পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
বেঁচে থাকার জন্য মানুষ এবং প্রাণিক‚লের জন্য বৃক্ষের কোনো বিকল্প নেই। এক একটি বৃক্ষ এক একটি অক্সিজেন ফ্যাক্টরির ভূমিকায় কাজ করে থাকে। বিনা মূল্যে বৃক্ষরাজি পরম মমতায় আমাদের বেঁচে থাকার অতি প্রয়োজনীয় উপাদান অক্সিজেন যোগান দিচ্ছে। আবার বিনা খরচে আমাদের বিষাক্ত কার্বনডাইঅক্সাইড গ্যাস শোষণ করছে। তাই প্রকৃতির কাছে আমাদের সব সময়ই ঋণী হয়ে থাকতে হয়। পৃথিবীর ভারসাম্যের জন্য বৃক্ষরাজির যেমন তুলনা হয় না তেমন বেঁচে থাকার জন্য খাদ্যও জুটিয়ে থাকে বৃক্ষরাজি। কিন্তু পরম বন্ধু বৃক্ষের সাথে পৃথিবীর কিছু লোভী মানুষের বিবাদ এখন চূড়ান্তরূপ নিয়েছে। তাদের দ্বারা নির্বিচারে বৃক্ষরাজির কর্তন চলছে। তাতে মানুষ এবং প্রাণিকূলের ভারসাম্যে চরম বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়ে আমাদের প্রতিবেশ ব্যবস্থায় মারাত্মক হুমকির সৃষ্টি করেছে। একটি দেশের আয়তনের তুলনায় তার ২৫ ভাগ বনভূমি থাকা অত্যন্ত জরুরি। কিন্তু দিন দিন নগরায়ণের ফলে এবং মানুষের নিত্য প্রয়োজনের তাগিদে বনভ‚মির বৃক্ষ আমরা নির্বিচারে নিধন করে চলেছি। তাতে করে এখন আমাদের ১২ থেকে ১৩ শতাংশের বেশি বনভ‚মি নেই, যা অত্যন্ত চিন্তার বিষয়। আমরা কি পরবর্তী জেনারেশনের বসবাসের জন্য একটি অনুকূল প্রতিবেশ তৈরি করবো, নাকি তাদের ভয়ংকর বিরূপ প্রাকৃতিক আক্রোশের মুখে রেখে যাবো, সেটা চিন্তা করার এখনই সময়। কয়েকদিন আগে বেনাপোল হয়ে কলকাতা ঘুরতে গিয়েছিলাম। যশোর থেকে বেনাপোল পার হয়ে ভারতে বনগ্রাম অঞ্চলের বড় বড় বৃক্ষরাজি দেখে অবাক হয়ে গেলাম। বিশাল আকৃতির এক একটা গাছ। গাছের নিচ দিয়ে যখন গাড়িতে চড়ে গেলাম মনে হলো, সড়কে কেউ যেন এসি ফিট করে রেখে গেছে। শীতল বাতাসে প্রাণটাই জুড়িয়ে গেল। বড় বড় বৃক্ষরাজি মাথার ওপর থেকে অক্সিজেন সরবরাহ করে আমাদের শরীরে প্রশান্তির সুবাতাস বইয়ে দিতে লাগলো। ভারতের অংশের বৃক্ষগুলো শক‚নীদের লোভাতুর দৃষ্টি এড়াতে পারলেও আমাদের যশোরের অংশের গাছ কাটার জন্য এক সময় উতলা ভাব লক্ষ করেছিলাম। অনেক সভা-সমাবেশ এবং আন্দোলন করে সড়কের গাছগুলো রক্ষা করা গেছে। কেন মানুষের এতো আপন এবং পরম বন্ধু গাছগুলোকে মানুষের লোভের অনলে পুড়তে হয় তা কারো বোধগম্য নয়। কয়েকদিন আগের একটি খবর দেখে অবাক হয়ে গেলাম। কুয়াকাটার একটি বাঁধ পুর্ণঃ নির্মাণের কারণে লক্ষাধিক গাছ কেটে ফেলতে হবে। ষাটের দশকে নির্মিত বাঁধটি বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে। তাতে এখন গাছ কাটার বিষয়টি উঠে এসেছে। সমুদ্র উপকূলীয় অঞ্চলের এ লক্ষাধিক গাছ কেটে ফেলা হলে তাতে প্রাণি ও পাখির আবাসস্থল বিনষ্ট হওয়ার পাশাপাশি প্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্যের ওপর মারাত্মক বিরূপ প্রভাব পড়বে বলে পরিবেশবাদীরা আশংঙ্কা প্রকাশ করেছেন। এখানে বন বিভাগের সঙ্গে স্থানীয় মানুষদের সাথে একটা ‘ষ্ট্রিপবাগান’ পরিচালনার জন্য একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তি রয়েছে। এতে শতাধিক নারী-পুরুষ উপকারভোগী হয়েছে। কিন্তু বনবিভাগ সে চুক্তি ভঙ্গ করছে বলে জানা গেছে। এভাবেই দেশের সড়কগুলোর পাশ থেকে শতবর্ষী গাছগুলো নির্বিচারে কাটা পড়লেও প্রভাবশালীদের দোর্দন্ড প্রতাপে কারোর করার তেমন কিছুই থাকছে না। বরগুনায় ৩৫০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক তাপ বিদ্যুৎ কেন্দ্রের কাজ প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। প্রকল্পের কাছে বন বিভাগের সৃজিত বন রয়েছে। প্রকল্পের কারণে এখন পরিবেশ বিপর্যয়ের আশঙ্কা করা হচ্ছে। যদিও বন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তারা বলছেন, আশপাশের সৃজিত বন কিছুটা ক্ষতির মুখে পড়বে। কিন্তু বাস্তবে টেংরাগিরি বনাঞ্চলের দূরত্ব ৬ দশমিক ৩৮ কিলোমিটার এবং সুন্দরবন ২১ কিলোমিটার দুরত্বে অবস্থান করছে। এ প্রকল্পের কারণে, প্রাকৃতিক খাল ও কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্থ হবে। ধ্বংস হবে জীববৈচিত্র্য। উক্ত বনাঞ্চলের কারণে ঘূর্ণীঝড় সিডর, আইলা, মহাসেনসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ছিল অনেক কম। তাছাড়া বামন উপজেলার ডৌয়াতলা সড়কের দুই পাশের গাছ কেটে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে। প্রাকৃতিক এবং সামাজিক বনায়নের ওপর যে লোভাতুর চক্রের থাবায় নির্বিচারে গাছ ধ্বংস হচ্ছে তা পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলেই মনে হচ্ছে। প্রশাসন নিরব থাকায় দেখারও কেউ নেই। প্রভাবশালীরা এভাবেই বৃক্ষরাজির ক্ষতিসাধন করে চলেছে। এই বন ধ্বংস হলে ভবিষ্যতে উপক‚লের মানুষের জীবন হুমকির মুখে পড়বে।
খুলনা, বাগেরহাট ও সাতক্ষীরা জেলায় অবস্থিত পৃথিবীর বৃহত্তম প্রাকৃতিক ম্যানগ্রোভ বন হচ্ছে সুন্দরবন। বঙ্গোপসাগরের কোল ঘেঁষে এ বন অবস্থিত। এ বনভূমির আয়তন হচ্ছে ৬ লাখ ১ হাজার ৭ হেক্টর জমি, যা দেশের আয়তনের ৪ দশমিক ১৩ শতাংশ। অন্যদিকে দেশে ১৯৬০ সালের শুরু দিকে বনসম্প্রসারণ সর্ব প্রথম বনায়ন কর্মসূচি হাতে নেয়া হয়। তা ১৯৮১-৮২ সালে উত্তরবঙ্গের ৭টি জেলায় কমিউনিটি ফরেষ্ট্রী প্রকল্পের মাধ্যমে সরকারি বনভূমিতে বনায়নের জন্য জনগণের অংশীদারিত্বমূলক সামাজিক বনায়ন শুরু হয়। ২০০০ সালের সামাজিক বনায়নকে ১৯২৭ সালের বন আইনের আইনি কাঠামোতে নিয়ে আসা হয়। সামাজিক বনায়নকে আরও শক্তিশালী করার জন্য সরকার ২০০৪ সালে সামাজিক বনায়ন বিধিমালা প্রবর্তন করে। দেশের সামাজিক বনায়ন বিধিমালাকে আরো কার্যকর করার জন্য সামাজিক বনায়ন ২০১০ প্রনয়ণ করা হয়েছে। ১৯৬৫ সাল থেকে নোয়াখালী, ভোলা, পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুর, চট্টগ্রাম এবং কক্সবাজার জেলার উপক‚লীয় এলাকায় জেগে ওঠা চরে বনসৃষ্টি করা হয়েছে। এ বনকে প্যারা বন বলা হয়। তার পরিমাণ ১ লাখ ৯৬ হাজার হেক্টর। প্রাকৃতিক বনের মতো এ বনেও জোয়া ভাটা হয়। এদিকে শালবন রয়েছে গাজীপুর, টাঙ্গাইল, ময়মনসিংহ ও শেরপুর অঞ্চলে, যার আয়তন প্রায় ১ লাখ ২০ হাজার হেক্টর। অপদিকে রাঙ্গামাটি, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, কক্সবাজার, সিলেট, মৌলভীবাজার এবং হবিগঞ্জে রয়েছে পাহাড়ী বন, যার আয়তন প্রায় ১৩ লাখ ৭৭ হাজার হেক্টর, যা এখন বিলীন হয়ার পথে। তাছাড়াও হাওরাঞ্চলে রয়েছে জলাভূমির বন। এ বন সিলেট এবং সুনামগঞ্জে অবস্থিত। বছরের অর্ধেক সময় তা পানির নিচে তলিয়ে থাকে। যার পরিমাণ ২ শত ৪ দশমিক ২৫ হেক্টর।
জলবায়ু পরিবর্তনের নেতিবাচক প্রভাবের মোকাবেলা করা জন্যে বাংলাদেশে যে ধরনের কৌশল অবলম্বন করা হয়েছে তার মধ্যে ২০০৯ সালে কর্মকৌশলের আলোকে স্বল্প, মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদী প্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মানুষ, জীববৈচিত্র্র ও প্রকৃতির উপর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলায় অভিযোজন, প্রশমন, প্রযুক্তি উন্নয়ন ও হস্তান্তর, সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং অর্থায়নের ব্যবস্থা গ্রহণ প্রভৃতি কার্যক্রম রয়েছে। কার্বন নিঃসরণের মান কমানোর লক্ষ্যে পরিবেশ বান্ধব প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধিকরণ, সরকারের উন্নয়ন ও অনুন্নয়ন বাজেটের বাইরে জলবাযু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকি মোকাবেলায় তহবিল ব্যবহার, বিশেষ কর্মসূচি বাস্তবায়ন এবং টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপযুক্ত পরিকল্পনা গ্রহন এবং বাস্তবায়ন, জলবাযু পরিবর্তন মোকাবেলায় তৃণমূল পর্যায়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠির প্রাতিষ্ঠানিক, সামাজিক সক্ষমতা বৃদ্ধি ও মানব সম্পদ উন্নয়ন গ্রহণ করা হয়েছে।
২০০৯-২০১০ সালে আইপিএসি প্রকল্পের আওতায় সুন্দবনের কার্বনের পরিমাণ নির্ণয়ের জন্য একশত ৫০টি কার্বন ইনভেন্টরি প্লট চিহ্নিত করে মানচিত্র তৈরি করা হয় এবং কর্মকর্তাদের প্রশিক্ষণের আওতায় আনা হয়। কার্বনের পরিমাণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন স্তরের ৫টি কার্বন-পুল বিবেচনায় আনা হয়। তার মধ্যে ভূমির উপরের গাছ, ভূ-নিম্নস্ত গাছের অংশসমূহ ও ছোট এবং অপেক্ষাকৃত বড় চারাসমূহ, পতিত কাঠ এবং মাটির নিচের শূণ্য থেকে ১০০ সেমি পর্যন্ত গভীরের মাটির অংশ, ভূমির উপরি ভাগের এবং ভূমির নিম্মস্থ কার্বন পূল স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক উভয় প্রকার এবং প্রজাতিভিত্তিক কাঠের ঘনত্বের সারনি নির্ণয় করা হয়। মাটিতে মজুত কার্বনের পরিমাণ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে কার্বন ঘনত্ব, মাটির বাল্ক ডেনসিটি ও মাটির গভীরতার বিস্তৃত বিবেচনা করা হয়। এতে করে সুন্দর বনের কার্বনের পরিমাণ পাওয়া যায় গড় কার্বন ঘনত্ব ২ শত ৫৬ দশমিক ৬ মেগাগ্রাম/হেক্টর। এদিকে সুন্দবনে ভূমির পরিমাণ প্রায় ৪ লাখ ১১ হাজার ছয়শত তিরানব্বই হেক্টর, সুন্দবনের মোট কার্বন মজুদ রয়েছে ১ শত পাঁচ দশমিক ৬ মেগাটন। আর এর সমপরিমাণ ভূমিতে কার্বন ডাইঅক্সাইড রয়েছে ৩ শত ৮৭ দশমিক ৭ মেগাটন।
তবে বনায়নের ক্ষেত্রে ভুটান অনেকটা এগিয়ে আছে। কার্বন শোধনেও এগিয়ে। ভুটানের আয়তন হলো ৩৮ হাজার ৩ শত ৯৪ বর্গকিলোমিটার। দেশের স্থল ভাগের প্রায় ৭০ ভাগই বনভ‚মি রয়েছে সেখানে। তারা কৃষি এবং বনজ সম্পদের ওপর বেশির ভাগ নির্ভরশীল। দেশটি ৩৫ লাখ টনেরও কম কার্বন ডাইঅক্সাইড নিঃসরন করে থাকে। আর এর তিনগুণ কার্বনডাই অক্সাইড ভুটানের বনাঞ্চল শোষণ করে। ভুটান হলো বিশ্বের একমাত্র দেশ যেখানে সংবিধানের মাধ্যমে বনভূমি রক্ষা করা হয়ে থাকে। তাদের সংবিধানে বলা হয়েছে, তাদের দেশের ভূখন্ডের ৬০ শতাংশ বনভূমি থাকা বাধ্যতামূলক। তাছাড়া বিশ্বে আরো কয়েকটি দেশ রয়েছে যারা কার্বন নিঃসরন কম করে এবং শোষণ করে বেশি। তার মধ্যে রয়েছে-নিউজিল্যান্ড, কানাডা এবং স্পেন। তবে বিজ্ঞান বিষয়ক এক জার্নাল থেকে জানা যায়, একদল বিজ্ঞানী বায়ুমন্ডল থেকে কার্বন ডাইঅক্সাইড নিয়ে তা বের করে তরল, গ্যাসোলিন, ডিজেল বা জেট এর জ্বালানিতে রূপান্তর করার কৌশল আবিষ্কার করেছেন। কানাডীয় প্রতিষ্ঠান কিছুটা চুনাপাথর, হাইড্রোজেন আর বাতাস ব্যবহার করেছে। গবেষকরা বলেছেন, ৯৪ ডলার খরচ করলেই বায়ু মন্ডল থেকে ১ মেট্রিক টন কার্বন ডাইঅক্সাইড সরানো সম্ভব হবে। এতে পরিবেশের দুষন কমবে এবং পরিবেশ বান্ধব জ্বালানি তেল উৎপাদিত হবে।
লেখক : সাংবাদিক ও কলামিস্ট
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।