পবিত্র লাইলাতুল বরাত
আজ দিবাগত রাত পবিত্র লাইলাতুল বরাত। পরম করুণাময় আল্লাহতায়ালা তার বান্দাদের গুনাহ মাফ, বিপদমুক্তি ও
পার্লামেন্টে ১৯ সেপ্টেম্বর পাস হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ২০১৮। আইনটি প্রস্তাবের পর থেকেই সাংবাদিক, আইনবিদ, মানবাধিকারকর্মী ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিরা গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করে আসছিলেন। এখন আইনটির অনেক ধারায় হয়রানি ও অপব্যবহার হতে পারে বলে চলছে আলোচনা-সমালোচনা। আবেগ-উত্তাপ ও যৌক্তিক তর্ক-বিতর্ক এখনো চলছে, চায়ের দোকান থেকে টেলিভিশন টক শো ও পত্রিকার কলাম পর্যন্ত। সন্দেহ নেই আরো কিছুকাল চলবে। চলাটাই স্বাভাবিক।
এ আইনটিতে মোট ৪৮টি ধারা আছে। এর মধ্যে ১৭ থেকে ৪৮ ধারায় বিভিন্ন অপরাধ ও শাস্তির বিধান রয়েছে। ডিজিটাল আইনের ৩২ ধারায় বলা হয়েছে, সরকারি, আধাসরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে কেউ যদি বেআইনিভাবে প্রবেশ করে কোনো ধরনের তথ্য-উপাত্ত, যে কোনো ধরনের ইলেকট্রনিক যন্ত্রপাতি দিয়ে গোপনে রেকর্ড করে, তাহলে সেটা গুপ্তচরবৃত্তির অপরাধ হবে এবং এ অপরাধে সেই ব্যক্তি ১৪ বছর কারাদন্ড ও ২০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবেন।
নতুন এ আইনের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের কথা বলার স্বাধীনতা আরও সংকুচিত হয়ে উঠেছে। সংবাদমাধ্যমের স্বাধীনতা ও সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ আরও কঠিন হয়ে পড়েছে। বিশেষত সরকারি প্রতিষ্ঠানে বেআইনিভাবে প্রবেশ করে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ, ছবি তোলা, ভিডিও করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। এখানে বেআইনি শব্দটি ব্যবহার করে সাংবাদিকদের তথ্য সংগ্রহ এবং ফটো বা ভিডিওচিত্র ধারণকে বন্ধ করাই উদ্দেশ্য। এ ধরনের কাজকে গুপ্তচরবৃত্তি বা রাষ্ট্রদ্রোহ বলে তথ্য সংগ্রহের কাজটি আরও কঠিন করে ফেলা হয়েছে। এটা মুক্ত সাংবাদিকতার জন্য চরম হুমকিস্বরূপ। এতে করে সাধারণ মানুষ ভয়ে থাকবে এবং মুক্ত আলোচনা বা ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আলোচনা করতে আর সাহস পাবে না। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারা নতুন আইনের ১৮ ও ১৯ ধারায় রীতিরকম ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
বিনা অনুমতিতে অফিসে ঢুকে কেউ যদি তথ্য নেন, সে জন্য অন্য আইন আছে। কেউ যদি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্য বা ফাইল পাচার করে রাষ্ট্রের ক্ষতি করেন, তার জন্য ‘অফিসিয়াল সিক্রেট অ্যাক্ট’ আছে। কিন্তু নতুন আইনে আবার তা পুনঃপ্রবেশ ঘটানো হয়েছে। ফলে কোনো সাংবাদিক এখন আর ঘুষ বা দুর্নীতির তথ্য প্রকাশ করতে পারবে না। অন্যদিকে সাধারণ মানুষ যদি কোনো সরকারি বা আধাসরকারি প্রতিষ্ঠানে গিয়ে ঘুষ দিতে বাধ্য হন আর তা যদি তিনি তার মোবাইল ক্যামেরায় ধারণ করে আনেন, তবে তা প্রকাশ করতে পারবেন না। অর্থাৎ ঘুষ খেলেও তার তথ্য প্রকাশ করা যাবে না। তাহলে পরিস্থিতি সুশাসনের বিপক্ষে যাবে। আর সাংবাদিকতা নিঃসন্দেহে অসুবিধার মুখে পড়বে।
তবে এ আইনের অনেক ভালো দিকের অন্যতম হচ্ছে দেশকে অপপ্রচার থেকে রক্ষা করা এবং ধর্মনিরপেক্ষ চেতনার প্রসার ঘটানো। আইনের ২১ ধারার ডিজিটাল মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ বা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বা জাতির পিতার নামে প্রোপাগান্ডা বা প্রচারণা চালালে বা মদদ দিলে অনধিক ১৪ বছরের কারাদন্ড বা এক কোটি টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড রাখা হয়েছে। আর ধর্মীয় মূল্যবোধ বা অনুভূতিতে আঘাত দেওয়ার জন্য ওয়েবসাইট বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে কিছু প্রচার বা প্রকাশ করলে অনধিক ১০ বছর কারাদন্ড বা অনধিক ২০ লাখ টাকা অর্থদন্ড অথবা উভয় দন্ডই রাখা হয়েছে। ২৯ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ মানহানিকর কোনো তথ্য দিলে সেই ব্যক্তির তিন বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে।
বেআইনিভাবে কারোর ওয়েবসাইটে প্রবেশ করলে তাকে সাত বছরের জেল ও ২৫ লাখ টাকা জরিমানা অথবা উভয় দন্ড দেওয়া হবে। এ ছাড়া বেআইনিভাবে অন্য সাইটে প্রবেশ করার পর যদি কেউ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে ক্ষতিগ্রস্ত হয়, তবে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডের বিধান রাখা হয়েছে। এ আইনের ১৭ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ যদি জনগণকে ভয় দেখায় এবং রাষ্ট্রের ক্ষতি করে, তাহলে ১৪ বছরের জেল ও এক কোটি টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ডে দন্ডিত হবে। ২৫ ধারায় বলা হয়েছে, কেউ যদি ওয়েবসাইট বা ডিজিটাল মাধ্যমে আক্রমণাত্মক ভয়ভীতি দেখায়, তাহলে তাকে তিন বছরের জেল ও তিন লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে।
নতুন আইনের আরও ভালো দিক হচ্ছে অনলাইনে কেনাকাটাকে সুরক্ষা দেওয়া। এ জন্য ৩০ ধারায় বলা হয়েছে, না জানিয়ে কেউ যদি কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে ব্যাংক-বীমায় ই-ট্রানজেকশন করেন, তাহলে তাকে পাঁচ বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেওয়া যাবে। ৩১ ধারায় বলা হয়েছে, ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে কেউ অরাজকতা সৃষ্টি করলে তাকে সাত বছরের জেল ও পাঁচ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দন্ড দেওয়া হতে পারে। এই আইনের ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২ ও ৩৪ ধারার সব অপরাধ জামিন অযোগ্য। তবে ২০, ২৫, ২৯ ও ৪৮ ধারার সব অপরাধ জামিনযোগ্য।
গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয় গণমাধ্যমকে। দেশের প্রতিটি সরকারই গণমাধ্যমের স্বাধীনতা আর গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা বিধানের কথা বলে। কিন্তু বাস্তবতা নির্মম। প্রায় প্রতিদিনই কর্মক্ষেত্রে নানাভাবে লাঞ্ছিত-নিগৃহীত হচ্ছে গণমাধ্যমকর্মীরা। প্রতিটি সরকারের সময়ে, সব ধরনের পরিস্থিতিতে। কখনও শারীরিকভাবে আক্রান্ত হচ্ছে, কখনও শিকার হচ্ছে হয়রানির। কখনও ব্যক্তি বা গোষ্ঠির হাতে, কখনও রাষ্ট্রের হাতে। স্বার্থের বিরুদ্ধে গেলেই গণমাধ্যম ও গণমাধ্যমকর্মীদের ওপর নেমে আসে খড়গ। হামলা, মামলা, আর হয়রানিতে দুর্বিষহ করে তোলা হয় জীবন।
প্রতিটি সরকারের সময়কাল রঞ্জিত হয়েছে সাংবাদিকের রক্তে। অথচ শিল্প হিসেবে সংবাদমাধ্যমের বিকাশ ও সাংবাদিকদের অধিকার রক্ষায় প্রতিটি সরকারই থাকে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। কিন্তু কোনো সরকারের হাতেই প্রণীত হয়নি একটি সাংবাদিক সুরক্ষা আইন। এমনকি দেশে একের পর এক সাংবাদিক খুনের ঘটনা ঘটলেও কোনো খুনের বিচার প্রক্রিয়াই সুষ্ঠুভাবে এগোয়নি। দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি হয়নি একটিরও। একইভাবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর হাতে দিনের পর দিন সাংবাদিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটলেও তেমন কোনো প্রশাসনিক ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। ফলে সাংবাদিকতা পেশা ক্রমাগতই ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে। প্রতিটি ঘটনায় পুলিশের পক্ষ থেকে প্রথাগত দুঃখ প্রকাশ ও হামলাকারীদের শাস্তির আশ্বাস দিলেও কার্যকর কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি।
গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থাকে শক্তিশালী ভিত্তির ওপর দাঁড় করানোর জন্য গণমাধ্যমের যেমন নিরপেক্ষতা দরকার তেমনি স্বাধীনভাবে কাজ করার যাবতীয় সুবিধা দিতে হবে। তাহলে সুশাসন প্রতিষ্ঠার গতি আরও ত্বরান্বিত হবে। আর সুশাসন সুমন্নত অবস্থানে পৌঁছালে গণমাধ্যম বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এ জন্য নতুন আইনে মিডিয়াকে সুরক্ষা দিতে হবে।
সংবিধান দেশের সর্বোচ্চ আইন। অন্যসব আইনে যাই থাক, সংবিধানের আইনই অগ্রাধিকার পাবে। সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদের ১ নম্বর ধারায় চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। ২ নম্বর ধারায় কিছু বিধিনিষেধ সাপেক্ষে বাক ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে। ৩২ ধারা এই অনুচ্ছেদ ও ধারার সম্পূর্ণ পরিপন্থী। অত্যন্ত দুঃখজনক হলো, ধারাটি সুগ্রন্থিত নয়, অস্পষ্ট, দ্ব্যর্থবোধক, অপব্যবহারযোগ্য, মতপ্রকাশ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার পরিপন্থী এবং সর্বোপরি সংবিধানিক আইনের সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
যে আইন মানবাধিকার রক্ষা করতে পারে না, যে আইন ন্যায়পর নীতিমালা রক্ষা করতে পারে না, যে আইন সংবিধান সমুন্নত রাখতে পারে না, যে আইন সব স্বচ্ছতা, যৌক্তিকতা এবং পদ্ধতিগত সংহতি রক্ষা করতে পারে না, সেই আইন আর যাই হোক জনস্বার্থ রক্ষা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষা করতে সক্ষম এ কথা বিশ্বাস করার কোনো যৌক্তিক অবকাশ নেই।
লেখক : বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী, আইনগ্রন্থ প্রণেতা
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।