২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত মোটা হবেন ৪০০ কোটি মানুষ
২০৩৫ সালের মধ্যে মাত্রাতিরিক্ত ওজন বা মোটা হবেন বিশ্বের অর্ধেকেরও বেশি মানুষ। সংখ্যার বিচারে যা
জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজম বলতে থায়রয়েড হরমোনের ঘাটতি জনিত সমসাকে বুঝায়, যা নবজাতকের জন্মের আগে থেকেই বা জন্মের সময় সংঘটিত হয়েছে। এসব শিশু যদি জন্মের ২ সপ্তাহের মধ্যে পর্যাপ্ত চিকিৎসা না পায় তা হলে দৈহিক, মানসিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক বৃদ্ধি মারত্মকভাবে ব্যাহত হয়।
থায়রয়েড হরমোন তৈরির কাঁচামাল হলো আয়োডিন, যা আমরা খাবারের সাথে পেয়ে থাকি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে এখনও পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেরই কম-বেশি এলাকা আয়োডিন ঘাটতিতে আক্রান্ত। অনেক দেশ সামগ্রিক আয়োডিন অবস্থার উন্নতি করতে পারলেও নেপাল, ভুটান, চাঁদ, ইন্দোনেশিয়া, পেরু, জায়ারে, চীনের পার্বত্য এলাকা সমূহ, ভারতে দক্ষিণ-পূর্বাঞ্চল এবং বাংলাদেশের কিছু কিছু অংশ আয়োডিনের ঘাটতি প্রবণ এলাকা হিসেবে চিহ্নিত হচ্ছে।
শিশু মাতৃগর্ভে বেড়ে উঠার সময় কালের সাধারণত চতুর্থ থেকে দশম সপ্তাহের মধ্যে তার থায়রয়েড গ্রন্থিটি তৈরি হতে থাকে। যদিও সকলের ক্ষেত্রে ঘটেনা, কিন্তু কিছু কিছু গর্ভস্থ শিশুর থায়রয়েড গ্রন্থিটি সঠিকভাবে তৈরি হতে ব্যর্থ হতে পারে ‘কারো কারো ক্ষেত্রে অপূর্ণাঙ্গভাবে গঠিত হয়’ কোথাও কোথাও গ্রন্থির কাঠামোগত ত্রু টি থাকতে পারে। কোথাও কোথাও জিনগত ত্রু টিও থাকতে পারে। যদি গ্রন্থিটি সঠিকভাবে তৈরি হয়, তাহলে ১০-১১ সপ্তাহের গর্ভকালীন সময়েই এগ্রন্থিটি থায়রয়েড হরমোন উৎপাদন করতে সমর্থ হয় এবং ১৮-২০ সপ্তাহের মধ্যেই গর্ভস্থ শিশুটির রক্তে থায়রয়েড হরমোনের পরিমাণ স্বাভাবিক মাত্রায় পৌঁছাতে পারে। যদি কোন সমস্যা না থাকে, তাহলে এ শিশুটির পিটুইটারি-থায়রয়েড অক্ষ স্বাধীনভাবে কাজ করতে সক্ষম হবে।
জন্মগত অন্যান্য ত্রু টিও এখানে প্রভাব বিস্তার করতে পারে।
মায়ের রক্তের থায়রয়েড হরমোনের পরিমাণ সাধারণত: গর্ভস্থ শিশুর থায়রয়েড গ্রন্থিকে ব্যাপকভাবে প্রভাবিত নাও করতে পারে। কিন্তু মায়ের থায়রয়েড গ্রন্থির সমস্যা শিশুর থায়রয়েড গ্রন্থির গঠনের ওপরে বা কার্যকারীতার ওপরে ব্যাপক প্রভাব বিস্তার করতে পারে। বিশেষ করে মায়ের যদি অটোইমিউন থায়রয়েড রোগ থেকে থাকে। যেখানে মায়ের রক্তে ওমএ অটো এন্টিবডি গর্ভফুল পার হয়ে শিশুর রক্তে প্রবাহে পৌঁছে যায়, যা শিশুর থায়রয়েড হরমোন তৈরিতে বাধা দিতে পারে। আবার এ প্রভাবটি সাময়িকও হতে পারে। রেডিও এক্টিভ আয়োডিন চিকিৎসা যদি গর্ভকালীন মহিলাকে দেওয়া হয়, তবে তা শিশুর থায়রয়েড গ্রন্থিকে স্থায়ীভাবে অকার্যকর করে ফেলে। থায়রয়েড হরমোন শিশুটির স্নায়ুতন্ত্র তৈরিতে ব্যাপক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে, যা বহু গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে।
আয়োডিনের ঘাটতি জনিত এলাকার (বাংলাদেশ ও ভারতে কিছু অংশসহ) নবজাতকদের ৫-১৫ শতাংশ জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিমে ভুগতে পারে। অন্যান্য এলাকায় বিশেষ করে আয়োডিন পর্যাপ্ত অঞ্চলসমূহে এ রোগের প্রাদুর্ভাব কম দেখা যায়। যেমন যুক্তরাষ্ট্রে প্রতি চার হাজার জীবিত শিশুর মধ্যে একজন শিশু এরোগে আক্রান্ত হতে পারে। পৃথিবীর কোন কোন অঞ্চলে ২-৩ হাজার জীবিত নবজাতকের একজনকে এসমস্যায় আক্রান্ত হতে দেখা যায়। একটি গবেষণায় বাংলাদেশে প্রতি ৪০০ (চার শত) জন নবজাতকের একজন জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত হবার সম্ভাবনা ব্যাক্ত করা হয়েছে।
জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত নবজাতক বা শিশুদের সুগভীর ও অপূরণীয়ভাবে মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়। স্নায়ুবিক বৃদ্ধি ব্যাহত হওয়াটা প্রথমত: বুদ্ধি বৃত্তিক বৃদ্ধিহীনতা বা মানসিক প্রতিবন্ধকতা হিসেবে লক্ষ্যণীয় হতে পারে। ক্রমশ: দৈহিক কাঠিণ্যের ঘাটতি বা থলথলে ভাব, অঙ্গপ্রতঙ্গের অস্বাভাবিক নড়াচড়া, কথা বলা বা শব্দ শুনতে অস্বাভাবিকতা পরিলক্ষিত হতে পারে। এ সময় শিশুটির থায়রয়েড হরমোনের মাত্রা পরিমাপ করলে স্বাভাবিক পাওয়া যেতে পারে, এমনকি শিশুর দৈহিক বৃদ্ধিও অনেকটা স্বাভাবিক মনে হতে পারে। এ ঘটনাটি সাধারণত: মাতৃগর্ভকালীন সময়ের প্রারম্ভিক সপ্তাহ গুলোতে মায়ের রক্তে আয়োডিনের ঘাটতির কারণে হতে পারে। শিশুরও অনেক ক্ষেত্রে ক্রিটিনিজম হতে পারে, যেখানে শিশুর দৈহিক বৃদ্ধি ব্যাহত হবে, থলথলে চামড়া থাকবে, শিশুটি হাবাগোবা হবে, তবে স্নায়ুবিক সমস্যা নাও থাকতে পারে। নবজাতকের এ সমস্যাগুলো ছেলে শিশুর চেয়ে মেয়ে শিশুকে দ্বিগুণ হারে আক্রান্ত করে।
দীর্ঘদিন যাবৎ যে সব এলাকায় আয়োডিনের ঘাটতি বিরাজ করছে, সেখানে ক্রেটিনিজম ধরণের জন্মগত থায়রয়েড হরমোন ঘাটতি জনিত রোগ দেখা যায়। এ সব শিশু সাধারণত: স্বাভাবিক গর্ভকালীন সময় পূর্ণ করে অথবা এ সময়কাল অতিক্রম করে জন্মগ্রহণ করে। এরা অতিশয় কম নড়াচড়া করে, কপালের উপর দিকের অংশটা বৃহৎ আকার থাকে, খাদ্য গ্রহণে অনীহা থাকে, দৈহিক বৃদ্ধি কম হয় বা ক্ষুদ্রাকৃতির হয়, মাংশপেশিগুলো খুব নরম হয়, কোষ্ঠকাঠিণ্য থাকে এবং অস্বাভাবিক কণ্ঠস্বর থাকে যা অনেক সময় বিড়ালের মিউ মিউ শব্দের মত মনে হতে পারে। এদেরকে প্রথাগতভাবে (বিশেষ করে বাংলাদেশে) খুব ভাল শিশু হিসেবে বিবেচনা করা হতে পারে। জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজমে আক্রান্ত শিশুরা ২৫০ গ্রামের কম বা ৪৫০ গ্রামের বেশি দৈহিক ওজন নিয়ে জন্মগ্রহণ করে থাকে। এ সব নবজাতকের জিহ্বা বৃহদাকার হতে পারে আইকিউ পরিমাপ করলে কাঙ্খিত মাত্রায় চেয়ে ১০-২০ পয়েন্ট কম পাওয়া যেতে পারে। এক্ষেত্রে মায়ের থায়রয়েড রোগে ভুগার ইতিহাসটা খুব গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে।
যে সব শিশুর মাঝে উপরিউক্ত লক্ষণসমূহ পাওয়া যাবে তাদের রোগ নিশ্চিৎ করণের লক্ষ্যে রক্তের থায়রয়েডের হরমোন (ঞ৪) এবং ঞঝঐ পরিমাপ করা হয়। সাধারণত: ঞ৪ কম পাওয়া যায় এবং ঞঝঐ বেশি থাকে। মায়ের থায়রয়েড হরমোনে অস্বাভাবিকতা যেহেতু অনুমেয়, মায়ের রক্তে থায়রয়েড হরমোনের মাত্রা (FT4, TSH এন্টি থাইরয়েড এন্টিবডি) পরিমাপ করতে হবে। অনেকক্ষেত্রে নবজাতকের থায়রয়েডের আল্ট্রাসনোগ্রাম গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দিতে পারে। মায়ের থায়রয়েড গ্রন্থির আল্ট্রাসনোগ্রামও অনেক সময় দরকার হয়।
রোগ শনাক্ত করার পর চিকিৎসা ব্যবস্থাপনা খুব সোজাসাপটা। শিশুটির দৈহিক ওজন মেপে থায়রয়েড হরমোন ট্যাবলেট খাবার জন্য চিকিৎসক পরামর্শ দেবেন। তবে আয়োডিনের ঘাটতি জনিত এলাকা সমূহে শিশুটির এবং মায়ের খাদ্য থেকে পর্যাপ্ত আয়োডিন পাবার ব্যাপারে জোর দিতে হবে। এক্ষেত্রে আয়োডিন সমৃদ্ধ মাছ, আগাছা এবং আয়োডিনযুক্ত লবণ খাওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ।
এ সব শিশুদের বৃদ্ধি নিশ্চিৎ করতে শারীরিক কর্মকান্ডের উপর বিশেষ গুরুত্ব দিতে হবে এবং প্রয়োজনীয় ক্ষেত্রে বিশেষায়িত শারীরিক শ্রমের ব্যবস্থা করতে হবে। মানসিক বৃদ্ধি ব্যাহত হয়ে থাকতে, সেক্ষেত্রেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়াটা জরুরী।
থায়রয়েড হরমোন খাওয়ানো শুরু করার ৪-৬ সপ্তাহ পরে FT4, TSH পরিমাপ করে ওষুধের পরিমাণ সমন্বয় করতে হবে। এভাবে পরবর্তী জীবন ওষুধ সমন্বয় করে পার করতে হবে।
অনেক ক্ষেত্রে জন্মগত হাইপোথায়রয়েডিজমের লক্ষণগুলো খুব সুস্পষ্ট নাও হতে পারে। কিন্তু ক্ষতিকর প্রভাব খুব মারাত্মক হবার কারণে পৃথিবীর প্রায় সকল দেশেই নবজাতকদের স্ক্রিনিং করার ব্যবস্থা আছে। যাতে দ্রুত রোগ শনাক্ত করে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া যায়। দূর্ভাগ্যজনক ভাবে বাংলাদেশে তা নেই। কিন্তু কোনভাবেই এটিকে অবজ্ঞা করার সুযোগ নেই। তাই রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে এবং ব্যাপক গুরুত্ব সহকারে নবজাতকদের হাইপোথায়রয়েডিজমের স্ক্রিনিং করার ব্যবস্থা নেওয়া জরুরী।
ডাঃ শাহজাদা সেলিম
সহকারী অধ্যাপক
হরমোন ও ডায়াবেটিস বিশেষজ্ঞ
এন্ডোক্রাইনোলজি বিভাগ
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ব বিদ্যালয়, ঢাকা।
Email:[email protected]
দৈনিক ইনকিলাব সংবিধান ও জনমতের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তাই ধর্ম ও রাষ্ট্রবিরোধী এবং উষ্কানীমূলক কোনো বক্তব্য না করার জন্য পাঠকদের অনুরোধ করা হলো। কর্তৃপক্ষ যেকোনো ধরণের আপত্তিকর মন্তব্য মডারেশনের ক্ষমতা রাখেন।