫ সালের মধ্যে পর্যটন শিল্পের সর্বোচ্চ বিকাশে স্বল্পমেয়াদী ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়েছে সরকার। পুরো দেশকে ৮টি পর্যটন জোনে ভাগ করে প্রতিটি স্তরে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়নের কথা বলা হয়েছে। ২০০৯ সাল থেকে ৯ বছরে ৬ হাজার ৯৯৯ দশমিক ১৬ কোটি টাকা পর্যটন শিল্পের মাধ্যমে আয় হয়েছে। বর্তমানে দেশের পর্যটন খাত জিডিপিতে ২ দশমিক ১ শতাংশ অবদান রাখছে।
লেখক: ব্যাংকার ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।