পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
সংশ্লিষ্ট সব অংশীজনদের হতাশ করে অবশেষে বহুল আলোচিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে স্বাক্ষর করেছেন প্রেসিডেন্ট মো: আব্দুল হামিদ। গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাস হওয়ার পর দেশের সাংবাদিক সমাজ, সম্পাদক পরিষদ, দেশিবিদেশী মানবাধিকার সংস্থা, নাগরিক সমাজ এবং সচেতন জনমনে ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে একটি কালো আইন আখ্যায়িত করে দেশের সাংবাদিক সমাজ ও সম্পাদক পরিষদ নিজেদের মধ্যকার সব মতপাথর্ক্য ভুলে গিয়ে এই আইনের বিরুদ্ধে ঐকবদ্ধ প্রতিবাদি ভ’মিকা পালন করে। বৃহত্তর সাংবাদিক সমাজ এবং সম্পাদক পরিষদ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের যে সব ধারা সাংবাদিকের পেশাগত নিরাপত্তা এবং মত প্রকাশের স্বাধীনতার সাংবিধানিক অঙ্গিকারকে ক্ষুন্ন করে সরকারের কাছে এমন ধারাগুলো বাদ দেয়ার আহ্বান জানিয়েছিল। তথ্যমন্ত্রীসহ সরকারের ৩জন মন্ত্রীর আশ্বাসে আশ্বস্ত হয়ে সম্পাদক পরিষদ তাদের পূর্ব ঘোষিত কর্মসূচি স্থগিত করেছিল। তারা বলেছিলেন, মন্ত্রী পরিষদের পরবর্তি বৈঠকে ডিজিাটাল নিরাপত্তা আইনের আপত্তিজনক ধারাগুলো নিয়ে আলোচনা করা হবে এবং প্রয়োজনীয় সংশোধন সাপেক্ষে তা রাষ্ট্রপতির অনুমোদনের জন্য পাঠানো হবে। সরকারের মন্ত্রীরা তাদের ওয়াদা রক্ষা করেননি। তারা মন্ত্রী পরিষদ বৈঠকে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের আপত্তিজনক ধারাসমুহ নিয়ে কোন আলোচনা না করে এবং সংশোধন ছাড়াই প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের মাধ্যমে নিবর্তনমূলক ধারা সম্বলিত ডিজিটাল নিরাপত্তা বিলটি চুড়ান্তভাবে আইনে পরিণত হল।
এমনিতেই দেশের গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, জননিরাপত্তা ও আইনের শাসন চরমভাবে প্রশ্নবিদ্ধ। বিরোধিদল ও জোটকে নির্বাচনের বাইরে রেখে ভোটারবিহীন দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের গণতন্ত্র বিশ্বের কাছে প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে। এবার একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সুষ্ঠু অবাধ ও অংশগ্রহণমূলক করার মধ্য দিয়ে দেশকে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রত্যাবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ধাপ অতিক্রম করার প্রত্যাশা দেশের গণতন্ত্রকামী মানুষের। শুধু নির্বাচনই গণতন্ত্রের একমাত্র শর্ত নয়। স্বাধীন মত প্রকাশ ও গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সুরক্ষা গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার অন্যতম মানদন্ড। মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করে, অপব্যবহারের পথ বন্ধ না করে, কোন বাস্তব শর্ত বা মানবাধিকার সুরক্ষার ব্যবস্থা না করে, প্রত্যাশিত কোন সংশোধনের তোয়াক্কা না করে পাসকৃত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের পেশাগত নিরাপত্তা এবং গণমাধ্যম ব্যবস্থাপনার উপর বড় ধরনের অগণতান্ত্রিক খড়গ হিসেবে বিবেচনা করছেন সংশ্লিষ্ট মহল। সারাবিশ্বেই ডিজিটাল নিরাপত্তার ঝুঁকি থাকলেও বিশ্বের কোথাও এ ধরনের নিবর্তনমূলক আইন প্রণীত হয়নি। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দেশের সাংবাদিক সমাজ, সম্পাদক পরিষদ, মানবাধিকার সংস্থাসহ আন্তর্জাতিক মহলের উদ্বেগের মধ্যেও আমাদের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী বিশ্বে প্রথম এ ধরনের আইন পাস করার মধ্য দিয়ে নিজেকে ধন্য বলে জাহির করেছেন। আইনটি সংশোধনে সম্পাদক পরিষদসহ সংশ্লিষ্ট অংশীজনদের প্রতিশ্রুতি দেয়ার পরও কোন সংশোধন না করেই, নিবর্তনমূলক ও আপত্তিজনক ধারাসহ ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটি প্রেসিডেন্টের স্বাক্ষরের মধ্য দিয়ে চুড়ান্তভাবে পাস হওয়ার ঘটনা আমাদের দেশ, জাতি,রাষ্ট্র, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যমের জন্য বিপজ্জনক, উদ্বেগজনক এবং নাগরিক সমাজের জন্য দু:খজনক।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রস্তাবনার শুরু থেকেই আইনটি ব্যাপকভাবে সমালোচিত, পরিত্যাজ্য ও ধিকৃত হয়ে আসছে। এমনকি সংসদের বিরোধিদলের সদস্যরাও এই আইনের তীব্র বিরোধিতা করে আইনটি জনমত যাচাই ও সংশোধনের জন্য পাঠানোর সুপারিশ করলেও তাদের যৌক্তিক দাবী উপেক্ষা করে সরকার শুধুমাত্র সংসদে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতার জোরে কণ্ঠভোটে পাস করিয়ে নিয়েছিল। এরপরও আশা ছিল জনমত এবং সংশ্লিষ্ট স্টেহোল্ডারদের দাবীর প্রেক্ষিতে প্রেসিডেন্ট হয়তো বিলটির প্রয়োজনীয় সংশোধনীর জন্য ফেরত পাঠাবেন। এ অবস্থায় সম্পাদক পরিষদ, সাংবাদিক সমাজ, গণমাধ্যম কর্মী ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের সম্ভাব্য ভুক্তভোগী সব পক্ষই প্রতারিত ও হতাশা বোধ করছেন বলেই প্রতিয়মান হয়। প্রেসিডেন্ট এই আইনে স্বাক্ষর করার পর দেশের সাংবাদিক নেতৃবৃন্দ এবং সম্পাদক পরিষদের প্রতিনিধিরা তীব্র ক্ষোভ, হতাশা ও বিষ্ময় প্রকাশ করেছেন। এর মধ্য দিয়ে সাংবাদিক ও গণমাধ্যম বান্ধব ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রত্যাশা ও প্রতিশ্রুতি মিথ্যা বলে প্রমাণিত হল। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী, সাংবাদিক নেতা ও সম্পাদক পরিষদের সদস্যরা সমাজের যে স্তরের মানুষ তাদের পারস্পরিক প্রতিশ্রুতি যদি যথাযথভাবে রক্ষা করা না হয়, তাহলে ভবিষ্যতে তাদের মধ্যকার যে কোন বোঝাপড়া বিশ্বাস ও আস্থার সংকটে পড়তে পারে। ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে দেশের সাংবাদিক সমাজ ও নাগরিকদের উদ্বেগ ও ক্ষোভ সত্বেও মন্ত্রীদের প্রতিশ্রুতিতে আশ্বস্ত হয়ে সম্পাদক পরিষদ আন্দোলন-বিক্ষোভ কর্মসূচি স্থগিত করলেও সরকারের সংশ্লিষ্টরা তাদের প্রতিশ্রুতি পূরণে পুরোপুরি ব্যর্থ হয়েছেন। তারচেয়েও বড় কথা হচ্ছে, নিবর্তনমূলক আইন পাশের মধ্য দিয়ে দেশের গণতন্ত্র, গণমাধ্যম ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা চরম ঝুঁকির মধ্যে পড়েছে। কোন গণতান্ত্রিক সমাজে এ ধরনের আইন থাকতে পারেনা। তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নিয়ে ব্যাপক গণবিক্ষোভ দেখা দেয়ার পর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন পাসের মধ্য দিয়ে ৫৭ ধারা বিলোপের ঘোষণা দেয়া হলেও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে ৫৭ ধারাকে ভেঙ্গে আরো কঠোর আঙ্গিকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। সেই সাথে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ৩২ ধারাসহ বিতর্কিত ও নিবর্তনমূলক সব ধারাই অক্ষুন্ন রাখা হয়েছে। দেশের সাংবাদিক সমাজ, গণমাধ্যমকর্মী এবং নাগরিক সমাজের পাশাপাশি বিএনপিসহ গণতন্ত্রকামী রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ এই আইন প্রত্যাখ্যানের ঘোষণা দিয়েছেন। আইনের দৃষ্টিতে হয়তো সাংবাদিক, নাগরিক সমাজ ও রাজনৈতিক মহলের প্রত্যাখ্যান তেমন কোন গুরুত্ব বহন করেনা। তবে নির্বতনমূলক আইনের দ্বারা জনমত, জনপ্রত্যাশা, জনগণের সংক্ষোভ দমনের প্রয়াস কখনো সুফল বয়ে আনেনা।
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।