পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
আমি গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। তাই নির্বাচনেও বিশ্বাস করি। বিপ্লব বা গণঅভ্যুত্থানের কথা বাদ দিলে নির্বাচন ছাড়া সরকার পরিবর্তনের আর কোনো পথ খোলা নাই। সুতরাং বিএনপি, ২০ দলীয় জোট বা জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট যখন নির্বাচনে যাবে বলে ঘোষণা দেয় তখন তাকে অভিনন্দন জানাতেই হয়। কিন্তু প্রশ্ন হলো, বিএনপি সেই নির্বাচনেই তো গেল, তাহলে বিগত কয়েক মাস ধরে কেন এত ধানাই পানাই? কেয়ারটেকার সরকার না হলে যাবো না, নির্বাচনকালীন সরকার না হলে যাবো না, খালেদা জিয়ার মুক্তি ছাড়া নির্বাচনে যাবো না, বর্তমান সংসদ বাতিল না হওয়া পর্যন্ত নির্বাচনে যাবো না, ইভিএম দিলে নির্বাচনে যাবো না, নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন না করলে নির্বাচনে যাবো না- এই ধরনের কথাবাগ বিএনপি বিগত বছর দুয়েক হলো করে আসছে। ৭ দফা দাবি নিয়ে তারা প্রধানমন্ত্রীর সাতে দুই দফা সংলাপও করে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৭ দফা পেশও করা হয়। কিন্তু তারা সেখান থেকে সম্পূর্ণ খালি হাতে ফেরত এসেছে।
অতীতে আমরা পাকিস্তান আমলে আইয়ূব খান, ইয়াহিয়া খান, বাংলাদেশ আমলে অস্ট্রেলিয়ার গভর্ণর জেনারেল স্যার নিনিয়ার স্টিফেন, জাতিসংঘের অস্কার ফার্নানদেস, বিএনপির মহাসচিব আব্দুল মান্নান ভূঁইয়া এবং আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আব্দুল জলিলের মাঝে সংলাপ দেখেছি। সবগুলো সংলাপই ব্যর্থ হয়েছে এবং পরিণতিতে দেশে ভয়ংকর অশান্তি ও হানাহানি ঘটেছে। সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার পর বিরোধী দল রাজপথে নেমেছে এবং প্রবল গণআন্দোলনের মাধ্যমে তাদের দাবি দাওয়া আদায় করেছে। কিন্তু এই বারই সর্বপ্রথম দেখলাম বিরোধী দল প্রধানমন্ত্র্রীর কাছে ৭ দফা দাবি নামা এবং ১১ দফা লক্ষ্য নিয়ে সংলাপ করেছে এবং সেই সংলাপও অতীতের সংলাপগুলোর পরিণতি ভোগ করেছে। অর্থাৎ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে। এবারও জনগণ মনে করেছিল, সংলাপ ব্যর্থ হওয়ার পর অতীতের ব্যর্থ সংলাপগুলির পদাঙ্ক অনুসরণ করে বিএনপি তথা ২০ দল এবং ঐক্যফ্রন্ট রাজপথে নেমে আসবে। কিন্তু সেটি আর হয়নি।
এব্যাপারে বিএনপি অন্তত দুই বছর ইলেকশনে আসা না আসা প্রশ্নে সম্পূর্ণ ধোঁয়াশা সৃষ্টি করেছিল। অবশেষে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর বিএনপি খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে বাধ্য হয়েছে। মনোনয়ন পত্র জমা দেওয়ার শেষ তারিখ ২৯ নভেম্বর। সুতরাং এখন বিএনপি বলতে বাধ্য হয়েছে যে, তারা নির্বাচনে যাবে এবং গত ১১ ই নভেম্বর রবিবার থেকে বিএনপি ব্যাপক নির্বাচনী তৎপরতা শুরু করেছে।
আসলে সিদ্ধান্তটি নেওয়া ছিল অনেক আগে। প্রকাশ ঘটলো বেশ কয়েক মাস পর। ১০ নভেম্বর ২০১৮ সিদ্ধান্তটি প্রকাশ করেছে। বলেছে, তারা নির্বাচনে যাবে। গত ২২ সেপ্টেম্বর মহানগরী নাট্যমঞ্চে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট আত্মপ্রকাশ করে। বলা হয়েছিল যে, এটি জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠার একটি মঞ্চ। জাতীয় ঐক্য প্রতিষ্ঠা করে জনগণের কয়েকটি দাবি আদায় করা হবে। এই দাবিগুলি হলো, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়। এই সরকার পদত্যাগ করবে এবং সকলের সাথে আলোচনা করে একটি নির্বাচনকালীন সরকার গঠন করা হবে। বিএনপি ঐক্যফ্রন্টের বড় শরিক। ঐক্যফ্রন্ট গঠন করতে গিয়ে বিএনপি ২০ দলকে কিছুটা হলেও উপেক্ষা করে। বলা হয় যে, একটি সংসদ বহাল রেখে আর একটি সংসদ গঠন করা যায় না। তাই বর্তমান সংসদ বাতিল করে নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে হবে। বিএনপি এসব কথা অনেক দিন আগে থেকেই বলছিল। ঐক্যফ্রন্ট গঠিত হওয়ার পর সমস্বরে বলা শুরু করে।
বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের তরফ থেকে বলা হয় যে, বর্তমান নির্বাচন কমিশন এই সরকারের সম্পূর্ণ আজ্ঞাবাহী। এই কমিশনের প্রধান কে. এম নুরুল হুদা একজন খাস আওয়ামী লীগার। ১৯৯৬ সালের নির্বাচনের আগে ম খা আলমগীরের নেতৃত্বে সচিবালয়ের সামনে ঢাকার তৎকালীন মেয়র মরহুম হানিফ যে ‘জনতার মঞ্চ’ তৈরি করেন ঐ মঞ্চের একজন প্রধান উদ্যোক্তা ছিলেন কে. এম নুরুল হুদা। এহেন একটি নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটি সুষ্ঠু নির্বাচন হতে পারে না। সেটি ২০১৪ সালের মতো আওয়ামী মার্কা নির্বাচনই হবে। সুতরাং বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের আর একটি প্রধান দাবি ছিল বর্তমান নির্বাচন কমিশন পুনর্গঠন। বিএনপি এবং ঐক্যফ্রন্টের অপর একটি গুরুত্বপূর্ণ দাবি ছিল নির্বাচনের ১০ দিন আগে থেকে শুরু করে নির্বাচনের পরবর্তী ১০ দিন পর্যন্ত ম্যাজিস্ট্রেসি পাওয়ার দিয়ে সেনাবাহিনী মোতায়েন । এসব কিছুকে ছাপিয়ে বিএনপির সবচেয়ে বড় দাবি ছিল বেগম খালেদা জিয়ার মুক্তি। বিএনপির এমন কোনো নেতা নাই যিনি দাবি করেননি যে বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া তারা ইলেকশনে যাবেন না। সবশেষে রাজশাহীর জনসভাতেও মির্জা ফখরুল বলেন যে, বেগম খালেদা জিয়া ছাড়া কোনো নির্বাচন নয়।
কিন্তু রাজশাহী থেকে ফিরে এসে সব কিছু উল্টে গেল। সকলের আগে বিএনপি সিদ্ধান্ত নেয় যে তারা নির্বাচনে যাবে। এব্যাপারে তারা ঐক্যফ্রন্টের অন্যান্য শরিকদেরকেও টেক্কা মারে। এর আগে বিএনপি তাদের বিভিন্ন অংগ সংগঠন এবং মূল সংগঠনের বিভিন্ন স্তরের নেতা কর্মীদের এক এক করে ডেকে তাদের মতামত গ্রহণ করে। ৩৪ জন বিভাগীয় সম্পাদকদের মধ্যে ৩০ জনই মতামত দেন যে বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া কোনো নির্বাচনে তারা অংশ গ্রহণ করবেন না। মাত্র ৪ জন নিঃশর্তভাবে নির্বাচনে যাওয়া সাপোর্ট করে। এখন ৩৪ জনের মধ্যে ৩০ জনের মতামতকে উপেক্ষা করে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
সবশেষে একটি দাবি পেশ করা হয়েছিল সেটি হলো, সংলাপ শেষ করার আগে যেন তফসিল ঘোষণা করা না হয়। কিন্তু সেকথাও শোনেনি সরকার বা নির্বাচন কমিশন। ঐক্যফ্রন্ট ছাড়াও বিএনপির আর একটি জোট রয়েছে। সেটি হলো ২০ দলীয় জোট। ২০ দলের মধ্যে ১০টি দল মতামত দিয়েছিল যে, বেগম জিয়াকে ছাড়া ইলেকশনে যাওয়া ঠিক হবে না। কিন্তু তাদের মতও উপেক্ষা করা হয়েছে এবং ঐক্যফ্রন্টের মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। এখন তারা নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নেবে ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বাধীন জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। রোববার দুপুরে জাতীয় প্রেসক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ড. কামাল হোসেন এ সিদ্ধান্তের কথা জানান। তুলে ধরা হয়েছে সেই পুরানো বক্তব্য ও আরগুমেন্ট।
দুই
তাহলে নেট ফল কি দাঁড়ালো? বেগম খালেদা জিয়াকে ১৭ বছরের মেয়াদে জেলে রেখে, তারেক রহমানকে আজীবন বিদেশে নির্বাসিত রেখে, হাজার হাজার নেতা ও কর্মীকে জেলে রেখে এবং হাজার হাজার নেতা ও কর্মীকে পলাতক তথা ঘর ছাড়া রেখে বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। ঐক্যফ্রন্টের সাথে মিলে প্রধানমন্ত্রীর কাছে ৭ দফা দাবি পেশ করার পর সব কটি দাবি সরকার সরাসরি প্রত্যাখ্যান করার পরেও বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। গত ১ বছর হলো বিএনপির নেতৃত্বের সর্বোচ্চ পর্যায় অর্থাৎ মির্জা ফখরুল ইসলাম থেকে শুরু করে উপজেলা পর্যায়ের নেতারাও যখন অসংখ্য বার বজ্র কন্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, বেগম খালেদা জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবো না এবং বাংলার মাটিতে নির্বাচন হতেও দেবো না তখন খালেদা জিয়াকে ৫ বছরের জেল বাড়িয়ে ১০ বছরের জেল দেওয়ার পরেও বিএনপি আসন্ন নির্বাচনে যাচ্ছে। এমন কোনো সভা, মানববন্ধন বা সেমিনার নাই যেখানে ড. খন্দকার মোশারফ হোসেন বলেন নাই যে, বেগম জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে যাবো না। সেখানে সংলাপের ঠিক পরদিন বেগম জিয়াকে পিজি হাসপাতাল থেকে নাজিমুদ্দিন রোডের অন্ধকার প্রকোষ্ঠে ঠেলে দেওয়ার পরেও বিএনপি নির্বাচনে যাচ্ছে। ব্যরিষ্টার মওদুদ বিগত ৩ মাস হলো প্রায় প্রতিদিনই বলছেন যে, তফসিল ঘোষণার দিন থেকেই বাংলাদেশে তীব্র ঝড় সৃষ্টি হবে। এই ৩ মাসের প্রায় প্রতিদিনই তিনি কর্মীদের প্রতি আহবান জানিয়েছেন যে, আপনারা রাজপথে নামার জন্য প্রস্তুত হোন। তারপরেও একবারের জন্যও রাজপথে না নেমে বিএনপি নির্বাচনের সহজ সরল পথে ঢুকে গেছে। নির্বাচনে যাওয়ার সিদ্ধান্ত স্থায়ী কমিটির সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য আগে ভাগেই নিয়ে রেখেছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটিতে নির্বাচনে না যাওয়ার বিপক্ষেও মত রয়েছে। যারা ছোটকাল থেকে রাজনীতি করতে করতে বড় হয়েছেন, যারা পুলিশি নির্যাতন ভোগ করেছেন সেই সব নেতা বেগম জিয়াকে ছাড়া নির্বাচনে অংশ গ্রহণ না করার পক্ষে মত দিয়েছেন। স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ^রচন্দ্র রায় বলেছেন, সংলাপে কোনো দাবি না মানার পরেও এই নির্বাচনে অংশ নিলে তা হবে সরকারের এজেন্ডা বাস্তবায়ন। গত ৯ নভেম্বর শুক্রবার রাজশাহীর কেন্দ্রীয় মাদ্রাসা মাঠে অনুষ্ঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন,“ এ অবস্থায় নির্বাচনে গেলে শেখ হাসিনা আজীবন প্রধানমন্ত্রী থাকবে, এখনও নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তেরী হয়নি। তার মধ্যেই বিরোধীদের দাবি উপেক্ষা করে সরকারি দলের ইচ্ছেতে তফসিল ঘোষণা করা হয়েছে। এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে শেখ হাসিনা আজীবন প্রধানমন্ত্রী আর বেগম খালেদা জিয়া আজীবন কারাবন্দি থাকবেন।
গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেন, এই পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে তারেক রহমানকে আজীবন নির্বাসিত থাকতে হবে। এই মঞ্চে যারা আছেন তাদের সাবেক বিচারপতি এস কে সিনহার মত হাতে কাগজ ধরিয়ে দিয়ে বিদেশে পাঠিয়ে দেবে সরকার।
তিন
বড় বড় দাবি তো দূরের কথা, অন্যান্য দাবিও মানা হয়নি যেগুলো লেভেল প্লেয়িং ফিল্ডের জন্য খুব জরুরি। ধরপাকড় বন্ধ হয়নি। তৃণমূল পর্যায়ে নেতা কর্মীরা এখনও বাড়ি ছাড়া এবং ফিউজিটিভ বা পলাতক জীবন যাপন করছেন। হাজার হাজার নয়, বিএনপির লক্ষ লক্ষ নেতা কর্মীর মাথার ওপর গ্রেফতারি পরোয়ানার খড়গ ঝুলছে। এভাবে কত দিন আর মধ্যম সারির এবং তৃণমূলের নেতাকর্মীরা পালিয়ে বেড়াবেন?
তবে ২০ দল বা বিএনপির আগে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টই সর্ব প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে ঘোষণা করেছে যে তারা নির্বাচনে যাবে। শেষ পর্যন্ত একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট।রোববার জাতীয় প্রেস ক্লাবে সংবাদ সম্মেলনে নির্বাচনে অংশ নেয়ার ঘোষণা দিয়ে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের শীর্ষ নেতা ও গণফোরাম সভাপতি ড. কামাল হোসেন। বলেন, দেশে গণতন্ত্র ফিরিয়ে আনতে নির্বাচনে অংশ নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। সেজন্য নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে সরকার ও নির্বাচন কমিশনকে। এজন্য ভোটের তারিখ এক মাস পিছিয়ে নতুন তফসিল ঘোষণার দাবি করেছে ঐক্যফ্রন্ট। গত রবিবার নির্বাচন কমিশনকে পূনরায় তফসিল ঘোষণার আহবান জানিয়ে তিনি বলেন, নির্বাচন এক মাস পিছিয়ে দিতে হবে।নতুন তফসিল ঘোষণা করতে হবে।
ডনর্বাচন কমিশন তফশিল পিছিয়েছে। তা সরকার এটাই চেয়েছিল যে, বিএনপি নিঃশর্তে নির্বাচনে আসুক। বিএনপি তাই করেছে। এখন সরকার খুশি হয়ে বিএনপিকে যদি না চাইতেও কিছু তোহ্ফা দেয় তাহলে অবাক হবো না।
[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।