Inqilab Logo

শনিবার ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৭ জামাদিউল সানী ১৪৪৬ হিজরি

জননিরাপত্তা ভয়াবহ হুমকিতে

প্রকাশের সময় : ২৮ এপ্রিল, ২০১৬, ১২:০০ এএম

দেশের কোটি কোটি মানুষ এখন চরম নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছেন। রাস্তার চায়ের দোকানদার, বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, সাংবাদিক, পুলিশ, কারারক্ষী, মসজিদের ইমাম-মুয়াজ্জিন, মন্দিরের পুরোহিত, সোশ্যাল মিডিয়ার লেখক থেকে শুরু করে ক্যান্টনমেন্ট বা কূটনৈতিক পাড়ার বাসিন্দা পর্যন্ত কেউই এখন নিরাপদ বোধ করতে পারছে না। সর্বত্রই গুপ্তহত্যা, খুন, অপহরণের আতঙ্ক-উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। এমন নিরাপত্তাহীনতা নিয়ে কোন জাতি সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সামনের দিকে এগোতে পারে না। হঠাৎ করেই এই হত্যা-গুম-খুনের আতঙ্ক সারাদেশে ছড়িয়ে পড়েনি। দীর্ঘ কয়েক বছরে ধীরে ধীরে তা বর্তমান পর্যায়ে এসে উপনীত হয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই রাজধানীসহ দেশের কোথাও না কোথাও লোমহর্ষক, দুর্ধর্ষ ও চাঞ্চল্যকর হত্যাকা- সংঘটিত হচ্ছে। দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো এসব চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ের কোনটিরই কোন ক্লু খুঁজে পাচ্ছে না। চাঞ্চল্যকর হত্যাকা-ে সন্দেহভাজনরা ধরা পড়লেও তদন্ত ও বিচারের প্রক্রিয়া ও দীর্ঘসূত্রতা দেখে বিচারপ্রার্থী পরিবার ও সাধারণ মানুষ হতাশ ও বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠছে। নারায়ণগঞ্জের সাতখুন মামলা ইতিমধ্যে দুইবছর অতিক্রম করেছে। গতে কয়েকদিনের পত্র-পত্রিকায় এই মামলার প্রধান আসামি এবং তার অনুগত বাহিনীর দ্বারা বাদীপক্ষ ও সাক্ষীদের ভয়ভীতি প্রদর্শনের খবর পাওয়া গেছে। স্বজন হারানো বিচারপ্রার্থী পরিবারের সদস্যরাও এখন চরম নিরাপত্তাহীনতা বোধ করছে। খুনের প্রত্যক্ষদর্শী সাক্ষীরা প্রাণের ভয়ে সাক্ষী দিতে না গেলে বিচার প্রলম্বিত অথবা সুবিচার নিশ্চিতভাবেই বাধাগ্রস্ত হবে।
এহেন বাস্তবতায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করবে, সর্বসাধারণের জানমালের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে, এটাই প্রত্যাশিত। অথচ বাস্তবতা সম্পূর্ণ ভিন্ন। একের পর দুর্ধর্ষ হত্যাকা- সংঘটিত হওয়ার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এবং আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্মকর্তারা কখনো ‘বিচ্ছিন্ন ঘটনা’ বলে কখনো বিরোধী দলের উপর দায় চাপিয়েই যেন দায়িত্ব শেষ করতে চাচ্ছেন। রাজশাহীতে অধ্যাপক রেজাউল করিম, কাশিমপুর কারাগারের সাবেক কারারক্ষী রুস্তম আলী হত্যাকা- থেকে সৃষ্ট আতঙ্ক ও বিস্ময়ের মধ্যেই গত মঙ্গলবার রাজধানীর কলাবাগানের এক বাসায় ঢুকে দু’জনকে নির্মমভাবে কুপিয়ে হত্যা করে পালিয়ে যায় দুর্ধর্ষ খুনিরা। এসব হত্যাকা-কে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী পরিকল্পিত হত্যাকা- বলে অভিহিত করছে, অনেক ক্ষেত্রেই তাদের হাতে ভিডিও ফুটেজ থাকলেও পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো অপরাধী ধরতে চরমভাবে ব্যর্থ হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে পুলিশের ব্যর্থতা বা অসহায়ত্ব অনেকটাই প্রমাণিত। পুলিশের এই অসহায়ত্ব জনমনে নিরাপত্তাহীনতার বোধ বাড়িয়ে তুলছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর কর্তৃপক্ষ বাহিনীকে এই ব্যর্থতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে জনগণের নিরাপত্তা ও অপরাধীদের বিচারের সম্মুখীন করার কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের বদলে যদি ব্লেইমগেমসহ ভিন্ন কথা বলেন, তাহলে জনগণ যাবে কোথায়? পুলিশকে রাজনৈতিক ভূমিকা এবং দলীয় দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে এসে জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় দৃঢ় মনোবল নিয়ে কাজ করতে হবে।
হত্যাকা- বৃদ্ধিতে শুধু দেশের মানুষই নয়, উন্নয়ন সহযোগী এবং বিশ্বসম্প্রদায়ের প্রতিনিধিরাও উদ্বেগ প্রকাশ করছেন। বিভিন্ন হত্যাকা-ের সাথে পুলিশ একদিকে তথাকথিত জঙ্গি ও উগ্র মৌলবাদী গোষ্ঠীর জড়িত থাকার সন্দেহ করছে, অন্যদিকে পুলিশের মহাপরিদর্শক জনগণকেই নিজেদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার পরামর্শ দিচ্ছেন। ক্রমবর্ধমান হত্যাকা- এবং পুলিশের ব্যর্থতার কারণ উদঘাটনে পুলিশে রাজনৈতিক নিয়োগ এবং রাজনৈতিক কাজে ব্যবহারকেই দায়ী করছেন বিশ্লেষকরা। পুলিশ ঘরে ঘরে নিরাপত্তা দিতে না পারলেও পুলিশের রাজনৈতিক নিয়োগ, আঞ্চলিকতা, স্বজনপ্রীতি, নিয়োগ ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে দুর্নীতি বন্ধে কি উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে, এ বিষয়ে কিছুই বলছে না পুলিশ কর্তৃপক্ষ। জনগণের ট্যাক্সের টাকায় বেতনভুক পুলিশ ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো জনগণের নিরাপত্তা এবং অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে না পারলে এই বাহিনী পোষণের প্রয়োজনীয়তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠা অস্বাভাবিক নয়। প্রতিদিন গড়ে ১১টি খুনের ঘটনা ঘটছে বলে গতকাল একটি পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্ট থেকে জানা যায়। জাতিসংঘ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মহলের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীরা আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতিকে সন্তোষজনক বলে মন্তব্য করছেন। গত দু’তিন দিনের হত্যাকা-গুলোকে টার্গেট কিলিং বলে অভিহিত করেছেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। হত্যাকা- যেভাবেই ঘটুক, যে বা যারাই এর সাথে সম্পৃক্ত থাকুক, তাদেরকে চিহ্নিত করে জনমনে নিরাপত্তার বোধ নিশ্চিত করাই আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দায়িত্ব। পুলিশের ব্যর্থতা বা অসহায়ত্ব অনেকটা পরিষ্কার। এ থেকে উত্তরণের পথ সরকার ও পুলিশ প্রশাসনকেই বের করতে হবে। ঘরে ঘরে পাহারা বসানো সম্ভব না হলেও রাজনৈতিক কাজে ব্যবহার বন্ধ করে পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের পেশাগত সততা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার নিরিখে জননিরাপত্তায় দায়িত্ব পালনের সুযোগ নিশ্চিত করা অসম্ভব নয়। ব্লেইমগেম বা অন্যের ঘাড়ে দোষ চাপিয়ে দায়িত্ব এড়ানোর চেষ্টা পরিস্থিতিকে আরো জটিল করে তুলতে পারে। পুলিশ ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পেশাগত দক্ষতা ও দলনিরপেক্ষ ভূমিকাই পরিস্থিতির উন্নয়নে কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে। এ ব্যাপারে সরকার ও পুলিশ কর্তৃপক্ষের সদিচ্ছা একান্তভাবেই কাম্য।



 

দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।

ঘটনাপ্রবাহ: জননিরাপত্তা ভয়াবহ হুমকিতে
আরও পড়ুন