পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
শুধু ঢাকা নগরী নিয়ে পরিকল্পনা করলে হবে না, ঢাকার বাইরের অন্যান্য নগরী নিয়ে ভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা করা জরুরি। পরিকল্পিত নগরায়নের ক্ষেত্রে নগরের বাসযোগ্যতা, নাগরিকের মানসিক স্বাস্থ্য ও অর্থনৈতিক উন্নয়ন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। বিদ্যমান উন্নয়ন পরিকল্পনায় এসব মূল বিষয় অনেক ক্ষেত্রেই উপেক্ষিত থেকে যাচ্ছে। এমন মতামত ব্যক্ত করেছেন নগর বিশেষজ্ঞরা। সম্প্রতি ‘টেকসই নগর ও জনবসতি’ শীর্ষক এক সেমিনারে বিশেষজ্ঞরা এ মতামত ব্যক্ত করেছেন। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, নগরের পরিধি বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ধারণাগত বিষয়গুলো আরো স্পষ্ট হওয়া প্রয়োজন। নগরের সুষম উন্নয়নের দিকে দৃষ্টি দেয়া জরুরি। বলার অপেক্ষা রাখে না, রাজধানী ঢাকার পরিকল্পিত উন্নয়ন এবং অপরিকল্পিত সম্প্রসারণ নিয়ে যুগের পর যুগ ধরে বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত ব্যক্ত করে আসছেন। এতে যে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ ও সরকার খুব একটা কর্ণপাত করেছে, তা বলা যায় না। সরকারের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ও প্রভাবশালীরা যে যেভাবে পারছে রাজধানীকে অপরিকল্পিতভাবেই সম্প্রসারণ করে চলেছে। রাজধানীর ভেতরে যেমন কোনো ধরনের পরিকল্পনা ছাড়া কাটাছেঁড়া করা হচ্ছে, তেমনি এর সম্প্রসারণের ক্ষেত্রেও সুনির্দিষ্ট কোনো নীতিমালা ও পরিকল্পনা মানা হচ্ছে না। ফলে রাজধানী হয়ে উঠেছে ভারসাম্যহীন এক অপরিকল্পিত নগরীতে।
ঢাকা বিশ্বের বসবাস অযোগ্য নগরীর খেতাব বেশ কয়েকবার পেয়েছে। ‘অসভ্য’ নগরী হিসেবেও চিহ্নিত হয়েছে। যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক গবেষণাপ্রতিষ্ঠান ইকোনমিস্ট ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (ইআইইউ)-এর প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিশ্বের বসবাস অযোগ্য শহর হিসেবে ঢাকা বেশ কয়েকবার চিিহ্নত হয়েছে। ঢাকার স্থিতিশীলতা, স্বাস্থ্যসেবার মান, সংস্কৃতি ও পরিবেশ, শিক্ষা ও অবকাঠামো-এই পাঁচটি মূল বিষয়কে প্রাধান্য দিয়ে তাদের প্রতিবেদন তৈরি করা হয়। এসব সূচকে ঢাকার অবস্থান বরাবরই সর্বনিম্নে ছিল। এখন যে তার উন্নতি হয়েছে তার কোনো নমুনা লক্ষ করা যাচ্ছে না, বরং দিন দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। যানজট, পানিবদ্ধতা, বায়ুদূষণ, শব্দদূষণসহ সামগ্রিক পরিবেশদূষণ সীমাছাড়া হয়ে পড়েছে। এক বিভীষিকাময় পরিবেশে নগরবাসী বসবাস করছে। এ অবস্থার মধ্যেই চলছে রাজধানীর অপরিকল্পিত উন্নয়ন ও সম্প্রসারণ। উল্লেখ করা প্রয়োজন, ঢাকার উন্নয়নে প্রথম মহাপরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল ১৯৬০ সালে। এরপর ১৯৯৫ সালে ২০ বছর মেয়াদের পরিকল্পনা নেয়া হয়। ইতোমধ্যে এই মেয়াদ শেষ হয়েছে। পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঢাকার কী উন্নয়ন হয়েছে, তা নগরবাসী ভালো করেই জানে। তারা দেখছে, দিন দিন রাজধানী স্থবির হয়ে পড়ছে। ন্যূনতম যে নাগরিক সুযোগ-সুবিধা তাদের পাওয়ার কথা, তা অধরাই রয়ে গেছে। সর্বশেষ ২০১৫ সালে নগর উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের তরফে আগামী ২০ বছরের নতুন পরিকল্পনার ঘোষণা করা হয়েছে। এ পরিকল্পনাতেও সুন্দর সুন্দর পদক্ষেপের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। বলা হয়েছে, প্রত্যেক অঞ্চলকে স্বয়ংসম্পূর্ণ নগর এলাকা হিসেবে গড়ে তোলা হবে। ঐসব অঞ্চলে নাগরিক ও কর্মসংস্থানের সুবিধা বিকেন্দ্রীকরণ করা হবে। ঢাকা শহরে দ্রুতগামী পরিবহনসুবিধা থাকবে। চারদিকে থাকবে বৃত্তাকার সড়ক। মূল শহরের সঙ্গে অঞ্চলগুলোর সংযোগও থাকবে। ভূমিস্বল্পতাকে বিবেচনায় নিয়ে এসব পরিকল্পনা করা হবে। শহরের চারপাশে থাকবে বিশেষায়িত জোন। ট্রানজিট স্টেশনকে কেন্দ্র করে কর্মক্ষেত্রের চারপাশে মানুষের বসতির সুযোগ থাকবে। প্লটের পরিবর্তে ব্লক হাউজিংয়ে গুরুত্ব দেয়া হবে। নদী, খাল, জলাশয়, সংরক্ষণ ও পানি নিষ্কাশনের ব্যবস্থা রাখা হবে। প্রাকৃতিক ভারসাম্য ঠিক রাখা হবে। এসব পরিকল্পনার কোনোটিরই বাস্তবায়নের লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না। নগরবাসী দেখছে, যতই দিন যাচ্ছে রাজধানী ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ছে। অথচ একটা সময় এই ঢাকা ছিল বিশ্বের অন্যতম সুন্দর নগরী। এর ভেতর দিয়ে প্রবাহিত ছোট ছোট খাল-নদী ছিল, ছিল বিল-ঝিল। ওয়াসার পরিসংখ্যান অনুযায়ী, রাজধানীতে ছিল ৪৩টি খাল। এর মধ্যে ১৭টির কোনো অস্তিত্ব নেই। বাকি ২৬টি খালের মধ্যে ৫টি ব্যক্তি মালিকানায় রেকর্ড করে নিয়েছে অসাধু চক্র। এখন এমন পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে যে, যেসব খাল রয়েছে সেগুলোও খুঁজে পাওয়া দুষ্কর। দখল-দূষণে এগুলোর অস্তিত্ব বিলীন হয়ে পড়েছে। এগুলো উদ্ধারে ওয়াসার কার্যকর কোনো পদক্ষেপও নেই। শুধু তাই নয়, ঢাকার ড্রেনেজ ব্যবস্থাও অত্যন্ত শোচনীয়। পরিসংখ্যান অনুযায়ী, শতকরা ৬০ ভাগ এলাকায় ড্রেনেজ ব্যবস্থা নেই। পাশাপাশি রাজধানীতে যানবাহন চলাচলের জন্য রয়েছে মাত্র ৭ ভাগ সড়ক। এই পরিমাণ সড়কের আবার ৮০ শতাংশ অপরিকল্পিত ও সরু। ফলে রাজধানীতে পানিবদ্ধতা ও যানজট নিত্যকার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। তার উপর সুষম পরিকল্পনা ছাড়াই এর সম্প্রসারণ হচ্ছে। রাজধানীর অবস্থাই যদি এমন অপরিকল্পিত হয়, তাহলে অন্যান্য বিভাগীয় শহর ও জেলা শহরের কী অবস্থা তা অনুমান করতে কষ্ট হয় না।
শুধু ঢাকা না, দেশের অন্যান্য নগরীকেও পরিকল্পিত উন্নয়নের আওতায় আনার বিকল্প নেই। আলোচ্য প্রতিপাদ্যের ওপর বক্তব্য রাখতে গিয়ে তত্তাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টরের নির্বাহী চেয়ারম্যান ড. হোসেন জিল্লুর রহমান যা বলেছেন তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, নগরী শব্দটা আমরা যখন ব্যবহার করছি, তখনই সব নগরীর সমস্যা সামনে চলে আসে। প্রত্যেক নগরীর মধ্যে বড় রকমের কিছু বাস্তবিক পার্থক্য রয়েছে। আরবান স্প্রেকট্রামের একটা ধারণা আমাদের মাথায় নেয়া খুব জরুরি। এই ধারণায় প্রত্যেকটি নগরীকে নিয়ে একইভাবে চিন্তা করার কথা বলা হয়েছে। আর এ জন্য শুধু ঢাকা নগরী নিয়ে পরিকল্পনা করলে হবে না, ঢাকার বাইরে অন্যান্য নগরীকে নিয়ে অভিন্ন পরিকল্পনা করতে হবে। বলার অপেক্ষা রাখে না, ঢাকার মতো অন্যান্য নগরীও অপরিকল্পিতভাবে গড়ে উঠছে ও সম্প্রসারিত হচ্ছে। এর বিপদটা এখনই কিছু কিছু অনুভূত হচ্ছে, ভবিষ্যতে বিপদটা আরো বাড়বে। নাগরিক পরিবেশ ও সুযোগ-সুবিধার উন্নয়ন না হলে বসবাসকারীদের দুর্ভোগ-বিড়ম্বনার শেষ থাকবে না। তখন ভাংচুর, সংস্কার, পুনর্বিন্যাস ইত্যাদি করতে গেলে নাগরিক দুর্ভোগের সঙ্গে বিপুল আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি সাধিত হবে। কাজেই, এখন প্রতিটি নগরীকে তার অবস্থান ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী পরিকল্পিতভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য একটি মহাপরিকল্পনা প্রণয়ন করা যেতে পারে। যখন এ কথা বলা হচ্ছে যে, আগামীতে বিপুল সংখ্যায় মানুষ নগরীতে উঠে আসবে, জনসংখ্যার একটা বড় অংশ নগরীর অধিবাসী হবে, তখন আগে থেকে চিন্তা-ভাবনা ও পরিকল্পনা গ্রহণ করা জরুরি। এ ক্ষেত্রে নগর বিশেষজ্ঞরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারেন। তাদের পরামর্শ ও দিকনির্দেশনা মতে সরকার পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নে এগিয়ে আসবে, আমরা এমনটাই আশা করি।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।